মতবিরোধ আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে দিশেহারা ঐক্যফ্রন্ট
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ
প্রকাশিত : ১০:৪৩ পিএম, ১১ জুন ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৬:০০ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ বৃহস্পতিবার
শরিকদের মধ্যে চলমান ক্ষোভ ও দূরত্ব মোচন করা গেল না। জাতীয় সংকট নিরসনের নামে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টই এখন চরম সংকটে ডুবে আছে। শেষ পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য টিকবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারাই। গতকাল সোমবার দীর্ঘ দিন পর বৈঠকে বসলেও আন্দোলনের কোন রূপরেখা ঠিক করতে পারল না এ জোট। শরিক দলের নেতাদের মধ্যে চলমান ক্ষোভ নিরসন না হলেও মুখ দেখা দেখি হয়েছে মাত্র।
এর মধ্যে আন্দোলনের চিন্তা ভাবনা করছে ঐক্যফ্রন্ট। আন্দোলনে কে কতটুকু লাভবান হবে এমনটিও ভাবছে কোন কোন শরিক দল। এ ক্ষেত্রে মতানৈক্য কমার সম্ভবনা নেই বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সরকার হটানোর আন্দোলনে ঐক্যফ্রন্ট জনসম্পৃক্ততা পাবে এমন সম্ভাবনা তেমন একটা নেই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিন্দু বিন্দু মতানৈক্য থেকে সিন্ধু পরিমান বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। জোটে মতানৈক্য ও সমন্বয়হীনতা যখন চরমে পৌঁছেছে তখন জোট নেতারা মতানৈক্য থেকে বেরিয়ে আসতে জোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। কোন কোন শরিক দল জোট ছাড়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মতানৈক্য নিয়ে কোন আন্দোলনই হালে পানি পাবে না এমনটি অনুধাবন করে ঐক্য টিকিয়ে রাখতে ফ্রন্ট নেতারা একে অপরের দরজায় গেলেও তা কাজে লাগছে না। প্রায় দুই মাস বিরতির পর রাজধানীতে সোমবার ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বাসায় বৈঠকে বসেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা। ঐক্যফ্রন্ট আহবায়ক ড. কামাল হোসেন এবং শরিক ও নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন।
জোটের শরিক দলগুলোর মতবিরোধ ও জোটের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ঠিক রাখতে বৈঠক হলেও তেমন ফলপ্রসু কোন আলোচনা হয়নি। একে অপরের ওপর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেছেন নেতারা। কেউ কেউ ক্ষোভ নিয়ে অন্য নেতাদের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে মুখ ভার করে ছিলেন বলে জানা যায়। বৈঠকের শুরুতে বারবার ঘোষিত অনড় অবস্থান থেকে সরে এসে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও গণফোরামের নির্বাচিতদের সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়ে সংসদে যোগদান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বৈঠকে এ শরিক দলদুটিকে তুলোধোনা করেছে অন্য শরিক দলগুলো।
তবে কেন বিএনপি সংসদে গেল তা কামাল হোসেনের উপস্থিতিতে বৈঠক করে শীঘ্রই জানানো হবে বলে অন্য নেতাদের জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব ও ঐক্যফ্রন্ট মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তবে গণফোরাম থেকে নির্বাচিতরা শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ায় ড. কামাল হোসেনও বিএনপির মত দোষী বলে মনে করেন জোট নেতারা।
এ দিকে অসুস্থতার কারণে এ বৈঠকে কামাল হোসেন উপস্থিত হতে পারেননি এমনটি বলা হলেও পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি বৈঠকে আসেননি বলে মঙ্গলবার একটি জাতীয় দৈনিক উল্লেখ করে। সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলতে সিদ্ধান্তের জন্য কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আগামী সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়। এখন এক কামাল হোসেনই ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত আটকে গেল কিনা বলে প্রশ্ন উঠেছে। আন্দোলন করা হবে, আন্দোলন কঠোর থেকে কঠোরতর হবে, গণতন্ত্র উদ্ধার করা হবে, খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করতে হবে এমন অনেক কথা বৈঠকের আলোচনায় উঠে আসে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া দুই জন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বৈঠকে ফলপ্রসু কোন আলোচনা হয়নি। আন্দোলন করা হবে, গণতন্ত্র উদ্ধার করা হবে কিন্তু কোন রূপরেখা দেওয়া হয়নি।
