ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

এ কে খন্দকারকে দেখে অনেকে শিক্ষা নিতে পারে

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

প্রকাশিত : ০৩:৫২ পিএম, ৪ জুন ২০১৯ মঙ্গলবার

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, সেটাকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে হবে সবাইকে।

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে দল-মত নির্বিশেষে অভিন্ন অবস্থান থাকতে হবে। পাশের দেশ ভারতে আমরা যেটা দেখি, কংগ্রেস ক্ষমতায় নেই। কিন্তু বিজেপি সরকার দেশটির জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে প্রাপ্য সম্মান দিতে কার্পণ্য করছে না।

মহাত্মা গান্ধী একটি দলের নেতা ছিলেন, সত্য। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার পর তিনি জাতির পিতা, জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুও একটি দলের নেতা ছিলেন; কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে তিনি জাতির পিতায় পরিণত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এখন জাতীয় সম্পদ।

সব দলের উচিত তার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেহুদা তর্ক-বিতর্ক করে আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি। এখন আর নয়। এ কে খন্দকারকে দেখে অনেকে শিক্ষা নিতে পারেন। 

আর কিছুদিন পর বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে। যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হবে একই সময়ে। এটা ঠিক, এই সময়ে এসে আমরা অতীত নিয়ে পড়ে থাকতে চাই না।

তবে এ কে খন্দকারকে বই সংশোধেনের ক্ষেত্রে যারা বাধা দিয়েছেন,তার অবশ্যই সবার নাম প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করছি। কারণ জাতি তাদের সম্পর্কে জানা উচিত।   

নিজের লেখা বইয়ে অসত্য তথ্য দেওয়ার জন্য প্রায় পাঁচ বছর পর জাতির কাছে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার। `১৯৭১ :ভেতরে বাইরে` বইয়ে তিনি লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেছিলেন `জয় পাকিস্তান` বলে। দেশের স্বনামধন্য একটি প্রকাশনা সংস্থা থেকে বইটি বাজারে আসার পর হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভ্রান্তির নানা চেষ্টা নতুন নয়।

স্বাধীনতার পর থেকেই একটি মহলের মধ্যে এই প্রবণতা আমরা দেখে এসেছি। কিন্তু এ কে খন্দকারের বইয়ে এমন বিভ্রান্তিকর তথ্য অগ্রহণযোগ্য কেবল নয়, অপ্রত্যাশিতও ছিল। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ কেবল নন; ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিমান বাহিনীপ্রধান।

পরবর্তীকালে তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন; মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ছিলেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতা। তিনি যখন খোদ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন, তখন বিক্ষুব্ধ হওয়া তো বটেই, বিস্মিত হওয়াও স্বাভাবিক।

এ কে খন্দকারের বইটি প্রকাশের পর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে একটি দৈনিকে লিখেছিলাম `১৯৭১ :ভেতরে বাইরে নিয়ে তিন প্রশ্ন` শীর্ষক নিবন্ধ। সেখানে যে তিনটি প্রশ্ন তুলেছিলাম, তার প্রথমটি অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর ভাষণে এ কে খন্দকারের `জয় পাকিস্তান` শোনা নিয়ে।

ঐতিহাসিক ওই সভায় আমি নিজেও উপস্থিত ছিলাম। এ প্রসঙ্গে লিখেছিলাম- আমি তো বটেই; আমার ধারণা উপস্থিত গোটা জনসমুদ্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্রনিনাদের প্রতিটি শব্দ শুনছিল। আমরা হৃদয়ঙ্গম করেছিলাম ওই দিনের পরিস্থিতি।

ভাষণের সময় উপস্থিত সব মানুষের মনে এখনও সেই ভাষণ গেঁথে আছে। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শেষ করেছিলেন `জয় বাংলা` বলে। তিনি যেখানে বলছেন `এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম; সেখানে জয় পাকিস্তান কেন বলতে যাবেন- এটা তো কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়। (সমকাল, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪)।

আমার ওই নিবন্ধে আরও দুটি প্রশ্ন তুলেছিলাম। দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকে `মোটামুটি সফল` বলা নিয়ে। বইটির ৫২ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কে এই মূল্যায়ন করেছেন। আমার প্রশ্ন ছিল- একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন যদি `মোটামুটি সফল` হয়, তাহলে পুরোপুরি সফল আন্দোলন তিনি বিশ্বের কোথায় দেখেছেন?

আপামর জনসাধারণ ওই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিল। কৃষক, ছাত্র, জনতা, পেশাজীবী- সবাই সেদিন রাজপথে নেমে এসেছিল, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের নির্দেশনা অনুযায়ী `যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে`। এমন অসহযোগ আন্দোলন বিশ্বের আর কোথাও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক- বাঙালির একটি মহৎ আন্দোলনকে কি এ কে খন্দকার জেনেশুনেই খাটো করতে চেয়েছেন?

