চটপটে পাখি ফটিকজল
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৮:২৫ পিএম, ২২ জুন ২০১৯ শনিবার
অতি বাহারি রংয়ের পাখি ফটিকজল। এরা অতি শান্ত প্রকৃতির এবং আরাম প্রিয়। চালচলনে অভিজাত ভাব রয়েছে। গ্রামীণ বন ও ঝোপঝাড়ের পাখি ফটিকজল। আকারে চড়ুইয়ের চেয়ে ছোট কিন্তু দারুণ চটপটে পাখি। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি প্রায় একই রকম দেখতে। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই ফটিকজল দেখা যায়।
বৈজ্ঞানিক নাম Aegithina tiphia, ইংরেজি নাম Common Iora. ইজিথিনিডি গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত ছোট আকৃতির গায়ক পাখি ফটিকজল। এই পাখির মোট এগারটি উপপ্রজাতি সনাক্ত হয়েছে। প্রজনন ঋতুতে এই উপপ্রজাতিগুলোর মধ্যে রঙের ভিন্নতা দেখা যায়। সাধারণত এরা একস্থান থেকে অন্য স্থানে যায় না।
এর প্রজাতি নাম টিফিয়া এসেছে বাংলা তৌফিক থেকে। হিন্দিতে এরা সৌবিগা বা সৌবিগি নামে পরিচিত। তামিল ভাষায় পাছাপোড়া, পাঞ্জাবি ভাষায় লাটু এবং তেলেগু ভাষায় পৎসু জিত্তা নামে পরিচিত। বাংলাদেশের কোথাও কোথাও এরা চাতক নামে পরিচিত। বাংলা ভাষায় ফটিকজলের আরেক নাম হলুদ টুনি। যদিও টুনি গোত্রীয় পাখিদের সঙ্গে এর সম্পর্ক খুবই কম।
বর্ণনা : ফটিকজল মূলত হলুদ ও জলপাই রঙের। কালচে সবুজ ডানায় দু’টি সাদা রঙের পট্টি রয়েছে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি হঠাৎ করে সনাক্ত করা কঠিন। প্রজননকালে এর উপপ্রজাতিগুলোর মধ্যে শারীরিক গঠনগত পার্থক্য প্রকট হয়। তবে সব উপপ্রজাতির পুরুষেরই কালো ডানা ও গাঢ় লেজ দেখা যায়। স্ত্রী পাখির লেজ জলপাই রঙের। ঠোঁট, পা সিসা নীল। ফটিকজলের দৈর্ঘ্য ১৪-১৫ সেন্টিমিটার, স্ত্রী পাখির দৈর্ঘ্য একটু বেশি। ডানা ৫.৯-৬.৪ সেন্টিমিটার। লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ সেন্টিমিটার। শীতকালে পুরুষ ফটিকজলের রঙ একটু ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
আচরণ : ফটিকজল সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় বেশি দেখা যায়। তবে ছোট ছোট দলে অন্যসব পাখির সঙ্গেও খাবার খুঁজে বেড়াতে দেখা যায়। চঞ্চলমতি ও সর্বক্ষণ কিচিরমিচির করা পাখিগুলোর একটি ফটিকজল।
খাদ্যাভ্যাস : ফটিকজল মূলত কীটপতঙ্গ আর তাদের বাচ্চা শুককীট খায়। উড়ন্ত পোকা ধাওয়া করে খেতে পারে। সারাক্ষণ খাবারের সন্ধানে লতাপাতা এবং ডালপালার মাঝে বিচরণ করতে দেখা যায়। গাছের ডালপালায় ঝুলতে পারে। স্বচ্ছন্দভাবে পাতা বা চিকন ডালের গোড়া থেকে পোকা বা শুঁয়োপোকা ধরে খেতেও পারদর্শী।
প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি : গ্রীষ্মের মাঝামাঝি থেকে বর্ষাকাল ও তার পরবর্তী সময়গুলো ফটিকজলের প্রধান প্রজনন ঋতু। এসময় পুরুষ ফটিকজল নানাভাবে স্ত্রী পাখির মন জয় করতে চায়। শরীর বলের মত গোল করে বসে থাকে। শূন্যে লাফিয়ে উঠে ঘুরপাক খায়। স্ত্রী পাখির চারিদিকে বা বাসার চারিদিকে পালক ফুলিয়ে নেচে বেড়ায়, লেজ নাচায়।
প্রজনন ঋতুতে স্ত্রী ও পুরুষ দুজনে মিলেই বাসা বানায়। পেয়ালার মত চমৎকার বাসা বানায়। সাধারণত মাটি থেকে ২ থেকে ৩০ ফুটের মধ্যে বাসা করে। মরা দূর্বাঘাস, পাটের সরু আঁশ, শুকনো সরু ঘাস, গাছের চিকন নরম শিকড়, সরু লতা ইত্যাদি দিয়ে বাসা তৈরি করে। বাসা বানাবার ক্ষেত্রে ফটিকজল চরম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়। এজন্য নিজের বাসার পাশে বা অল্প দূরে তারা আরেকটি অসমাপ্ত ডামি বাসা বানায়। যাতে অন্য কোন পাখি তাদের বাসায় ডিম না পাড়তে পারে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা তিনটি ডিম পারে। মাঝে মাঝে দুই অথবা চারটিও পারে। ডিমের আকার টিকটিকির ডিমের তিনগুণ বড়। ধূসর-সাদা এবং গোলাপী রঙের ডিম দেখা যায়। স্ত্রী ও পুরুষ দুজনেই ডিমে তাঁ দেয়। এক মৌসুমে দু’বার ডিম পাড়ে। ১৫ থেকে ১৮ দিনে ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ছানাদের রঙ কচিপাতার মত সবজেটে হলুদ। দুজনেই ছানাদের খাওয়ায়। ছানারা উড়তে শেখে ১৬ থেকে ১৯ দিনের মধ্যে।
ডাক : ফটিকজল সুরেলা কণ্ঠের। প্রজনন ঋতুতে এদের ডাক খুব মিষ্টি। অন্য সময় গলার স্বর কর্কশ, তখন ডাকেও কম। ফটিকজলের শিষ অনেক সময় দোয়েলের শিষ বলে ভ্রম হয়। বাসার কাছে শত্রু দেখলে ডাকে চ্যারর-চ্যাঁ-চ্যাঁ-উ-চি-চা ধরনের। ফটিকজল অনেক সময় সতর্কাবস্থায় ফিঙের স্বর অনুকরণ করে শত্রুকে ভড়কে দেয়। গ্রীষ্মের দাবদাহে এরা টিক... জল, টিক... জল ডেকে ডেকে ঘুরে বেড়ায়। সে কারণেই এদের নাম ফটিকজল।
তথ্যসূত্র : পাখি সংক্রান্ত বই এবং উইকিপিডিয়া।
এএইচ/এসি