ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বিদ্যুতের আলোয় বদলে যাচ্ছে সন্দ্বীপ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:০৯ পিএম, ৯ জুন ২০১৯ রবিবার

নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভূমি চট্টগ্রাম জেলার দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষের বসবাস এখানে। মেঘনার ভাঙ্গনের কবলে পড়ে আয়তনে ছোট হয়ে আসা এই দ্বীপ এতোদিন বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরেই ছিলো। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে ছিল সন্দ্বীপ। সন্দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি ছিলো বিদ্যুৎ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্বিতীয় মেয়াদে সন্দ্বীপকে জাতীয় গ্রীডের সঙ্গে যুক্ত করার কাজ শুরু করে।

সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে আক্ষেপ ঘুচে সন্দ্বীপবাসীর। দেশে প্রথমবারের মতো ১৫ কিলোমিটার সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় সন্দ্বীপকে।

গত বছরের ১৫ নভেম্বর সর্বপ্রথম জাতীয় গ্রীড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা হয়। এরই মধ্য দিয়ে শুরু হয় সন্দ্বীপবাসীর স্বপ্নযাত্রা। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেয়ে সন্দ্বীপবাসী উচ্ছসিত।

ঢাকা থেকে ঈদ উদযাপন করতে আসা সন্দ্বীপের মইনুল হক রুবেল জানান, বৈরী আবহাওয়ায় ঈদ উদযাপন করতে সন্দ্বীপে এসেছি। নৌ যাতায়াত প্রধান সমস্যা হলেও এবার সন্দ্বীপ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হওয়ায় বেশ ভালো লেগেছে। প্রচন্ড গরমেও আমরা চব্বিশ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেয়েছি। যার কারণে সন্দ্বীপের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিও বেশ পরিবর্তন হয়েছে।

সন্দ্বীপের এনাম নাহারের ব্যবসায়ী রিধোয়ানুল বারী বলেন, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সন্দ্বীপ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হওয়ায় সন্দ্বীপে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে বলে মনে করি। সন্দ্বীপবাসীকে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন।

সন্দ্বীপের সাংসদ মাহফুজুর রহমান মিতা বলেন, সন্দ্বীপ হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ জনপদ। মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কোন সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করেনি। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে সন্দ্বীপে নজিরবিহীন উন্নয়ন হয়েছে। সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আসায় এ জনপদের মানুষের ভাগ্যাকাশে ধ্রুবতারা উদিত হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি আগামিতে সন্দ্বীপ পর্যটন ও ব্যবসা ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।

সন্দ্বীপ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান মাষ্টার শাহজাহান বিএ বলেন, বর্তমান সরকার সারাদেশে সমানুপাতিকভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সাধিত করেছে। ফলে উন্নয়নের ছোঁয়া আছড়ে পড়েছে দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপেও। সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সন্দ্বীপকে জাতীয় গ্রীডের সঙ্গে যুক্ত করে মাইল ফলক সৃষ্টি করেছে। এর মাধ্যমে সন্দ্বীপের মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। আমি বিশ্বাস করি দেশের উন্নয়নে সন্দ্বীপবাবাসী অতীতের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

সন্দ্বীপে নদী সিকিস্তি এবং বর্তমানে চট্টগ্রামে অবস্থানরত ব্যবসায়ী রণজিত কুমার বণিক বলেন, বিদ্যুৎ সন্দ্বীপবাসীর জন্য আশীর্বাদ। আমরা এক সময় বিদ্যুতের খাম্বা দেখেছি, কিন্তু বিদ্যুতের আলোয় এখন সন্দ্বীপ আলোকিত। নদী ভাঙ্গন এবং পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধার অভাবে সন্দ্বীপবাসী চ্ট্টগ্রামমুখী হয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধা এবং ভাঙ্গনরোধের কারণে আমরা আবার সন্দ্বীপমুখী হচ্ছি।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর একনেকের সভায় প্রকল্পটি পাশ হয়। এরপর আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার নিয়োগ ও কার্যাদেশ প্রক্রিয়া শেষ হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেডটিটির মাধ্যমে ১৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে।

প্রথমে সন্দ্বীপের বাউরিয়া বেড়িবাঁধ থেকে মাটি খুঁড়ে ১০ ফুট নিচ থেকে ড্রেন করে টানা হয় সাবমেরিন ক্যাবল। ২১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় ওয়াটার জেটের সাহায্যে সন্দ্বীপ চ্যানেল নদীর তলায় মাটির ১০ থেকে ২০ ফুট গভীরে দুটি সাবমেরিন ক্যাবল বসানোর কাজ। জাতীয় গ্রিড থেকে ১১ কেভি (কিলো ভোল্ট) ক্ষমতাসম্পন্ন ৩টি তার সীতাকুণ্ডের বাকখালী সাবস্টেশনে আসে। সাবস্টেশন থেকে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ৩৩ কেভি একত্রিত হয়ে একটি সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে নদীর তলদেশ দিয়ে বিদ্যুৎ এসে সংযুক্ত হয় বাউরিয়াঘাট এলাকায় স্থাপন করা ট্রান্সমিটারে। সেখান থেকে আবারো ১১ কেভি করে ভাগ হয়ে ৩টি তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে এনাম নাহারের পশ্চিমের সাবস্টেশনে। উক্ত সাবস্টেশন হতে সরবরাহ লাইনের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেনারেটরের সাহায্যে জ্বালানি তেল থেকে এই কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে কেন্দ্রের অধিকাংশ জেনারেটর নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯২ সালে চারটি জেনারেটর স্থাপন করা হলেও চার থেকে পাঁচ বছর ধরে তিনটি জেনারেটর বিকল রয়েছে। এরপর ৪১৭ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি জেনারেটরের সাহায্যে এত দিন বিদুৎ উৎপাদন করা হচ্ছিল। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের কারণে গ্রাহকদের ভোগান্তি চরমে উঠেছিল।

ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায়ও বিঘ্ন ঘটছিলো কিন্তু এখন বিদ্যুত আসায় সাধারণ জনগণের মুখে হাসি ফুটেছে।

বিদ্যুৎ সন্দ্বীপবাসীর জন্য অনেক বড় পাওয়া। বিদ্যুৎ আসায় এখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো প্রেরিত অলস বৈদেশিক মুদ্রায় এখন ছোট খাটো শিল্প-কারখানা চালু করা সম্ভব হবে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এই দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন স্পট সৃষ্টির পাশাপাশি এখানকার মৎস্য ও দুগ্ধজাত শিল্প বিকাশের মাধ্যমে বেকারত্ব দূরীকরণে ব্যাপক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সরকার মনে করছে সন্দ্বীপে বিদ্যুৎ আসায় পর্যটন খাতের বিপুল সম্ভাবনা গড়ে উঠতে পারে।

এসি