ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

‘ভারত ও বাংলা ভাগ’ ভিতর-বাহির

রকিবুল হাসান

প্রকাশিত : ০৭:২৯ পিএম, ১৯ জুন ২০১৯ বুধবার

ভারতীয় উপমহাদেশে ধন-সম্পদ লুণ্ঠন আর ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা সময়ে দস্যুপ্রবৃত্তিমনা বিভিন্ন বণিকদল এসেছিল। অস্ট্রিক-দ্রাবিড়দের সময়কাল থেকে শুরু করে ইংরেজ শাসকদের সময়কাল পর্যন্ত এ-চিত্র ও উদ্দেশ্য অভিন্ন। এদের মধ্যে হিংস্রতা থেকে শুরু করে কূটকৌশল সব ধরণেরই আচরণ ছিল।

এ দেশের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন আর ভোগ করাই তাদের কাছে প্রধান ছিল। দেশটাকে নিজের মনে করে গ্রহণ করেনি কেউই। ব্যতিক্রম ঘটেছে শুধু তুর্কি ও মুঘোলদের সময়কালে। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে বাংলা ভূখ- ছিল ধন-সম্পদ ও কৃষি পণ্যসামগ্রীতে পূণ্যবতী। আর এসবই হয়েছিল ভারতবর্ষের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ।
‘অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরি’ চর্যাপদের বহুল পরিচিত এই পংক্তি যেন রীতিমতো ফলেছিল ভারতবর্ষের ললাটে। হরিণ যেমন তার নিজের সুস্বাদু মাংসের জন্যই নিজেই নিজের বিপদের কারণ, নিজের জীবন বিপন্ন হয়, ভারতবর্ষের অবস্থাও তাই ছিল। ভারত তার নিজের রূপ-ঐশ্বর্য্য-অর্থ-সম্পদ-প্রাচুর্য্যরে জন্য বারবার বহিরাগতদের লোভ আর হিংস্রতার শিকার হয়েছে।

দীর্ঘকাল ভারতকে পরাধীনতার নির্মম ও করুণ পরিণতি বহন করতে হয়েছিল। ভারতবর্ষের পরাধীনতা ও স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে। ভারতবর্ষ প্রকৃত অর্থে কোন সময়কাল থেকে পরাধীনতার শৃঙ্খল পরেছিল, কিভাবে সেই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কারা চেষ্টা করেছিল, কোন নেতাদের প্রধান ভূমিকা ছিল, সে সব নেতারা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে কিভাবে নিজেদের ভূমিকা পরিবর্তন করেছিল, লেবাসধারী ভূমিকা গ্রহণ করে সাধারণ মানুষের তৈরি আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে নেতৃত্ব হরণ করেছিল, ভারতকে অখন্ডভাবে স্বাধীন করার প্রত্যয়ে কারা অন্দোলন সংগ্রাম বিপ্লব করেছিল, আবার তারাই কিভাবে নিজেদের ভূমিকা পরিবর্তন করে নিয়েছিল, কারা বাংলা ভাগের বিপক্ষে জোরালো প্রতিবাদ করেছিল, আবার সেই তারাই কত সহজেই বাংলা ভাগ মেনে নিলেন বা আর এক অর্থে বাংলাকে ভাগ করলেন।

