ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

আব্বা আমাদের ক্ষমা করবেন

তাহমিনা আক্তার

প্রকাশিত : ১২:১৭ এএম, ১৭ জুন ২০১৯ সোমবার

বাবার কথা লিখবো কিন্তু কীভাবে লিখবো, কী লিখবো সেটাই বুঝতে পারছি না। একসঙ্গে বাবার অনেক স্মৃতি চলে আসছে, কোনটা রেখে কোনটা বলবো। তারপর আমি তো লেখক বা সাংবাদিক নই যে সাজিয়ে গুছিয়ে লিখবো। আমার বাবার নাম আবু ছফা। তিনি এখন আমাদের মধ্যে নেই। আমরা আব্বা ডাকতাম। আমার আব্বা খুব বিখ্যাত বা অসাধারণ কেউ ছিলেন না। তবে মানবিক গুণাবলীতে ছিলেন অসাধারণ-অনন্য একজন মানুষ। অন্যের কষ্টে তিনি ব্যথিত হতেন। নিজের সর্বস্ব নিয়ে এগিয়ে যেতেন।

জীবনের দীর্ঘ সময় তাকে আমরা কাছে পাইনি। সে এক অন্যরকম গল্প। আমার আব্বা ছিলেন আমেরিকা প্রবাসী। নব্বইয়ের দশকে তিনি আমেরিকা পাড়ি জমান। স্বপ্নের আমেরিকা আমাদের পরিবারের আরাম-আয়েশ বাড়িয়ে দিলেও আব্বার স্নেহ-আদর থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে আদর স্নেহ আমি যা পেয়েছি আমার ছোট দুই বোন ও একমাত্র ছোট ভাই বঞ্চিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। আব্বা প্রায় প্রতিদিন সকালে ফোন দিতেন। সেটা অবশ্য ১৯৯৫ সাল থেকে। তখন আমাদের বাসায় ফোন ছিল না। বাড়িওয়ালা চাচীদের বাসায় ফোন আসতো, দীর্ঘ সময় নিয়ে তিনি আম্মা এবং কখনো আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। কখনো নিজের সমস্যা বা অসুস্থতার কথা বলতেন না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের নানা বিষয় নিয়ে খোঁজ-খবর নিতেন। আব্বা প্রায় অসুস্থ থাকলেও সেটা আমাদের তেমন বলতেন না। শেষের দিকে অর্থাৎ মৃত্যুর আগে আব্বা প্রায় হাসপাতালে থাকতেন। কাজ করতে পারতেন না। তবুও আমাকে ফোন করে লম্বা সময় নিয়ে আমার মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেন। আমার ছোট মেয়ে তাসপিয়াকে তিনি দীপুমণি বলে ডাকতেন।

আম্মা মারা যাওয়ার পর আব্বা যেন আরো বদলে গেলেন। অন্যরকম অপরাধবোধে তিনি আম্মার জন্য কাঁদতেন। আম্মার বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করতেন। শেষদিকে আব্বা যখন অনেক অসুস্থ তখন আমরা তাকে দেশে নিয়ে আসলাম অনেক জোর করে। তিনি আসতে রাজী ছিলেন না। কারণ আমাদের কষ্ট দিতে চান না তিনি। আমেরিকায় ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি আর চার সপ্তাহ বাঁচবেন। আমরা অনেকটা জোর করে এনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে প্যালিয়াটিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করলাম। কিন্তু তিনি হাসপাতালে থাকতে চান না।

একবার তিনি ডাক্তারকে বললেন, আমেরিকার ডাক্তার বলেছে চার সপ্তাহ বাঁচব। আপনারা আমাকে ভালো করতে পারবেন না। ইতোমধ্যে এক সপ্তাহ শেষ হয়ে গেছে, আর বাকী আছে তিন সপ্তাহ। এখন আমি হাসপাতলে থাকলে আমার মেয়ের এবং আমার বেয়াই-বেয়াইনদের কষ্ট হয়। এখানে বলে নিচ্ছি তখন আমাদের বাসায় আমার খালা শাশুড়ী প্রায় প্যারালাইজড এবং শাশুড়ীও অনেক বৃদ্ধ নানা রোগে আক্রান্ত। ডাক্তার আমাদের বুঝিয়ে বলতে লাগলেন এরকম মানুষকে এখানে আটকিয়ে রেখে কোন লাভ হবে না, বাসায় নিয়ে যান। শেষ সময়ে আমি আব্বাকে দেখেছি একেবারে স্বাভাবিক, স্থির । এ যেন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা, কখন আসবে ....।

অসুস্থ শরীরে কষ্ট হলেও ভীতি বা হতাশা তাকে পেয়ে বসেনি। শেষ দিকে এসে নামাজ পড়তে সক্ষম না হলেও যিকির বা দোয়া ইউনুস বা সূরা পড়া সবকিছুই তিনি সচেতনভাবে পড়ছেন। মৃত্যুর সময়ও তিনি স্বাভাবিক। এ যেন সেরকম সমর্পণ- আমি আমার শেষ গন্তব্যে, আমার পরম প্রভুর কাছে ফিরে যাচ্ছি। আমার কোন অভাব অভিযোগ নেই, ক্ষেদ ক্ষোভ নেই।

সারাজীবন আব্বাকে এরকমই দেখে এসেছি- মানুষের জন্য, আত্মীয়-স্বজনের জন্য, পরিবারের জন্য সচেতন সবসময় সচেতন। কার কী লাগবে, তিনি সবার আগেই এগিয়ে যেতেন। কিন্তু নিজের ব্যাপারে একেবারেই সচেতন বা গুরুত্ব দিতেন না। সারাজীবন এভাবেই তিনি কাটিয়েছেন। আমরা আব্বার জন্য কিছুই করতে পারিনি। আজ সন্তান-সংসার নিয়ে সুখে থাকলেও আব্বা-আম্মার জন্য কিছু করতে পারলে সান্ত্বনা পেতাম। এখন মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমার আব্বা-আম্মাকে জান্নাতবাসী করেন। অন্য কোনদিন আব্বা-আম্মাকে নিয়ে লিখব। আজ শেষ করছি।

এসি