ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

বাবার ঋণ

নাজমুল হক রাইয়ান

প্রকাশিত : ০৭:৩৫ পিএম, ২৭ মে ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ১০:৩৮ পিএম, ২৮ মে ২০১৯ মঙ্গলবার

(প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত)

(প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত)

ভালোবাসি কথাটা বাবাকে কখনও বলতে পারিনি। বাবারা মনে হয় বড্ড অভিমানি হয়। বাবা কখনও তার কষ্ট বা পরিশ্রমের কথা বলেন আমাদের। আমরা কখনও তা সেভাবে অনুভব করতে পারিনি বা করার চেষ্টা করিনি। যখন কারো বাবা থাকে না, তখন হয়তো বুঝতে পারে। যেমন এখন বুঝতে পারছি হারে হারে। বাবারা সন্তান পরিবার তথা আমাদের জন্য কত কিছু করে যায়। তাদের কাছে আমরা সব সময় ঋণী থাকি। তাই আজ বাবার অনুপস্থিতিতে শুধু এটাই বলবো, বাবা তোমার ঋণ কখনও শোধ করতে পারবো না। আমাদের ক্ষমা করে দিয়ো।

এইতো দিন পনেরো আগের কথা। দুপুরে আব্বু খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। প্রচণ্ড গরম। রোদের তেজ আর তেজ নেই, যেন জ্বলন্ত অগ্নিদাহ। ক্লান্ত আমি বাসায় ফিরলাম। আব্বু আমার রুমে। দুদিন ধরেই আব্বু আমার রুমে থাকেন। বাসায় মেহমান আসছে। আব্বুকে দেখেছি সব সময় আমাদের বাসায় মেহমান আসলে তিনি তার রুমটা ছেড়ে দিতেন। কখনোই বিরক্ত হতেন না। বরং মনের দিক থেকে ভীষণ উৎফুল্ল থাকতেন। কি করবেন না করবেন অস্থির হয়ে যেতেন। আমি আসতেই বাবা উঠে বসলেন, ওষুধের পাতাটা হাতে দিলাম। তখনো দেখলাম সুস্থ মানুষ। অসুস্থতার বিন্দুমাত্র ছাঁয়া পড়েনি।

আমি নতুন একটা চাকরির সুয়োগ পেয়েছি। একটি প্রতিষ্ঠানের আইটি বিভাগে। বাসার সবাইকে বললাম। কিন্তু আব্বুকে বলা হয়নি। ভেবেছিলাম চাকরির নিয়োগপত্রটা হাতে পেয়ে আব্বুকে বলব। আম্মুকে না করলাম আব্বুকে বলতে। ২২ এপ্রিল যেতে হতো। আমি তাড়াহুড়া করে তৈরি হচ্ছি। সময় খুব বেশি নেই। মনের মধ্যে আনন্দের দোল।

আব্বু এসে সোফার রুমে বসলেন। আমার দিকে কয়েক নজর ফেলে আবার উঠে গেলেন। আব্বু-আম্মুকে ডেকে বললেন, আমার শরীর খারাপ লাগছে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। হঠাৎই আম্মুর চিৎকার `ও নাজমুল আসনা তোর আব্বু যেন কেমন করছে`। তোর আব্বুকে ডক্টরের কাছে নিতে হবে। সবগুলোই ছিল আম্মুর কথা। মামা ভাত খাচ্ছেন। আমি গিয়ে দেখি আব্বুর শ্বাস উঠেছে। মারিয়া তড়িঘড়ি করে রিকসা ঠিক করতে নিচে গেছে। আব্বু নিশ্বাস নিচ্ছেন থেমে থেমে।  নিজ হাতে জামা পড়ালাম আব্বুকে।

তখনো ভাবতে পারিনি এই রুমে আব্বু আর কখনও ফিরে আসবে না। আমি আব্বুকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছি। নামার সময়ও কেমন স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। হেটেই তো আব্বু নামলেন নিচে। একটা হাত ধরা ছিল আমার হাতে। তখনো বুঝিনি এই হাত ধরে এই প্রথম আর শেষ চলছেন আব্বু। ছোট বেলায় এই হাত ধরে আমি হাটতাম। আজ আব্বুকে নিয়ে হাটছি। এটাই ছিল ভিন্নতা। যেন আমার ছেলে আজ বাবা হয়ে ছেলের হাত ধরে চার তলা থেকে নিচে নামছে। নিচে নেমে দারওয়ানের চেয়ারে আব্বুকে বসালাম। মামা নিচে নামলেন।