এর মূলে ধর্ম বা দ্বিজাতিতত্ত্ব, ব্যক্তি ক্ষমতা ও স্বার্থ কতোটা প্রবল ও হিংস্রতার থাবা ছিল। সুভাষ চন্দ্র বসুর মতো মহান নেতা যিনি দৃঢ়পত্যয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অখন্ড ভারতের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, তাকে কতোভাবে গান্ধী-নেহেরু-জিন্নাহর কূট ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছিল। এমনকি দেশ ত্যাগের মতো দুর্ভাগ্যের নির্মম পরিণতি বহন করতে হয়েছিল অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বকাঁপানো মহান নেতাজিকে। দেশের স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবী বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম বসু, রাশবিহারী বসু, শহীদ তিতুমীর, মাস্টার দা সূর্যসেন, প্রীতি লতাসহ অসংখ্য বিপ্লবী যে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন, রক্ত সোপানে লিখে দিয়েছিলেন নিজের জীবন।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অগ্নিস্পর্ধিত কবিতা লিখে জেল খেটেছেন একমাত্র বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সব মিলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার প্রয়াস, একই সঙ্গে দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাকে ভাগ করে ফেলা। এসবের অসামান্য এক দালিলিক সুবৃহৎ গ্রন্থ ‘ভারত ও বাংলা ভাগ: এক বিয়োগান্তক অধ্যায়’। গ্রন্থটি রচনা করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ। তাঁর অক্লান্ত শ্রমসাধ্য এই গ্রন্থটি গতানুগতিক ও প্রচলিত বহু ধারণাকে সরিয়ে আলোর মতো পরিষ্কার করে দিয়েছে ভারতবর্ষ কিভাবে স্বাধীন হয়েছিল। ভারতবর্ষকে কিভাবে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল, কিভাবে বাংলার বুকে স্বার্থের নীতি ও বিবেকহীন ছুরি চালিয়ে তা ভাগ করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে অযৌক্তিকভাবে যুক্ত করে যে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, সেটিও তেইশ বছরের মাথায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দ্বিখণ্ডিত হয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

এই গ্রন্থটি পাঠকের কাছে ভারতবর্ষের ইতিহাস, পরাধীনতার যন্ত্রণা এবং বাংলা ভাগের বিয়োগান্তক বেদনার চির বহমান রক্তক্ষরণের ছবি হয়ে উঠেছে। গবেষক ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ ঐতিহাসিক বহুমুখী ঘটনা ও ধারাবাহিক গতিধারা, বহুমাত্রিক তথ্য-উপাত্ত ও ভারতবর্ষের দালিলিক পর্যায়ের অসংখ্য দেশি-বিদেশি গ্রন্থ পত্র-পত্রিকা নিবিড় অধ্যয়ন ও তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে নির্মোহ ও নিরপেক্ষ বিচারে প্রকৃত সত্য উদ্ধারে ধ্যানী সাধকের মতো ব্রত নিয়ে কঠিন-কর্মটি সফলভাবে সাধন করতে পেরেছেন। এই গ্রন্থে দ্রাবিড় অস্ট্রিক আর্য থেকে শুরু করে হিন্দুরা কিভাবে এ দেশে এসেছিল, কিভাবে এ দেশকে শাসন করেছিল, তাদের কাছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কতোটা হীনতর ছিল, একই সম্প্রদায়ের মধ্যে উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তদের কী ভীষণ রকমের বৈষম্য সৃষ্টি, দ্বন্দ্ব সংঘাত হানাহানি-রক্তপাতের বীজ সেখান থেকেই প্রথম সৃষ্টি। এ সবের কঠিন সত্যটি আবিষ্কৃত হয়েছে এই গ্রন্থে। হিন্দু যুগ, মুসলমান যুগ ও ইংরেজ যুগ। এক এক গবেষকের কাছে এক একভাবে মূল্যায়িত বা অবমূল্যায়িত হয়েছে। এ গ্রন্থে এ সবের পরিষ্কার বিশ্লেষণ রয়েছে। হিন্দু শাসকেরা কিভাবে শোষণ-শাসন করেছিল, দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তাদের কোন দায়বোধ বা আগ্রহ ছিল না। এমনকি বাংলা ভাষা তারা নিষিদ্ধ করে সংস্কৃতি ভাষাকেই গ্রহণ করতে অধিক আগ্রহী ছিল।

