সন্দেহ সুখী জীবনের অন্তরায়
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৮:১৪ পিএম, ১৮ জুন ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৪:৫৫ পিএম, ১৫ জুলাই ২০১৯ সোমবার
ছোট একটি শব্দ। কিন্তু তার ক্ষমতা অনেক। কেঁড়ে নিতে পারে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো। বাঁধিয়ে দিতে পারে একে অপরের মধ্যে কলহ। পরিবারকে নিতে পারে ধ্বংসের কিনারে। ধাবিত করতে পারে মৃত্যুর দিকে। নানা অঘটনের ঘটক হলো সন্দেহ।
দাম্পত্য জীবন সুখময় হয়ে উঠে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মান ও সহমর্মিতার উপর নির্ভর করে। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, ভালবাসা ও সহানুভূতি যত গভীর হয়, দুজনের বন্ধনটাও তেমন দৃঢ় হতে থাকে। আর যখনই এই বিশ্বাস ও ভালবাসার বদলে অনুপ্রবেশ করে অবিশ্বাস বা সন্দেহ তখনই দুজনের মধ্যে বাড়তে থাকে দুরত্ব। যার ফলাফল দাম্পত্য কলহ, নির্যাতন এবং অবশেষে পারিবারিক ভাঙন।
আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে জীবন গতিশীল হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুকের জন্যে বাড়ছে পরিচিত মণ্ডল। বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় সম্পর্ক। বাড়ছে নেতিবাচক আবেগ ও অনুভূতি। যা নানা সম্পর্কের পাশাপাশি টানাপোড়েন সৃষ্টি করছে বৈবাহিক সম্পর্কেও।
তিল তিল করে গড়ে ওঠা সুখ নিঃশেষ করার জন্যে সন্দেহই যথেষ্ট। সন্দেহ বিভিন্ন রূপে আমাদের সম্পর্কে অনুপ্রবেশ করে। এটা কারো কারো মধ্যে থাকে স্বাভাবিক পর্যায়ের। আবার কারো মধ্যে প্রকাশ পায় অস্বাভাবিক অসুস্থতা রূপে। এখন জেনে নিই কী কারণে স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং এর সহজ সমাধান:
পারস্পরিক সম্মান: বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রী একটি অভিন্ন সংসার জীবনে প্রবেশ করলেও প্রত্যেকেরই রয়েছে পৃথক ব্যক্তিসত্ত্বা, পৃথক চিন্তা-ভাবনা, পৃথক চাওয়া-পাওয়া। যখন এই পৃথক সত্ত্বাটির প্রতি পারস্পরিক সম্মান ও বোঝাপড়া থাকে না এবং ছাড় দেয়ার কোন মানসিকতা গড়ে উঠে না তখনই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্টি হয় সন্দেহ।
যেমন স্ত্রীর ব্যাপারে স্বামীদের অতিরিক্ত অধিকারবোধ— এটাকে কোনো কোনো স্ত্রী যেমন অপছন্দ করেন, তেমনি অনেক স্ত্রী আছে পছন্দও করেন। স্বামীর একটু মনোযোগের অভাব হলে তাদের খেদের কোনো শেষ থাকে না। আবার কোনো বিষয়ে স্বামীর অতিরিক্ত প্রশ্ন, বিধি-নিষেধকে স্ত্রী প্রথমে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, পরে সন্দেহ করা হচ্ছে বলে আক্ষেপ করেন।
যদি স্বভাবগত ভাবে স্বামীর আচরণে এই বাড়াবাড়ি প্রকাশ পায়। তবে সংসারে শান্তির জন্য স্বামীর এই আচরণকেই উৎসাহিত করুন। তাহলে তিনি নিশ্চিত হবেন যে, সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। এ অবস্থায় সন্দেহের পরিবর্তে সহানুভূতির সৃষ্টি হবে। উভয়েরই পথ চলা সুন্দর হবে।
অবস্থানগত সমস্যা : কর্মস্থলে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুসম্পর্ক তৈরির ভিত্তিতে নারী পুরুষ সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাঞ্চনীয়। কিন্তু অনেক দাম্পত্য জীবনে এটা হয়ে উঠে অশান্তির কারণ। অনেকের মধ্যে সন্দেহবাতিক রয়েছে। তারা স্ত্রীকে বা স্বামীকে নিজের সম্পত্তি মনে করেন এবং অন্য কারো সঙ্গে কথা বলাটাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। আর এই সন্দেহের পেছনে থাকে না কোনো যৌক্তিক কারণ বা প্রমাণ। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ।
কর্মস্থান থেকে ফিরতে দেড়ি হচ্ছে। এটা কিন্তু স্বাভাবিক ব্যাপার। তারপরও অনেকে এর জন্য দুশ্চিন্তা করেন, অস্থির হয়ে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত সন্দেহ করতে থাকেন। এই ব্যাপারগুলো উভয়কেই উপলব্ধি করতে হবে। দূরে আছেন ফোনের মাধ্যমে আপনাদের অবস্থান জানিয়ে দিন। একে অপরকে আশ্বস্ত করুন।
