ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

বাবা হতে না পারা মিজানুরের গল্প

মিঞা মিজানুর রহমান কাজল

প্রকাশিত : ০২:১৩ পিএম, ১৬ জুন ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০২:১৯ পিএম, ১৬ জুন ২০১৯ রবিবার

বাবা এক অম্লান অভিভাবকত্ব ও পরম যত্নের আশ্রয়ের নাম। বাবা ডাকেই যত অধিকার, ভালোবাসা ও ভরসা নিহিত থাকে। পৃথিবীর সব পুরুষই চান এক সময় বাবার এই অবস্থানে নিজেকে দেখতে, বাবা ডাকটি শুনতে। পৃথিবীর সকল কিছুর বিনিময়ে যেন তারা সন্তানের মুখে এ ডাকটি শুনতে পান।

বাবা দিবস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন সনি ইলেকট্রনিক্স এ কর্মরত মিঞা মিজানুর রহমান কাজল। তিনি বাবা না হওয়ার যাতনা নিজের ফেসবুক প্রফাইলে তুলে ধরেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের প্রফাইলে তার স্ট্যাটাসটি একুশে টেলিভিশন অনলাইনের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

‘এই বিবাহিত জীবনে পরিচিত ও অপরিচিতজন থেকে একটি কথা বহুবার শুনতে হয়েছে- ভাই, ছেলে-মেয়ে কতজন? এ কথা সে কথার বুঝ দিয়ে হয়ত সাময়িক সময় পার করতে চেষ্টা করেছি কিন্তু এত বছরেও সেই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা কিংবা বুঝার বাকী থাকে না অনেকেরই। তারপরেও প্রতিমুহূর্তে এই একই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আজও পথ চলছি।

তাই জীবনের একটি দুঃখজনক ঘটনা শেয়ারের মাধ্যমে আমি আজ তা প্রথমবারের মত আমার টাইমলাইনে প্রকাশ করছি। যা আমি গত ২০১৬ সালে Justice for Women নামক একটি গ্রুপে লিখেছিলাম এবং লেখাটি ভাইরাল হয়েছিল। হয়ত অনেকেই পড়েছেন কিন্তু কারওই জানা নেই লেখাটি যে আমার ছিল।

আজ বাবা দিবসে নিজে বাবা না হওয়ার সেই বিষয়ের লেখাটি হুবহু তুলে ধরলাম। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম সেই অনেক বছর আগে। বিয়ের ৩ বছর পর আমার স্ত্রী গর্ভধারণ করে। কিন্তু ৩ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরেও সন্তানের কোনো হার্টবিট আসে না। যার দরুন ডাক্তার বাধ্য হয় ডিএনসি করতে। যা হোক আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই কিন্তু কয়েক বছর পার হলেও কিছুই আর সম্ভব হয় না। এরই মাঝে টেস্ট করে ধরা পড়লো স্ত্রীর ইউটেরাসে টিউমার দেখা দিয়েছে। অনেকগুলো হওয়াতে ডাক্তার পরামর্শ দিলেন অপারেশন করতে হবে।

ঢাকার বড় বড় ডাক্তার খুঁজে ডিসিশন নিলাম স্কয়ার হাসপাতালে বসেন নার্গিস ফাতেমা নামের এক ডাক্তার। তার হাতেই করাবো অপারেশন। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ডা. নার্গিস ফাতেমাকে দেখালে তিনিও বললেন ইউটেরাস সেইভ রেখে টিউমারগুলো রিমুভ করবেন।

তিনি বললেন, এটি একটি প্যাকেজের মাধ্যমে সেখানে করা হয় যা সবকিছু দিয়ে পয়ষট্টি হাজার টাকা খরচ লাগবে। আমি রাজি হলাম এবং স্ত্রীকে ভর্তি করলাম কিছুদিন পর। অপারেশন ভাল করলেন অনেক সময় নিয়ে। ডাক্তার আমাকে টিউমারগুলো দেখিয়ে বললেন অনেক টিউমার ছিল যা রিমুভ করতে অনেক সময় লেগেছে এবং রুগী এখন ভাল আছে, তবে একরাত পোস্ট অপেরেটিভ কেয়ার ইউনিটে থাকতে হবে।

অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়াতে আমি বিকালে দেখতে সেই রুমের সামনে গেলাম। সিকিউরিটিকে অনুরোধ করলে আমাকে রুমে ঢুকতে দিল। কিন্তু গিয়ে দূর থেকে দেখি এ কি অবস্থা! আল্লাহ্ শেষবারের মত দেখাতেই হয়ত আমাকে ওখানে নিয়েছিলেন।

ডিউটিরত ডাক্তার ও সিষ্টার সব কাউন্টারে বসে আড্ডা দিচ্ছে অথচ রুগী ওখানে মৃত্যুশয্যায় হাত নেড়ে নেড়ে ডাকছে তা কেউ শুনছে না। যেন গরু জবাই করে ফেলে রেখেছে। আমার স্ত্রীর শরীর সাদা হয়ে গিয়েছে। আমি চিৎকার করে ডিউটি ডাক্তার ডাকতে তারা এসে ব্লাড প্রেসার মেপে দেখে প্রেসার ৩৫ এ নেমে গিয়েছে। সাথে সাথে ডা. নার্গিস ফাতেমা খবর পেয়ে এসে হাজির।

তিনি এই অবস্থা দেখে ডিউটি ডাক্তারের উপর চোখ গরম করলেন কিন্তু আমি থাকাতে কিছু না বলে দ্রুত ICU তে নিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন যত দ্রুত এবং যত ব্যাগ পারেন রক্ত সংগ্রহ করেন এখনই। আমি পাগল হয়ে গেলাম। ICU তে ডাক্তার ব্লাড প্রেসার বাড়াতে চেষ্টা চালিয়ে গেল এবং সবাই বোর্ড মিটিংয়ে বসে গেলেন।

