ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

‘বাবার জন্যে গর্বে বুক ভরে যায়’

নওশেবা সাবিহ কবিতা

প্রকাশিত : ০১:০৪ পিএম, ১৬ জুন ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০৯:৩৩ পিএম, ২১ জুন ২০২০ রবিবার

বাবাকে নিয়ে অনেক গান কবিতা লেখা হলেও বাবার অপূর্ণতা কি কখনো পূরণ করা যায়? কে না চায় বাবার আদর ভালবাসা পেতে। এই পৃথিবীতে কারও বাবা আছে আবার কারও নেই। বাবা দিবসে বাবাকে মনে করেন অনেকেই। যাদের বাবা নেই তারাই বোঝে বাবা হারানোর বেদনা। আর যাদের বাবা আছে তারা কি বুঝবে বাবা হারানোর কষ্ট?

বাবা দিবস নিয়ে অনেক গুণীজনরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখছেন। তার তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করছেন। তেমনি একজন গুণী ও আলোকিত মানুষ নওশেবা সাবিহ কবিতা। তিনি শিশু-কিশোর মাসিক পত্রিকা “টইটম্বুর” এর সম্পাদক। তিনি বেশ কিছুদিন আগে লিখেছেন তার বাবাকে নিয়ে। আবেগ, অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। তার লেখাটি একুশে টিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

‘রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে হরহামেশাই বটবৃক্ষ চোখে পড়ে আমাদের। তখন বটবৃক্ষের গুণাগুণ মনে করার চেষ্টা করি। কিন্তু বাস্তবে বটবৃক্ষ কী, সেটা ভালোমতো টের পেয়েছি ২০০৮ সালে । আমার মা সেলিমা সবিহ্ (টইটম্বুরের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) হঠাৎ করে গত হলেন (২০০৮ সালের ১২ জানুয়ারি)। সেই থেকে আমার বাবা চিত্রশিল্পী (চট্টগ্রাম চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও টইটম্বুর উপদেষ্টা) ও কথাশিল্পী সবিহ্ উল আলম একাধারে আমার মা ও বাবা দুটোই।

বলতে গেলে আমরা ৩ ভাইবোনই (নায়ক, কবিতা ও সুমন) একেবারে ছোট থেকেই আমাদের বাবা-মাকে পেয়েছি বন্ধুর মতো । সব কথাই আমরা তাদের সাথে ‘শেয়ার’ করতাম। কোনো রাখ-ঢাক ছিল না। পরিচিত -পরিজনরা ব্যাপারটি লক্ষ্য করে যেমন অবাক হতেন, তেমন প্রশংসাও করতেন ।

হঠাৎ করে মা চলে গেলেও বাবার সাথে বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি এতটুকুও। আমার বাবা বরাবর চুপচাপ স্বভাবের মানুষ। কিছুটা আমার দাদা কথাশিল্পী মাহ্বুব উল আলম -এর মতো। আমার কাছে অন্তত তাই মনে হয়। দাদার মতো নিজের ব্যাপারে উচ্চকিত নন। বাবা খুব নিয়ম মাফিক এবং নীতিবান। নিজের কাজ নিরিবিলিতে করতে খুব পছন্দ করেন। এখন তো ৭৮ বছর বয়সেও সকাল থেকে রাত অবধি টানা ব্যস্ত থাকেন।

মাশাআল্লাহ্। ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন সময়মতো। আমার মাসহ হজব্রত পালন করেন ২০০৩ সালে। খুব ভোরে উঠে নামাজ পড়ে, কোরআন পড়ে নিয়মিত ডায়েরি লেখেন। খুব স্বল্পাহারী। ছোটবেলা থেকেই দেখছি খুব কম খান। খুব একটা খাদ্যরসিক নন । তবে কারো হাতের রান্না পছন্দ হলে প্রশংসা করেন। আমার হাতের অনেক রান্নাই আমার বাবার প্রিয় - তবে মসুরের ডাল দিয়ে চিংড়ি শুঁটকির রান্না বেশি প্রিয়।

আমার বাবার ২ পৌত্র ও ১ পৌত্রি আর ১ দৌহিত্র (আমার ছেলে #যাররাফ)। নাতি-নাতকুড়দের সাথেও রয়েছে বাবার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ওরা ওদের যে কোনো কথা ‘শেয়ার’ করে তাদের দাদা-নানার সাথে। বন্ধুত্বের কথা নিয়ে বলি - আমরা ৩ ভাই বোন ছাড়াও বাইরের আরও অনেক ক’জন ছেলেমেয়েও বাবাকে বন্ধুর মতো ভাবে । শুধু তা-ই নয়, তারা বাবাকে ‘চাচা’ সম্বোধন করলেও ‘পিতৃপ্রতিম’ মনে করে শ্রদ্ধার আসনে বসায়।

এখানেই শেষ নয়, যাদের ‘বাবা’ নেই, তাদের তো বাবা নিজের ছেলে-মেয়ে বলেই গণ্য করেন। পাশাপাশি তারাও তাদের যে কোনো সমস্যা, সুখ-দুঃখের কথা বাবার সাথে শেয়ার করে । আর বাবা সানন্দে তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান বাৎলে দেন । বাবা প্রায়ই গর্ব করে বলেন- তার অ-নে-ক ক’ জন ছেলেমেয়ে । আসলেই তাই । আমিও মাঝে মাঝে ভাবি - বাবা এতো এতো ছেলেমেয়েকে একই সঙ্গে ‘স্নেহ-সুধা’ বিলান কীভাবে ?