স্ত্রী পড়াশোনা করতে গিয়ে অন্য কারো সম্পর্ক গড়ে উঠে কিনা অথবা স্বামী চাকরি করতে গেলে কলিগ সঙ্গে ভাব হয় কিনা। এ রকম উদ্বেগ সন্দেহ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এজন্যে উভয়কেই নিজ নিজ স্থান থেকে সচেতন হতে হবে। কারণ ঘরে অশান্তি করে আপনি সুখী হবেন না। তাই সম্ভব হলে এই সম্পর্কগুলোকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলুন। কাজের প্রয়োজনে যদি কথা বলতে হয় তবে সবার সামনে কথা বলুন।
এই সন্দেহবাতিক যাদের আছে তারা নিজের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে সুযোগমতো নিজের অবস্থানকে পরিস্কার করুন। দেখবেন তখন সন্দেহের বদলে স্থান করে নিচ্ছে স্বচ্ছতা।
অতীতের সর্ম্পক : বিয়ের আগে স্বামী বা স্ত্রী যে কারো প্রেমের সম্পর্ক বা গোপন বিষয় থাকতেই পারে। কিন্তু বিয়ের পরে উভয় পক্ষই যদি এই বিষয় অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেন তবে সেটা শুধু জটিলতা সৃষ্টি করবে। বর্তমান ও ভবিষ্যতকে ঘিরেই দু’জনের সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে। অতীতকে নিয়ে নয়। তাই অতীতে কি হয়েছে এসব নিয়ে কারোই মাথা ঘামান উচিত না। এমনকি এগুলো পরস্পরকে বলারও কিছু নাই। অতীত সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হওয়া যায় না, এগুতে হবে ভবিষ্যত ঘিরে।
এরপরও যদি আপনি কিছু জেনে থাকেন বা শুনে থাকেন বা সন্দেহ তৈরি হয়ে থাকে, তবে এটা নিয়ে অগ্রসর হওয়া মানে নিজের হাতে নিজের সুখী হওয়ার সুযোগকে সীমিত করে ফেলা। তাই এক্ষেত্রে ক্ষমা করে দেয়াটাই আপনার জন্যে ভালো হবে। আর বর্তমান অবস্থাকে প্রাধান্য দিন।
নেতিবাচক চিন্তা : স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুধু ভালবাসা থাকলেই যে সংসারের বন্ধন দৃঢ় হবে সেটা কিন্তু নয়। অনেকসময় পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে যে কোনো একজনের মনে অপরজনকে নিয়ে জন্ম নিতে পারে ভয়, ঈর্ষা অথবা হীনম্মন্যতা । এহেন নেতিবাচক আত্মধারণা পরবর্তীতে সন্দেহ রূপে প্রকাশ পায়, যা মানসিক যন্ত্রণা দেয় দুজনকেই।
নেতিবাচক আবেগে মন তিক্ত হওয়ার আগে সুযোগ বুঝে সরাসরি কথা বলুন। যদি তার কোনো অক্ষমতা থাকে সেটা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করুন। সঙ্গীনির ভালো দিকগুলো তুলে ধরুন। এতে তিনি ভুল সংশোধনে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। একে অপরের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে শিখুন। কারণ পারিবারিক সমৃদ্ধির জন্যে সামনে এগুতে হবে আপনার জীবনসঙ্গীকে সঙ্গে নিয়েই।
স্বামী/ স্ত্রী যদি কোনো নেতিবাচক আবেগে আক্রান্ত হয়েও থাকেন। তবে আপনি তার সাথে সম্পূর্ণ ইতিবাচক ব্যবহার করুন। আপনার সঙ্গী যে আপনাকে কত ভালবাসে এটা সবসময় আকার ইঙ্গিতে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করুন।
তৃতীয় পক্ষ : দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে তৃতীয় পক্ষের প্রভাব। অথবা স্বামী স্ত্রীর ভুল বুঝাবুঝির জন্য তৃতীয় পক্ষকে (আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী) জড়ানো হয়। এই বিষয়টিও সুখের সংসারে সন্দেহ হয়ে ঘর বাধে এবং ধীরে ধীরে ভয়াল ব্যধির মতো নিঃশেষ করে দিতে চায় মধুর স্মৃতিগুলোকেও।
তাই সম্পর্কের জটিলতায় সবসময় সরাসরি কথা বলুন। কাউকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবেন না। কারণ সর্ম্পক যত সরাসরি হবে, ভুল বুঝাবুঝি তত কম হবে।
আত্মউপলব্ধি : স্বামী/ স্ত্রী যে কারো এটা হতে পারে যে, তিনি তার এই প্রিয় মানুষটিকে অহেতুক সন্দেহ করেন। এটা যে সঠিক হচ্ছে না সেটা বুঝতেও পারেন। কিন্তু কোনোক্রমেই সন্দেহের জাল থেকে বের হতে পারেন না। পরবর্তীতে এই নিয়ে তার মনে একটা কষ্ট এবং এ থেকে অনুশোচনা সৃষ্টি হয়।
আসলে একে অপরকে যদি সবচেয়ে ভালো মানুষ হিসেবে ভাবতে না পারেন আপনি কখনো সুখী হতে পারবেন না। আমার স্ত্রীর জুড়ি নেই সব পুরুষেরই এমনটা ভাবা উচিত। একইভাবে প্রত্যেকটা স্ত্রীর ভাবা উচিত- আমার স্বামী হচ্ছেন পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো মানুষ।
দাম্পত্য জীবনে দুরত্ব সৃষ্টি করবে এমন কোন নেতিবাচক আবেগ কারো কাম্য নয়। তাই আসুন এই মধুময় সর্ম্পকগুলো যেন নিজ নিজ সৌর্ন্দযে অটুট থাকে সে জন্যে সচেতন হই। মানবিক আবেগকে জাগ্রত করে গড়ে তুলি শান্তি সুখের নীড়।
এএইচ/টিআর/