তুর্কি ও মুঘলরা এ দেশে আসার পর এ অবস্থার যে পরিবর্তন ঘটেছিল, অর্থনীতি থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সভ্যতার অভূতপূর্ব যে বিকাশ ঘটেছিল এবং শ্রেণিবৈষম্য দূর কওে অসাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্ববোধের যে জাগরণ সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল, তখন নিম্নবর্গের বহু হিন্দু স্বতঃস্ফূতভাবে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। প্রকৃত অর্থে এক আলোর যুগ হিসেবে তা প্রতিষ্ঠা পায়। তুর্কি ও মুঘলরা এ দেশে ভিনদেশ থেকে এলেও এই দেশটাকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করে এখানেই স্থায়ী বসতি নির্মাণ করেছিল, এদের সন্তানেরাই পরবর্তীতে এ দেশটাকে পরিচালনা করেছিল। সে সময়ে হিন্দু মুসলমানের যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইতিহাসে তা বিরল। মুসলমানেরা তাদের ক্ষমতায় হিন্দুদেরও অংশীদারিত্ব করে উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। তারা এটা মানতো দেশটা শুধু মুসলমানের নয়। হিন্দু-মুসলমান সকলের। পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে সম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হয়েছিল। এর মূলেও ছিল এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকরা। সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্ম নিয়ে রক্তবীজ বুনে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে তৎপর ছিল। আর এর মূলে ছিল চতুর ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী। এ দেশটাকে তারা শোষণ আর লুণ্ঠনের জন্য বেছে নিয়েছিল, এ দেশটাকে ভাগ করো আর শাসন করো, এটা ছিল তাদের নীতি। আর এদের তাঁবেদারি করেছিল উচ্চবিত্ত হিন্দু শ্রেণি। এ সব জটিল

সময়কাল ও কূটিল রাজনীতি এবং এর গহিন সত্য লেখক অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় স্বচ্ছতার সাথে এ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। ইতিহাস গ্রন্থ বলতে যে গুরুগম্ভীর ভাষা ও তথ্য-উপাত্তে ভরা রসহীন উপস্থাপনা। এ গ্রন্থটি তা থেকে মুক্ত। লেখক গ্রন্থটিতে তথ্য-উপাত্ত যেমন তুলে ধরেছেন, ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন মন্তব্য যেমন গ্রহণ করেছেন, তেমনি নিজস্ব বিচারিক ও নির্মোহ যৌক্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সে সব বক্তব্যের সঙ্গে এক মত বা দ্বিমত পোষণ করে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের প্রয়াস গ্রহণ করেছেন। এবং এই প্রয়াসকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, পাঠকের মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। লেখকের ভাষার শক্তিতে এটি সুপাঠ্য ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করবে এ আশাবাদ থাকছে। যে কোন দেশের, যে কোন কালের ইতিহাসকে সাবলীল ও প্রাণবন্ত ভাষায় গ্রন্থে রূপদান করা সহজসাধ্য নয়।

ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে লেখকের মুন্সিয়ানা বা শিল্পদক্ষতার উপর নির্ভর করে। এই গ্রন্থের লেখক প্রফেসর ড. আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহর কাছে সে-কাজটি অনায়াসসাধ্য বলেই বিবেচিত হতে পারে। লেখক হিসেবে এটি তার বড় শক্তি। ইতিহাসকে উপন্যাস বা গল্পে রূপদান করা সহজ। সেখানে লেখকের অনেক স্বাধীনতা থাকে। ইতিহাসের মূল বিষয় সামনে রেখে মনগড়া অনেক ছবি সেখানে যুক্ত করে দুর্দান্ত এক শিল্পকর্ম রচনা করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, সেটা সৃজনশীল কোন সাহিত্যকর্ম ইতিহাসগ্রন্থ নয়। ইতিহাসগ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে লেখকের নিজস্ব স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। লেখককে পুরো ইতিহাসের উপরই নির্ভর করতে হয়। সেটাকে ভাষার জোরে পাঠককে কতোটা আকৃষ্ট করা যায়, অতটুকুই লেখকের শক্তি।

