ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

কোন দিকে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৩৬ পিএম, ১০ জুন ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৬:৩০ পিএম, ১০ জুন ২০১৯ সোমবার

সাম্প্রতিক সময়ে ইস্টার সানডেতে গির্জা ও হোটেলে সন্ত্রাসী হামলাসহ চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কার রাজনীতি-অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কয়েকদিন ধরেই এমন হামলার কারণ খুঁজছে দেশটির সরকার। তবে নিদিষ্ট কারণ খোঁজে না পেলেও সরকারের চাপের মুখে ৯ জন মুসলিস মন্ত্রী ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছে।

এমন সঙ্কটে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এমনকি এ সংকট দেখতে চাচ্ছেনা সে দেশের জনগণও। দ্রুতই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পক্ষে তারা। ২১ এপ্রিলের এই হামলা মুসলিম সম্প্রদায় চালিয়েছে বলে দাবি করছে দেশটির সন্ন্যাসী, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা।

সর্বশেষ এ হামলার দায় স্বীকার করে মুসলিম মন্ত্রীদের পদত্যাগের দাবিতে তারা আমরণ অনশন করে আসছিল। এমন চাপেরমুখে শেষ পর্যন্ত শনিবার (৮ জুন) পদত্যাগ করলেন মন্ত্রীরা।

এছাড়া বিগত কয়েক মাস ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করেন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। পাশাপাশি সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এমন সংকট নিরসন হতে না হতেই। নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। শ্রীলঙ্কার এমন রাজনীতি দেশীয় অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকদের মতে, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে ট্যুরিজম। প্রায় ১০ লাখ মানুষ এই পেশাতে কর্মরত রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ দর্শনার্থী ভারতীয় মহাসাগর দ্বীপ দেখতে আসছে। শ্রীলঙ্কার রাজনীতি পরিস্থিতি পরিবর্তন না হলে এই বিপুল সংখ্যক পর্যটক হারাবে দেশটি।

ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের এশিয়া অর্থনীতিবিদ অ্যালেক্স হোলস বলেন, গত দশকে শ্রীলংকার জন্য পর্যটন একটি বড় সাফল্যের ‘গল্প’। তবে এবার এমন হমলার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যটকরা শ্রীলঙ্কার আসতে অনিচ্ছা জ্ঞাপন করতে পারে।

হোমস আরো বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মনে করছে এমন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবে শ্রীলঙ্কা। আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তবে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা আরো দুর্বল হয়ে উঠতে পারে।

এছাড়া হামলার পর বিমানের শত শত যাত্রী তাদের বুকিং বাতিল করেছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। অনেকের ফ্লাইট পরিবর্তনের জন্য বলা হয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে শ্রীলংকার অর্থনীতিতে ধ্বস নামবে।

এই সংকট মুলত শুরু হয় গত ২৬ অক্টোবর। ঐদিন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহকে বরখাস্ত করেন। পরের দিন স্থগিত করেন পার্লামেন্ট। ভেঙে দেন মন্ত্রিসভা। সঙ্কট চরমে ওঠে, যখন তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। দুর্নীতি ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত রাজাপাকসে ২০১৫ সালের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের হঠাৎ নেয়া এই সিদ্ধান্তে দেশটি রাজনীতি তো বটেই অর্থনীতিও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে।

এখন আবার মুসলিম মন্ত্রীদের গণপদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনায় নতুন সংকটের জন্মদিল। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন সিনিয়র রাজনীতিকসহ উদারমনা অনেকেই নিন্দা জানিয়েছেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সাম্প্রদায়িক দাবি নিয়েও সমালোচনা হচ্ছে।

বিদেশী গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে মোট ২২৫ আসন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে দেশটির ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির প্রধান রণিল বিক্রমাসিংহ পেয়েছিলেন ১০৫ আসন। আর রাজাপাকসে’র ফ্রিডম পার্টি পেয়েছিলো ৯৫টি আসন। কিন্তু বর্তমানে দুজনের কারোরই ১০০টি আসনও নেই। এ পরিস্থিতিতে নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে’কে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হবে। না দিতে পারলে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাকেও পদত্যাগ করতে হবে। এই পরিস্থিতে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে দেশটিতে নতুন জাতীয় ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। বর্তমানে দেশটির মোট প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.১%।

সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার উন্নয়ন সূচক অপেক্ষাকৃত ভালো ছিলো। দেশটিতে সাক্ষরতার হারও সন্তোষজনক, প্রায় ৯২ শতাংশ। হঠাৎ শুরু হওয়া এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশটির এই উন্নয়নের জন্য হুমকি স্বরূপ। তার উপর এই পরিস্থিতির দিকে বিশেষ নজর রয়েছে এই অঞ্চলের প্রভাবশালী দুই দেশ ভারত ও চীনের। প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই দেশ শ্রীলঙ্কার উপর প্রভাব বিস্তারে এক রকম প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

গত ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলীয় হাম্বানটোটায় ১১০ কোটি ডলারের বিনিময়ে গভীর সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের জন্য চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিলো দেশটির সরকার। এছাড়া চীনের ঋণ সহায়তায় বড় বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিলো। তবে এমন রাজনীতি অবস্থা চলতে থাকলে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা অনেকটা শংঙ্কা থেকেই যায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অবোকাঠামো উন্নয়নে শ্রীলঙ্কা বিপুল পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএসএফসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। রাজনীতিতে দমন-পীড়ন, জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা চলতে থাকলে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে।

শ্রীলঙ্কায় মোট জনসংখ্যা দুই কোটি ১০ লাখ। এর মাত্র ৯ শতাংশ মুসলিম। চলতি বছরে গত ২১ এপ্রিল ভারত মহাসাগরীয় দেশটির তিনটি চার্চ ও তিনটি বিলাসবহুল হোটেলে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ২৫০ জন নিহত ও কয়েকশ’ আহত হন। এ ঘটনায় দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস।

টিআর/এসি