তৃতীয় প্রশ্ন তুলেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এ কে খন্দকারের সীমান্ত পাড়ি দেওয়া নিয়ে। তার বইয়ের ৭৪, ৭৫ ও ৭৭ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন, ২৮ বা ২৯ মার্চ পুরো পরিবারসহ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ গিয়ে আবার ফিরে আসেন। এপ্রিলের শেষ দিকে আবার চেষ্টা করে আরিচা থেকে ফিরে আসেন। তৃতীয় ও শেষ চেষ্টায় মে মাসে আগরতলা চলে যান।

আমার প্রশ্ন ছিল- তিনি বারবার সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করলেন এবং প্রত্যেকবারই বিমানবাহিনীর কর্মস্থলে ফিরে এসে দায়িত্ব পালন করে গেলেন; অথচ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী তাকে কিছুই বলল না? আমি একাত্তরে তরুণ অর্থনীতিবিদ মাত্র। বেসামরিক প্রতিষ্ঠান পিআইডিতে (বর্তমানে বিআইডিএস) কর্মরত। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর কারফিউ শিথিল হওয়ার প্রথম সুযোগেই ২৭ মার্চ এলিফ্যান্ট রোডের বাসা ত্যাগ করি এবং পরবর্তী সময়ে ঝুঁকি নিয়ে সিলেটের জকিগঞ্জ হয়ে ভারতে চলে যাই।

আমি ঢাকা ত্যাগ করার পরদিনই আমার বাসায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হানা দিয়েছিল। অথচ এ কে খন্দকারের মতো একজন বাঙালি সামরিক অফিসার নজরদারিতে ছিলেন না এবং দেশ ত্যাগ করার বারংবার চেষ্টা করেও বিমানবাহিনীর মতো সুরক্ষিত জায়গায় চাকরি করে গেছেন কীভাবে- এটা সত্যিই একটি বড় প্রশ্ন। 

যা হোক, এ কে খন্দকার নিজেই শেষ পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছেন, তিনি ভুল তথ্য দিয়েছিলেন। সপ্তাহখানেক আগে সাংবাদিকদের ডেকে এই ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। বইটির বিতর্কিত অনুচ্ছেদটি প্রত্যাহার করার ঘোষণা দিয়েছেন।

বিলম্বে হলেও তার যে বোধোদয় ঘটেছে, তা ইতিবাচক। কিন্তু বইটি কেবল `জয় পাকিস্তান` নিয়েই বিভ্রান্তি তৈরি করেনি। একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনকে `মোটামুটি` সফল বলেও কি তিনি বিভ্রান্তি তৈরি করেননি? আমার মতে, বইয়ের বাকি বিষয়গুলো নিয়েও তার উচিত বিভ্রান্তি নিরসন করা বা প্রত্যাহার করা।

বস্তুত এ কে খন্দকারের বিলম্বিত বোধোদয় এবং সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গ আরও তিনটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে- এত বড় `ভুল` তিনি করেছিলেন কেন? হতে পারে, তিনি বইটি নিজে লেখেননি। কাউকে ডিকটেশন দিয়েছেন।

তারপরও পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতের পর কি তিনি একবার পড়ে দেখেননি? বইয়ের ভূমিকায় তিনি যেভাবে `প্রচলিত অনেক ধারণা` ভেঙে দিতে চেয়েছেন, তাতে মনে হয় ৭ মার্চের ভাষণের তথ্য নিছক স্লিপ অব পেন নয়। বইটির ভাষ্য কি অন্য কোনো প্রকল্পের অংশ ছিল?

দ্বিতীয় প্রশ্ন- লেখার সময় বুঝতে না পারলেও এখন ভুল বুঝতে পারছেন কীভাবে? নাকি যে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বইটি লেখা, শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে তা ব্যর্থ হয়েছে? যদি তার এই ভুল স্বীকার সত্য হয়েও থাকে, তাহলে আরও গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। নিশ্চিত না হয়েই যিনি ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত বিষয়ে এভাবে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারেন; অন্যান্য বিষয়ে তাহলে তিনি কী করেন? এই ব্যক্তি আমাদের দেশের দুই মেয়াদে পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন!

তৃতীয় প্রশ্ন- একটি ভুল স্বীকার করতে প্রায় পাঁচ বছর লেগে গেল? তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভুল স্বীকার আগেই করতে চেয়েছেন; কিন্তু নানা কারণে পারেননি। তিনি যদি ভুল স্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারে আন্তরিক হয়ে থাকেন, তাহলে উচিত হবে এর পেছনের ঘটনা আদ্যোপান্ত খুলে বলা। বইটি কীভাবে লেখা হয়েছিল; মিথ্যা তথ্য দিতে কারা তাকে প্রভাবিত করেছে, কারা তাকে ভুল স্বীকার করতে দেয়নি; কারা বইটি সংশোধন করতে দেয়নি; স্বচ্ছতার স্বার্থে সব খুলে বলা উচিত।

পৃথিবীর যত দেশ আছে কোথাও কোনো জায়গায় জাতির জনককে নিয়ে বিরুপ মন্তব্য না করলেও বাংলাদেশে এমন ঘটনা শোনা যায়। তাই সবার উচিত জাতির জনককে নিয়ে মন্তব্যের বিষয়ে আরো যত্নবান হওয়া।   

লেখক: ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