ওয়াল্টার স্কটের ‘আইভ্যান হ’, মহাকবি ফেরদৌসের ‘শাহনামা’, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’, নজরুলের ‘কুহেলিকা’, ‘অগ্নি-বীণা’, ‘প্রলয়-শিখা’, এমনকি মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ সহ অনেক গ্রন্থ আছে যা ইতিহাসকে উপজীব্য করে রচিত। কিন্তু এসব গ্রন্থ কালোত্তীর্ণ মর্যাদা লাভ করলেও এগুলো ইতিহাস গ্রন্থ নয়, সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম। এসব গ্রন্থের ভাষা যত সহজে কাব্যিক, আবেগময় ও অলঙ্কারের ব্যবহারে পাঠকের মস্তিষ্কের কোষে কোষে প্রবল উর্মিমালা তৈরি করা যায়, ইতিহাস গ্রন্থে তা কল্পনা করাও কঠিন। এই কঠিনকে জয় করেছেন গবেষক ড. আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ। লেখক এমনভাবে ভাষাকে স্রোতমীয় করে তুলেছেন পাঠক কখন কিভাবে ইতিহাসের গভীর থেকে গভীরে একটা পর একটা দরোজা খুলে ঢুকে পড়েন, তা তিনি নিজেও হয়তো বুঝতে পারেন না। অথচ এটি পুরোপুরি ইতিহাসগ্রন্থ। লেখকের ভাষাশৈলীতে গ্রন্থটি ইতিহাস গ্রন্থ হয়েও পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে।
গ্রন্থটিতে মোট নয়টি অধ্যায় রয়েছে। শুরুতে পটভূমি। নয়টি অধ্যায়ের পরে আছে উপসংহার, পরিশিষ্ট ও গ্রন্থপঞ্জি। ‘সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক প্রভাব’ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদানের পূবে ভারতকে অখণ্ড ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করার জন্য সুভাষচন্দ্র বসু যে প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন, তা বিশেষ করে গান্ধী ও নেহেরুর অসহযোগিতার কারণে যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি তার বিস্তারিত আছে।

‘ভারতে বৈষম্য সৃষ্টি’ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিরোধ এবং দেশ ভাগের ক্ষেত্রে নেহেরু বদ্ধ পরিকর অবস্থান এবং এ প্রেক্ষিতে মুসলমানেদের জন্য জিন্নাহর আলাদা রাষ্ট্র গঠনের মতো হঠকারিতামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়। ইংরেজ সরকার প্রথম থেকেই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সংঘাত-হানাহানি-বিরোধ সৃষ্টি করার নানা কূটকৌশল গ্রহণ করেছিল, তা অনেকখানি সফলতা পায় এদের ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণে। আর এর ফলেই সংঘটিত হয়েছিল কলকাতায় ১৯৪৬ এর ভয়াবহ দাঙ্গা। ‘বঙ্গভঙ্গে ভারতে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান’ অধ্যায়ে বিশ্লেষিত হয়েছে ভারতভাগের কারণে বাংলা ভাগ হয়েছে অনস্বীকার্য এই সত্য। কিন্তু এই ভাগের পেছনে ক্রীড়ানক হিসেবে কারা ছিলেন এবং কাদের স্বার্থে তারা এটা করেছিলেন । ‘বঙ্গভঙ্গ ও দুই বাংলার আর্থ-সামাজিক ব্যবধান’ অধ্যায়ে তথ্য-উপাত্তসহ গবেষক তুলে ধরেছেন দেশভাগের আগে প্রায় দেড় শত বছর অবিভক্ত বাংলার উন্নয়ন তা সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম বাংলাকেন্দ্রিক।