আসল কথা - বিধাতা কাউকে না কাউকে এমন ক্ষমতা দিয়েই দুনিয়ায় পাঠান । আমার ভাবতে ভালো লাগে যে, আমার বাবা এই গুটিকয়েকের একজন । আমাকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করেন - তোমরা ভাইবোন ক’ জন? আমি কিন্তু চটজলদী হিসেব করে উত্তর দিতে পারি না। তার কারণ রক্তীয় ভাইবোনের চেয়ে আমার আত্মিক ভাইবোনের সংখ্যাই বেশি । দিনে দিনে এই সংখ্যা শুধু বাড়ছেই .................................... আর সেটা বাবার কারণেই। এতে আমি অখুশি নই, বরং গর্বিত।

আমি এই লেখা শুরু করেছি ‘বটবৃক্ষ’ দিয়ে। হ্যাঁ, আমার বাবা হলেন ‘বটবৃক্ষ’। তাঁর স্নেহ-ছায়ায়, মায়া-মমতায় সবাই আরামে থাকতে পারে। এ মুহূর্তে আমাদের জীবনপথের চলমানতায় বলতে গেলে পুরোটাই জুড়ে আছেন আমার ‘বাবা’।

যদি বলি - আমাদের দৈনন্দিন জীবনের হাসি-কান্নায়, সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, সাফল্য-ব্যর্থতায়, উত্তেজনায়-অবসাদে, জীবন - সংগ্রামে বটবৃক্ষের ছায়ার মতো ঘিরে আছেন আমার বাবা। তাহলেও বোধ করি এক বর্ণ মিথ্যে বলা হবে না - এমনই আমার ‘বাবা’ !

বিভিন্ন সময়ে অনেকেই আমায় বলেছে - ইস্ তোমার বাবা যা ভালো আর ফ্রেন্ডলি, আমার বাবাও যদি এমন হতেন?! - এ কথা শুনে বাবার জন্যে গর্বে বুক ভরে যায়।

আমার কাছে আমার বাবা অনেক গুণের আধার। পুত্রপ্রতিম কাউকে তিনি ‘বাবা’ আর কন্যাপ্রতিম কাউকে ‘মা’ সম্বোধন করেন। পাতানো সন্তানরা এতে যারপরনাই আনন্দিত হয়, খুশি হয় - এটা বেশ বুঝতে পারি ।

বাবার চরিত্রের একটি বিশেষ দিকের কথা না বললেই নয়, বাবা তাঁর পজিটিভ অ্যাটিচ্যুড দিয়ে অনেক কঠিন সমস্যা খুব সহজেই মোকাবেলা করেন। অনেকেই জানেন - বাবা তাঁর পজিটিভনেস দিয়ে অনেক ‘বেপথু’ মানুষকে সুপথে এনেছেন।

আমি ছোটবেলা থেকেই দেখছি বাবা অনেকের বিয়েতে ঘটকালি করেছেন এবং করছেন। আবার অনেকের ভাঙা ঘর (মানে ভেঙে যাওয়া বিয়ে) জোড়া দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর অকাট্য যুক্তি হলো - যে কোনো জিনিস ভাঙতে এক সেকেণ্ডও লাগে না, কিন্তু জুড়তে লাগে অ-নে-ক সময় - অ-নে-ক দিন । বিয়েটাও তেমনই।

আমার বাবার সাথে আমার এক উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হলো - হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর তাঁর মেয়ে রানু মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া - ‘আয় খুকু আয় ...... ‘গানটি। আমরা মানে আমি আর বাবা অনেক অনুষ্ঠানে অনেকবারই গানটি পরিবেশন করেছি। সবাই খুব প্রশংসা করেছেন আমাদের দ্বৈত পরিবেশনা। কেন যেন এই গানটি গাইবার সময় আমি আর বাবা অনেক ইমোশনাল আর নস্টালজিক হয়ে পড়ি। তখন আমার ইমোশনাল বাবাকেও আমি ‘ফিল’ করতে পারি।

আমি বাবার কাছ থেকে প্রথম জেনেছি যে, আনন্দ শেয়ার করলে বাড়ে আর দুঃখ শেয়ার করলে কমে। আমি নিজেও কোনো সমস্যায় পড়ে যখন থৈ পাই না, তখন শরণাপন্ন হই বাবার । তাঁর সঙ্গে শেয়ার করে হালকা হই, পথের দিশা পাই । অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই । আমার বাবা তাই শুধু আমাদের পরিবারেরই নয়, অন্য অনেক পরিবারেরও বটবৃক্ষ।

বাবা দিবসে আমার এই ‘বটবৃক্ষ’ বাবার দীর্ঘায়ু কামনা করি, যেন তিনি দীর্ঘদিন তাঁর এতো এতো ছেলেমেয়ের মাঝে স্নেহ-সুধা বিলিয়ে যেতে পারেন।

শেষ করি ছোট্ট একটি কথা দিয়ে -
‘বাবা নামের মাহাত্ম্য তাই
দামের চেয়েও দামী
খুঁজে ফিরি সকল কাজেই
গর্বিত এই আমি।’

এমবি//