অন্যরকম ঈদ
আবদুল জাববার খান :
প্রকাশিত : ০২:৩৪ পিএম, ৫ জুন ২০১৯ বুধবার

প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে ক্লান্তিহীন ভাবে বাবা ডেকে চলেছেন।
: সানি, বাবা উঠে সেহরি খেয়ে নাও!
রুমে এয়ারকুলার চলছে। তাই দরজা বন্ধ।
তারপরও বাবার ডাকাডাকিতে ঘুম নষ্ট হয়ে গেল।
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বিছানা ছাড়লো সানি।
দরজাটা খুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে জানান দিলো,
: আসছি বাবা! তোমরা শুরু করো!
রমজানে প্রতি রাতেই সেইম কাহিনী।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কানে এয়ার ফোন লাগিয়ে ঘুমাতে। হয়তো এই ডাকাডাকির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। গান শোনাও হল।
কিন্তু সাহস হয় না। বাবা মানুষটা এমনিতেই রাশভারী টাইপের। রেগে গেলে ভয়ংকর।
রোজার পুরো মাসটাই নামাজ, সেহরি আর ইফতার নিয়ে সবাইকে তটস্থ করে রাখেন।
কোনরকম টাল্টুবাল্টু অ্যালাউ করেন না।
হাতমুখ ধুয়ে সানি ডাইনিং টেবিলে চলে এল।
মা এবং ছোট বোন রুমকি এখনও আসেনি।
চান্স পেয়ে বাবাকে আবদারের সুরে বললো,
: বাবা, সব ঈদেই তো আমাদের জন্য তোমার আলাদা একটা বাজেট থাকে।
বাবা কৌতূহলী হয়ে তাকালেন সানির দিকে।
মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলেন,
: হুম। তা থাকে। আমার যতো টাকাই থাকুক না কেন, বাজেট ছাড়া চলা যাবে না ডিয়ার সান!
এরিমধ্যে পুরোনো কাজের বুয়া সুখি`র মা টেবিলে খাবার সার্ভ করছে। দৌড়ের উপর আছে। কিচেন টু ডাইনিং।
সানি বললো,
: বাজেট ছাড়া চলতে আমিও বলছি না বাবা।
জানতে চাচ্ছি, আমার জন্য এবারের বাজেট কতো?
সানির বাবা শিল্পপতি জাহেদুল ইসলাম সাহেব সহজ মানুষ নন। বাতাসের ঘ্রাণ শুঁকেই অন্যদের মনের কথা বলে দিতে পারেন। তার মনে হচ্ছে, সানি হয়তো বড় ফিগারের কোন টাকা চাইতে যাচ্ছে।
ভ্রু কুঁচকে সানির দিকে তাকিয়ে বললেন,
: এটা তো তোমার মা বলবে। আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন? মতলবটা পরিষ্কার করো!
সানি একটু গলা খাঁকারি দিলো। নার্ভাস লাগছে। জানে, বাবা এখন এই রুমের বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছেন। সাহস করে
বললো,
: মতলব টতলব কিছু না বাবা। আমি এখন কলেজে পড়ছি। সেকেন্ড ইয়ারে। সব ফ্রেন্ডরা মিলে প্ল্যান করেছি, নিজেদের ঈদের কেনাকাটা এবার আমরা নিজেরাই করবো।
তাই টাকাটা এবার আমাকেই দাও!
নিজের পছন্দে সব কিনবো!
ধারণা সত্যি হয়েছে। জাহেদ সাহেব নিজের ওপর সন্তুষ্ট হলেন। বললেন,
: রুমকি তো তোমার বড়। সেতো আজ পর্যন্ত আলাদা করে কোন বাজেট চাইলো না।
সানি একটু হেসে বললো,
: আপু তো নীচতলায় গেলেও মাকে নিয়ে যায়। ও আবার আলাদা বাজেট কি চাইবে!
একটু রাগ হচ্ছে। কন্ট্রোল করে জাহেদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
: কতো টাকা দরকার তোমার?