জানা যায়, সর্বশেষ গত ২৪ এপ্রিল ঢাকায় ঐক্যফ্রন্টের আহবায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের চেম্বারে জোটের এক বৈঠকে নতুন করে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন করতেই পারেনি ঐক্যফ্রন্ট। এরপর আর কোন বৈঠকে বসেননি জোট নেতারা। প্রথমে গণফোরামের দুজন ও পরে ২৯ এপ্রিল বিএনপির পাঁচ জন সংসদ সদস্যের শপথ গ্রহণ করে সংসদে অংশ নেওয়ার পরই নড়েচড়ে উঠে ঐক্যফ্রন্টের ভিত্তি। বিএনপি দলীয় রাজনীতির কৌশলের কারণে সংসদে অংশ নিয়েছে এমনটি বলা হলেও অন্য শরিকদের প্রশ্ন তাহলে ঐক্য করার কি প্রয়োজন ছিল। এ নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠলেও বিষয়টি এড়িয়ে চলছে বিএনপি। উপরন্তু নিজের দীর্ঘ দিনের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি দীর্ঘ দিনের বন্ধু বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার ঘোষণা দেয়।
গেল বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের পর নির্বাচন মানি না বললেও দলের নির্বাচিতরা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের পর ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে মতানৈক্য প্রকাশ্যে আসে। গত ৯ জুন জোটের শরিক কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সংবাদ সম্মেলন করে ফ্রন্ট ছাড়ার হুমকি দেন। জোটের মধ্যকার অসংগতি দূর না হলে ৮ জুন জোট ছাড়ার ঘোষণা দিলেও আজ পর্যন্ত ফ্রন্ট ছাড়েনি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। সোমবারের ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে কাদের সিদ্দিকী দলের আরও দুইজন নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। ধৈর্য্য ধারণ করে একটু সময় দিয়ে দেখবেন বলে তিনি এখনই জোট ছাড়ছেন না বলে সাংবাদিকদের জানান কাদের সিদ্দিকী।
এদিকে ঐক্যফ্রন্টের মতানৈক্য কমার সম্ভাবনা তেমন একটা দেখছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. শান্তনু মজুমদার একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে বড় তিনটা ভাগ হলো ড. কামাল হোসেন, বিএনপি এবং সাবেক আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট। এর মধ্যে বিএনপির সঙ্গে সাবেক আওয়ামী লীগ বা কমিউনিস্ট নেতারা থেকে যেতে পারেন। তবে ড. কামাল হোসেনের থাকার সম্ভবনা তেমন একটা নেই।’ সে ক্ষেত্রে কাদের সিদ্দিকী কোন দিকে যেতে পারেন বলে মনে হয় এমনটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাদের সিদ্দিকী বিএনপির সঙ্গে থেকে যেতে পারে।’
বিএনপি এখনও জামায়াত না ছাড়ায় এ নিয়ে মতবিরোধ এবং জনবিছিন্নতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে করেন তিনি। ঐক্যফ্রন্ট আন্দোলনে জনসমর্থন তেমন একটা পাবে না বলে মনে করেন এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘সরকারের ত্রুটি নিয়ে আন্দোলনে কিছুটা গতি দেখা যেতে পারে তবে আন্দোলন করে সরকার ফেলে দেওয়ার মত অবস্থা আর নেই। আর বিএনপি এক সময় জামায়াতের শক্তিতে আন্দোলন করেছিল এখন আর সেই অবস্থান নেই।’
ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে বিরোধ এমন বিষয়টির সাথে এক মত হতে পারলেন না নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক ও ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি মঙ্গলবার রাতে টেলিফোনে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টে মতৈক্য এমন কোনো পর্যায়ে যায়নি যে আর ঐক্য টিকবে না। আর সংসদের যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন শুধু ঐক্যফ্রন্টের নয়, সবার। এটা স্বাভাবিক কেননা বলা হয়েছিল এ নির্বাচন মানি না। এখন আবার সেই নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েই সংসদে নেতারা গেল। আর শুধু বিএনপি নয় গণফোরামও একই দোষে দোষী। মির্জা ফখরুলের সাথে সাথে ড. কামালকেও এর সঠিক উত্তর দিতে হবে। আমরা এখনও এ উত্তর পাইনি।’
ঐক্যফ্রন্ট আন্দোলনে গেলে জনসম্পৃক্ততা পাবে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখনও আন্দোলন শুরু হয়নি। তাহলে কিভাবে বোঝা যাবে যে জনগন সম্পৃক্ত হবে না? গত দুটি নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ায় জনগন তা প্রত্যাখান করেছে।’ গত দুই নির্বাচন যদি জনগন প্রত্যাখান করে তাহলে কিভাবে সরকার ভালোভাবেই তার দায়িত্ব পালন করল এবং জনগনের মধ্যে সরকার বিরোধী কোন অবস্থানই কেন দেখা গেল না এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।
এমএস/এসি