আমি ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করতে থাকলাম। রাতে ডাক্তার আমাকে ICU তে ডাকলেন এবং বললেন রুগীর টিউমার রিমুভ করার স্থান গুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না এ জন্য ব্লিডিং হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বললেন যেন তাকে বাঁচানো যায়। আমি আমার স্ত্রীর হাত ধরে বলে আসলাম তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে যাবই। সারারাত কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করতে থাকলাম সৃষ্টিকর্তার নিকট।

রাত থেকে রক্ত দিচ্ছে অথচ তা বের হয়ে যাচ্ছিল। এভাবে ১১ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়ে গেল। ডাক্তাররা আবার আমাকে ডাকলেন এবং বললেন তাকে আবার অপারেশন করতে হবে এবং পুরো ইউটেরেসটি ফেলে দিতে হবে। যার কারণে আমার স্ত্রী আর কোনদিন মা হতে পারবেন না।

আমি সাথে সাথে ডাক্তারকে কাগজে সাইন দিয়ে বললাম আপনি ফেলে দেন আমার বাচ্চার দরকার নাই। আবার অপারেশনে ঢুকালো। সর্বমোট আমি ১৮ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে ক্রসম্যাচ করেছিলাম। অপারেশন হলো এবং ICU তে তিন দিন রেখে বেডে দিল। আল্লাহর রহমতে তখন কিছুটা ভাল।

আমাদের রুমের মাঝে পর্দা দেওয়াসহ তখন পাশে আর একজন রুগী ছিলেন। এক আমার স্ত্রী আর অন্যজন সে দিনই বাচ্চা হওয়া এক ভদ্রমহিলা। একজন মা হলেন আর অন্যজন চিরতরে মা হওয়া থেকে বঞ্চিত হলো একই রুমে শুয়া। নির্মম সেই মুহূর্ত কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের পাশের রুগী যখন জানতে পারল আমার স্ত্রীর এই সমস্যার কথা।

সাথে সাথে পর্দার এপাশ থেকে শুনতে পেলাম সিস্টারকে ফোন করে বলছে তাকে এই রকম রুগীর কাছে কেন রাখা হয়েছে? তার বাচ্চার নাকি ক্ষতি হবে। শুনেও আমরা না শুনার ভান করলাম। তিনি দ্রুত রুম ছেড়ে অন্য কেবিনে চলে গেলেন।

এর তিন দিন পর যখন কাউন্টারে বিল দিতে গেলাম তখন দেখি আমার পয়ষট্টি হাজার টাকার প্যাকেজের বিল দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ টাকা। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। যাদের অবহেলার কারণে আমাদের এত বড় ক্ষতি হলো আবার তারা টাকাতে একটুও ছাড় দিলো না।

আমি স্কয়ার হাসপাতালের অপারেশন হেডের কাছে গেলাম ও তাকে সব খুলে বললাম। তার নিকট দরখাস্ত দ্বারা আবেদন করলাম আমাকে কিছু টাকা যেন মওকুফ করা হয়। কিন্তু তিনি মোটেও শুনলেন না।

তিনি ডাক্তার নার্গিস ফাতেমাসহ অন্য ডাক্তারদের ডাকালেন এবং সকল বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে আমাকে বললেন, আপনার স্ত্রীকে বাঁচানো গিয়েছে এটাই বড় কথা আর মৃত্যুশয্যা যাওয়াতে তাদের নাকি কোন দোষ ছিল না। আমি ওদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফ্যামিলির কাছ থেকে কোনো সাপোর্ট পেলাম না। সবাই বললেন আল্লাহ কপালে রেখেছেন এখন আর কি করার!

স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের টোনাটুনির সংসারের অনেক বছর পার হয়ে গেল। দুজনই কর্মজীবনে ব্যস্ত। দিন শেষে ঘরে ফিরি। আর মন খারাপ রোধ করতে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াই। দেশ কিংবা সমাজের অনেককেই দেখি মেয়েদের সন্তান না হওয়ার কারণে স্বামী তালাক দিতে চায় কিংবা দিয়ে দেয়। আমি সেই সমস্ত পুরুষদের বলতে চাই, স্ত্রীকে সবার আগে ভালোবাসুন তারপরে অন্য সব চাওয়া পাওয়া।

একজন স্ত্রী শুধুমাত্র সন্তান পয়দা দেওয়ার মেশিন নয় যে তা দিতে না পারলে আপনি তাকে ছেড়ে দিবেন। সন্তান আল্লাহ্ দিয়ে থাকেন। তিনি যেমন দিতে পারেন তেমনি নিতেও পারেন। এখানে কারও কোনই হাত নেই।

সবার আগে সংসারে সুখ। একটি সুখি সংসার বেহেস্তের বাগান স্বরূপ। আর পৃথিবীটা থাকার জায়গা না। আমরা কেউই থাকবো না। কেউ আজ কেউ কাল। সব কিছুই পড়ে রবে তবে কেন আমাদের এত চাওয়া পাওয়া?

এভাবে দিন চলে যায়

জীবন থেকে সময়

হারিয়ে যায় স্বপ্ন গুলি

স্মৃতি শুধু পড়ে রয় !!

জগতের এইতো রীতি

একদিন হবে যে ইতি

সুখে দুঃখে কেটে যাবে

মানুষ নামের দেহ বাতি!!

মিঞা মিজানুর রহমান কাজলের ফেসবুক থেকে নেয়া

এমএস/