সানি বললো,
: ভালো কিছু কিনতে গেলে একটু বেশি টাকা লাগবে। অন্তত পঞ্চাশ হাজার টাকা দরকার।
জাহেদ সাহেবের চোখ আরও সরু হয়ে এলো। বললেন,
: এতো টাকার ঈদ বাজেট তো দেয়া সম্ভব না। ত্রিশ হাজার টাকা পাবে তুমি। এটাও অনেক বেশি। আমার আছে বলেই দিচ্ছি।
আমার কথা শুনে তোমার কি মন খারাপ হয়েছে?
সানি একটু বিমর্ষ ভাবে জবাব দিলো,
: না বাবা। মন খারাপ হয়নি। ত্রিশ হাজারই দিও! আমার চলবে। থ্যাংক ইয়ু!
জাহেদ সাহেব বললেন,
: ওয়েল কাম মাই সান! ঈদের যেহেতু খুব বেশি বাকি নেই। কালই আমি টাকাটা তোমাকে দিয়ে দেবো। তবে প্রয়োজন হলে তোমার মা`র সাথে পরামর্শ করতে পারো।
মা আর রুমকি চলে এসেছে।
সেহরি পার্ট শুরু। চামচ আর বাটির সংঘর্ষে টুংটাং শব্দ হচ্ছে।
জাহেদ সাহেব তার স্ত্রী শারমিনকে বললেন,
: ছেলে বড় হয়েছে। নিজে নিজে কেনাকাটা করবে। তাই ওকে কাল ত্রিশ হাজার টাকা দিও! এটা দিয়েই ওকে ঈদ পার করতে হবে।
জাহেদ সাহেবের ধারণা ছিলো, স্ত্রী এটা শুনে কষ্ট পাবে কিন্তু শারমিন হেসে বলে উঠলেন,
: বাঁদর টা তোমাকেও পটিয়ে ফেলছে!
চিন্তিত চেহারা নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাহেদ সাহেব ভাবলেন,
: ছেলে তার মাকে আগেই ম্যানেজ করে রেখেছে। এটা আগে টের পেলাম না কেন! তাহলে কি ঘ্রাণশক্তি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে!
সানি তার সাকসেসফুল মিশন শেষ করে রুমে এসে বসে আছে। ফজরের নামাজের সময় হয়ে এলো প্রায়। ওযু করতে হবে। ভাবছে,
: বাবা খুব বেশি বুদ্ধিমান মানুষ। সবার চাইতে এক স্টেপ এগিয়ে থাকে। কিন্তু ছেলের সাথে হেরে গেল। টার্গেট ত্রিশ হাজার ধরেই পঞ্চাশ চেয়েছিলো। জানতো, পরিমাণ কমবেই। আরও কমার আশঙ্কা ছিল। কমেনি। তীব্র আনন্দ চেপে রেখে মন খারাপের ভান করেছে। বাবার স্বভাব জানে বলেই এই অ্যাকটিং টা করতে হয়েছে।
ঘ্রাণ নেবার ক্ষমতা ছেলের মধ্যে ট্রান্সফার হচ্ছে। বাবা এটা এখনো টের পায়নি। রক্ত বলে কথা!
ড্রইং রুমের টিভি বন্ধ করে বেডরুমে ঢুকলেন জাহেদ সাহেব। রাত সাড়ে দশটার মতো বাজে। এটাই তার রুটিন। দশটার খবর দেখার পর টিভি বন্ধ।
গিন্নী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথায় চিরুনি চালাচ্ছে। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে শারমিন বললেন,
: টাকা পেয়ে ছেলেটা বখে গেল। সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়। বাসায় এসে ইফতার করে আবার বেরিয়ে যায়। রাত দশটার আগে একদিন ও ফেরে না। চেহারাটা ও কেমন যেন উস্কো খুস্কো হয়ে গেছে। শুনলাম বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে বেড়ায়। নেশা টেশা করে কিনা কে জানে! নাহলে খামোখা ওসব জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করছে কেন!
আমার আর ভালো লাগে না!
জাহেদ সাহেব বললেন,
: আমার বিশ্বাস আছে। আমার ছেলে ছোট খাটো ভুল করলেও চরম খারাপ কিছুতে জড়াবে না। তুমি এগুলো নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না!
