ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ হয়ে ওঠার গল্প

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৪:২৩ পিএম, ১৭ জুন ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৫:৩৯ পিএম, ১৭ জুন ২০১৯ সোমবার

রিশান মাহমুদ রনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ও পারফরম্যান্স বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সংবাদ পাঠক হিসেবে কাজ করছেন।

অনেকের কাছে সেই রিশান মাহমুদ রনির পরিচিতি এখন ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ হিসেবে।

২০১৫ সালে রনির হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ নামে একটি অনলাইন ফ্যাশন শপ। শূন্য হাতে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটির পরিধি ধীরে ধীরে বেড়েছে।

শুরুটা হয়েছিল মাত্র সাতটি পাঞ্জাবি দিয়ে। নাট্যকলার ছাত্র হওয়ায় ডিজাইনের বিষয়টা সেখান থেকেই রপ্ত করেছেন রনি। নাটকের প্রত্যেকটা চরিত্রের বিভিন্ন দিক ধরে ধরে একটা সময় কসটিউম ডিজাইন করতে হতো তাকে।

উদ্যোগ শুরু

ঘটনাটা ২০১৫ সালের, পহেলা বৈশাখের। রনি ও তার সাত বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করলেন একই ডিজাইন থাকবে, কিন্তু সাতজন সাত রঙের পাঞ্জাবি পড়বেন। আর সে সাতটি পাঞ্জাবি তৈরি করে দেন রনি নিজেই। এরপর তারা সে পাঞ্জাবিগুলো পড়ে বৈশাখে ঘুরে বেড়ান। ছবিও তোলেন হরদম।

বাসায় ফিরে ছবিগুলো ফেসবুকে আপলোড করেন রনি। তারপর থেকেই তাকে অনেকে জিজ্ঞেস করতে থাকে পাঞ্জাবিগুলো কোথা থেকে কেনা হয়েছে। সে সময় ১০০টিরও বেশি পাঞ্জাবির অর্ডার পান রনি। স্বপ্নগুলোও ডানা মেলতে থাকে।

একটি অর্ডার রনির চিন্তা-ভাবনায় বড় প্রভাব ফেলে। সে সময় থেকে দিনের বেশির ভাগ সময় ফেসবুকে সময় কাটাতেন তিনি। কারো ছবি, পোস্টে লাইক, কমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকা হতো তার। তার ভাবনায় এলো, শুধু শুধু ফেসবুকে থেকে লাভ কী। যদি ওখানেই সময় দিয়ে কিছু করা যায়, সেখানে তো কোনো সমস্যা নাই। এরপর পাঞ্জাবিওয়ালার চিন্তাটা আসে।

নামকরণ হলো যেভাবে

শুরুতে অনলাইন ব্যবসা সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না রনির। এক বন্ধুর মাধ্যমে ফেসবুকে একটি পেজ খোলার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু নাম নিয়ে পড়ে গেলেন দ্বিধায়। বেশ কিছুদিন ভাবার পর একটা বিষয় তার মধ্যে কাজ করল, যেহেতু পাঞ্জাবি নিয়ে কাজ করবেন, তাই নামটা ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ হলে মন্দ হয় না। এরপর এ নামেই পেজটি খুলেন তিনি। তখন থেকেই একটু একটু করে এগিয়ে চলা।

সময়ের সঙ্গে পাঞ্জাবিওয়ালার পরিধি বড় হতে থাকে। কিন্তু ক্রেতাদের কাছে পাঞ্জাবি পৌঁছানোর বিষয় নিয়ে তৈরি হলো জটিলতা। প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরুর কিছুদিন আগেই একটি বাইক কিনেছিলেন রনি। শুরুর প্রায় এক বছর রনি নিজেই ক্রেতাদের বাসায় গিয়ে অর্ডার অনুযায়ী পাঞ্জাবি বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতেন। কিন্তু এটা নিয়ে রনির মধ্যে কোনো ধরনের সংকোচ ছিল না।

উৎপাদন থেকে বিপণন

রনি বলেন, ‘ডিজাইন মাস্টার শুধু কাটিং করে আর সেলাই করে। এছাড়া সব ধরনের ক্রেতারা যাতে পণ্যটি কিনতে পারেন, সেভাবেই মূল্য নির্ধারণ করে থাকি। যখনই আমি দেখলাম, ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছি, তখনই ভাবলাম পুরো কাজটা আমি একা করতে পারলেই ভালো। এখন প্রত্যেকটা অকেশনের (উপলক্ষ্য) আগে আমার একটা প্ল্যানিং থাকে।’