পূর্ব বাংলা অবহেলিত থেকেছে। দুই বাংলার আর্থ-সামাজিক ব্যবধান যে কত ভয়াবহ ছিল তা এই অধ্যায়ের মূল উপজীব্য। ‘বাংলা ভাগে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও হিন্দুসভার প্রভাব’ এ অধ্যায়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে দ্বিজাতিতত্ত্বেও ভিত্তিতে ভারত ও বাংলা ভাগের মাধ্যমে অখণ্ড ভারত নির্মাণের স্বপ্ন কিভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং এতে কংগ্রেস ও হিন্দুসভার ভূমিকা ও প্রভাব বর্ণিত হয়েছে। ‘বাংলা ভাগ ও দ্বিজাতি তত্ত’ অধ্যায়ে সুভাষচন্দ্র বসুর অখণ্ড ভারতের স্বপ্নপ্রয়াস কিভাবে গান্ধী-নেহেরুদের কূটচালের কাছে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পর্যবসিত হয়েছিল তা বিশ্লেষিত হয়েছে। এওছাড়াও ‘সুভাষচন্দ্র বসু এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা’, ‘অবিভক্ত বাংলা আন্দোলন এবং ভারত ও বাংলা ভাগ: প্রকাশিত গ্রন্থ ও পণ্ডিতবৃন্দের মতামত পর্যালোচনা’র মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে এ গ্রন্থে।

গ্রন্থের শুরুতে লেখক যে পটভূমি উপস্থাপন করেছেন তা সমৃদ্ধতর। পুরো গ্রন্থের বক্তব্যকে এতো চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন, সেকারণে মূল গ্রন্থটি পাঠের পূর্বে ‘পটভূমি’ পাঠ করা অতীব জরুরি মনে করি। তাহলে গ্রন্থটি পাঠের আগেই পটভূমি থেকেই পাঠক একটি মূল ধারণা পেয়ে যাবে। যা মূলগ্রন্থ পাঠে পাঠকের দারুণ সহায়ক ভূমিকা রাখবে। পটভূমিতে ভারতে দ্রাবিড়, অস্ট্রিক মাঙ্গোলীয় অবস্থান এবং এদের পরে আর্যদের আগমন ও বসবাস ও হিন্দু ধর্মচর্চা এবং ক্ষমতা প্রয়োগ। আর্যদের পরে আরব এবং পরবর্তীতে তুর্কি ও মোঘলরা ক্ষমতায় আসে। এরপর ইংরেজ শাসন ও আধিপত্য এবং সম্পদ লুণ্ঠনের ইতিহাস। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য তখন নানামাত্রিক যে সব আন্দোলন ও বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এ সব বিষয় ধারাবাহিকভাবে সাবলীলভঙ্গিতে পটভূমিতে রূপ পেয়েছে। এসব বিষয়ই মূল গ্রন্থে অধ্যায় বিভাজনের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে।

এই গ্রন্থে দুর্লভ অনেক ছবি স্থান পেয়েছে। এ ক্ষেত্রেও লেখক সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। ছবিগুলোও প্রকৃত ইতিহাস আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই গ্রন্থ রচনায় লেখকের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য বিশেষভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যা সাধারণত কোন গ্রন্থে লক্ষ করা যায় না। কারণ নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও সুনির্দিষ্ট মন্তব্য বিশেষভাবে উপস্থাপন করতে হলে লেখকের সাহস ও শক্তি, সঠিক তথ্য-উপাত্তের ব্যবহার এবং অবশ্যই নির্মোহ নিরপেক্ষ বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী হতে হয়, না হলে এটি সম্ভব নয়। গ্রন্থের শেষে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, গ্রন্থের সময়কাল ক্রমানুসারে সাল হিসেবে সাজানো, বিষয়ভিত্তিক পরিভাষা ও গ্রন্থপঞ্জির সংযোজন গ্রন্থটিকে যেমন সম্পূর্ণভাবে পরিপূর্ণ রূপ দিতে সহায়ক হয়েছে, তেমনি গবেষণার গতানুগতিক আঙ্গিক-ধারা থেকে বেরিয়ে নতুনভাবেও যে গবেষণাকর্ম করা যেতে পারে, এই গ্রন্থটি তার প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা রাখে। ভারতবর্ষের ইতিহাস ও বাংলা ভাগের ভিতর-বাহির নান ঘটনা সম্বলিত এটি একটি আদর্শ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

লেখক: ড. রকিবুল হাসান। অধ্যাপক ও কবি, কথাসাহিত্যিক, গবেষক।