তারপর  নাম ধরে ডেকে ঘুম থেকে জাগানো মানুষটা আর মুখ খোলেনি। জীবনের সঙ্গে লড়াই করা মানুষটা নিস্তব্ধ হয়ে চলে গেলো না ফেরার দেশে।  আকাশের কান্নায় মেঘ নেমে আসে আর মানুষ কান্নায় বাতাসের শব্দ। শুধু আমার চোখের নোনাজল শুকিয়ে গেছে শোকের খড়ায়। কেলেন্ডারের পাতা সাক্ষী হয়ে থাকলো সেদিনের দিন। প্রকাশ্যে এসে গেল জীবনের সহজ কঠিন।

ভাইবোন সব আমার ছোট। আমি পরিবারের বড় সন্তান বড়। বড়দের চোখে জল আসতে নেই। এতে বুক হাল্কা হয়ে যায়। আর যারা বড় তাদের হাল্কা হলে সমাজ চলবে না। তাদের হতে হবে ভারী। জীবন যুদ্ধের প্রথম ধাপ। টুকটাক সবাই নিজ ভাষায় সাহস দিয়ে যাচ্ছে। আর আমিও জানি আমাকেই করতে হবে সব। আমি ভেঙ্গে পড়লে চলবে না একদমই।

বাবা মারা যাওয়ার পর সবার মতো আমরাও খুঁজতে থাকলে তার কি কি সম্পদ আছে তার সন্ধ্যানে। সেই সঙ্গে কত টাকা ঋণ রেখে গেছেন তাও জানার চেষ্টা করতে থাকি। চারদিকে খবর আসতে থাকলো অনেক টাকা ঋণ রেখে গেছেন আব্বু। সংখ্যাটা মনেই থাক। ভাবতে অবাক লাগে, এই টাকার হিসেব কোথাও লেখা পাইনি। শুধু একটা কথার উপর টাকাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ভাতিজা তোমার আব্বা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গে আমার কিছু লেনদেন ছিল। সবাই বাবার ঋণের খোঁজ দিলেও বাবা যে টাকা পান সেটা কেউ বলেনি। কিন্তু আমরা জানতাম বাবা ব্যবসা করেন এবং মানুষের কাছে অনেক টাকাও পান।

জীবনে নতুন এক বাস্তবতার মুখে পড়ে গেলাম। বাবা কি সত্যি এতো টাকা ঋণী।  প্রশ্ন আছে উত্তর কোথাও নেই। দিনরাত এক করে পরিশ্রম করা মানুষটা এতো ঋণ কিভাবে রেখে যায়। প্রশ্ন আর প্রশ্ন। বাবার শোক মলিন প্রায় ঋণের শোকে।

ছোট বেলা থেকে দেখতাম আব্বু সবার জন্য ভাবতেন। তার ভাবনায় কোন অলসতা ছিল না। আর স্বার্থ সেতো আব্বুকে কোনদিন ছুতেও পারেনি। নির্ভেজাল ভালোবাসার মানুষ ছিলেন তিনি। কখনো বুঝিনি আব্বুর ভালোবাসা এতো গভীর ছিল। ভিতরটা কেমন খা খা করছে। শুধু বাবাকেই মনে পড়ছে।

অবশেষ ঠিক করতে হল বাবার ঋণ।  বাবার ঋণ কে ই বেছে নিতো হল আমাকে। স্বপ্নের চাকরি সে না হয় অন্যদিন করবো। কিন্তু চাকরি টা এখন আর স্বপ্ন নেই, চাকরিটা এখন প্রয়োজন। সংসার বাঁচাতে হবে। আয়ের উৎস আজ আমি-ই। বাবাকে কখনো সুখের হাসি দিতে দেখিনি। বরং রাত জেগে কান্না ভেজা হাত তুলতেন আল্লাহর কাছে। প্রায়শই বাবার কান্নায় চোখ খুলতো আমার।

আর বাবার রেখে যাওয়া ঋণ শোধ করা আমাদের কর্তব্য। তবে, তার কাছে আমরা সারাজীবন ঋণী থাকবো। কখনও বাবাদের ঋণ শোধ করা যায় না। তার আর্থিক ঋণটা হয়তো শোধ করা যায় কিন্তু বাবার ছায়ার ঋণটা শোধ করা যায় না।

 এসএইচ/