অনলাইনে ব্যবসা করতে এসে বেশ কিছু খারাপ অভিজ্ঞতাও হয়েছে রনির। দেখা গেছে, তার পণ্যের ছবি নিয়ে লোগে তুলে আরেকজন তার পেজ থেকে শেয়ার করে লিখেছে, ‘এই ধরনের প্রোডাক্ট পেতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’

রনি বলেন, তারা তাদের ডিজাইন ও প্রোডাক্ট বলে চালিয়ে দিচ্ছে। আমি মনে করি, এটা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের খারাপ দিকের একটি।

তিনি বলেন, আবার এমনও হয়েছে, অনেকগুলো পণ্য অর্ডার করার পর কোনো নোটিশ ছাড়াই ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশে অনলাইনে ব্যবসায়ী ও ক্রেতা-দুই দিক থেকে একে অপরের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। মার্কেটটাও সেভাবে বড় হচ্ছে না।

ব্যবসায়ের শুরুতে রনি ভেবেছিলেন পাইকারি কিছু কাঁচামাল কিনে এনে পোশাক তৈরি করে তারপর তিনি বিক্রি করবেন। পরে একটা সময় গিয়ে ভাবলেন, ‘পাইকারি আমি কয়টা আনতে পারব?’ এই চিন্তুা থেকে তিনি পাইকারের কাছ থেকে পণ্য কেনা বাদই দিয়ে দিলেন। তখন রনির কাছে মনে হলো, তিনি যে ডিজাইন করবেন, সেটা হবে অনন্য, যাতে তিনি সারা বছর যে কাউকে পছন্দের পোশাক সরবরাহ করতে পারেন।

উদ্যোক্তা হওয়ার নেপথ্যে

প্রথাগত চাকরির দিকে না গিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখলেন কেন জানতে চাইলে রনি বলেন, ‘কম-বেশি সবাই তো বলে জব করি। মানে একটা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আপনি আরেকজনের বিজনেসকে দেখছেন। আমার মনে হয়েছে, ছোট্ট হোক, তবে আমি নিজেই করি। আর এখন আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে বলেই মানুষ আমার কাছ থেকে প্রোডাক্ট কিনছে।

আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি এমন একটা কাজ করব, যেটার সাইন আমিই থাকব। আগে আমি ট্রেইলার থেকে অর্ডার দিয়ে এক কিংবা দু’পিস বানাতাম। কিন্তু এখন সে শুধু আমার কাজই করে। তারা আমার ওপর ডিপেডেন্ট।

চাকরির পাশাপাশি ব্যবসার দেখাশোনা করাটা খুব কঠিন হয়ে যেত রনির জন্য। তারপরও পিছু ফিরে যাননি।

এ বিষয়ে রনি জানান, সাহসটা করতে হয়। আমি বিশ্বাস করি, যে যেই কাজই করুক না কেন, তার ডেডিকেশন থাকলে, সে ফিডব্যাক পাবেই। আগে আমি বিভিন্ন ব্যান্ডের পোশাক পড়তাম। এখন আমি নিজে নিজের পোশাক তৈরি করে পড়ি।

ভবিষ্যতে শো-রুম নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে রনির। তার ভাষ্য, ‘পাঞ্জাবিওয়ালার বসার একটা জায়গা হবে। এটা দারুণ একটা বিষয় হবে। আলাদা একটা ব্র্যান্ড হিসেবে চিনবে মানুষ।’

এ বিষয়ে রনি জানান, নিজের পোশাকের ব্যাপারে আমি খুব খুঁতখুঁতে। পোশাক নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজের মতকেই প্রাধান্য দেই। আলাদা একটা বৈচিত্র্য পোশাকে থাকা চাই-ই। আর সে কারণেই তার বন্ধুরা বিভিন্ন উপলক্ষ্যে আসার আগেই আমাকে বলত, শার্ট কিংবা পাঞ্জাবি ডিজাইন করে দেওয়ার জন্য।

বাসায় বাসায় গিয়ে পাঞ্জাবি দেয়ার বিষয়ে রনি জানান, আমি দেই বিধায়, যারা আমার কাস্টমার, আমি অনলাইন বিজনেস করলেও তাদের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তৈরি হয়ে গিয়েছে।

রনি বলেন, আমি মনে করি, এটা আমার ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এই অবস্থানে আসার জন্য অনেকটাই সহযোগিতা করেছে। আমি শুধু সেলাই করতে পারি না। এ ছাড়া কাপড় কেনা থেকে শুরু করে সবই আমাকে করতে হয়।