কথাগুলো বললেও জাহেদ সাহেবের মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ভাবছেন, ছেলের সাথে কথা বলতে হবে।
ইফতারের সময় টেবিলে পাওয়া গেল সানিকে। শেষ মুহূর্তে কোন রকমে এসে সবার সঙ্গে বসেছে। জাহেদ সাহেব গম্ভীর কন্ঠে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
: বয়স বাড়ছে। দায়িত্বশীল হতে হবে।
দুদিন পর ঈদ। নিজে কেনাকাটা করবে বলে এতো গুলো টাকা নিলে। কিনেছো কিছু? পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, কোন ঝামেলার কথা যেন না শুনি!
শুকনো মুখ করে জবাব দিলো সানি,
: আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি, চাঁদরাতে সবকিছু কিনবো বাবা! ওটাই হবে আমাদের চাঁদরাতের আনন্দ।
জাহেদ সাহেব চিন্তিত স্বরে বললেন,
: আমাদের সবার ঈদ শপিং শেষ। শুধু তোমারটাই বাকি। শেষ করে ফেললে ভালো হতো। এনিওয়ে... চাঁদরাতেই করো না হয়!
মা এবং রুমকি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকার ভান করছে। বাবা ছেলের কথার মাঝে কোন কথা বললো না।
চাঁদরাতের সন্ধ্যা।
সানি ফ্যামিলির সবাইকে মহল্লার পাশের বস্তিতে নিয়ে এসেছে। দেখা গেল, ওর বন্ধুরাও সবাই হাজির। কিছুক্ষণ পর সানির দুজন বন্ধু একটা পিকআপ ভ্যান ভর্তি মালামাল নিয়ে পৌঁছালো।
বস্তির ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চাদের হৈচৈ এ কান পাতা দায়। সানির বন্ধুরা ভলান্টিয়ারের কাজ করছে। সবাইকে সুশৃঙ্খলভাবে একটা লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলো।
জাহেদ সাহেব, শারমিন এবং রুমকি হতভম্ব হয়ে এসব দেখছে। জাহেদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
: পিকআপে কি আছে?
সানি একটু রহস্য করে বললো,
: আমাদের সবার ঈদের কাপড় চোপড়।
বাবা আমরা সবাই মিলে এবার ঠিক করেছিলাম যে এমনিতেই আমাদের যথেষ্ট কাপড়চোপড় আছে। নিজেরা না কিনে ওই টাকা দিয়ে এই বঞ্চিত শিশুদের জন্য ঈদের জামা কাপড় কিনবো।
কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে আমরা প্রায় তিনশ` ছেলেমেয়ের নাম লিস্ট করে সবাইকে একটা করে কার্ড দিয়েছি। এখন এই কার্ডগুলো জমা নিয়ে নিয়ে আমরা ওদেরকে নতুন জামা উপহার দেবো।
বিশ্বাস করো বাবা, তুমি রাগ করবে জেনেও আমি এই কাজটা করেছি কেবল নিজের ভালো লাগার জন্য। বড় হয়েছি না!
আমাকে মাফ করে দাও বাবা! স্যরি!
জাহেদ সাহেবের মুখ থেকে কথা সরছে না।
বুঝে গেছেন, বাতাসে ঘ্রাণ নিয়ে সবাইকে ধরতে পারলেও ছেলের বেলায় ফেইল করেছেন।
কোন রকমে বললেন,
: কাছে এসো বাবা! বলে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। দুচোখ ভিজে ঝাপসা হয়ে গেছে।
রুমকি এবং মা দুজনেই সানিকে বাবার বুক থেকে ছাড়িয়ে এনে জড়িয়ে ধরে থাকলো। এখন সবার চোখেই পানি।
মা রুমকিকে ধরা গলায় বললেন,
: গাড়িটা নিয়ে বাসায় যা! আমাদের সব নতুন কাপড়গুলো নিয়ে আয়! এগুলোর সাথে দিয়ে দেবো!
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বসুধা বিল্ডার্স লি.।
এসএ/