প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার অনুভূতি
সোহাগ আশরাফ :
প্রকাশিত : ১১:০৬ এএম, ২৮ জুন ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ১২:৫৫ পিএম, ২৮ জুন ২০১৯ শুক্রবার
আমি প্রথম বাবা হলাম। আমার ঘরে এখন চাঁদের আলো। সৃষ্টিকর্তা আমাকে এক রাজকন্যা উপহার দিয়েছেন। একটা সময় আমি একা ছিলাম। তারপর আমার হাতে হাত রেখে একটি মেয়ে আমার সব বাউন্ডুলেপনাকে কঠিন নিয়মের মধ্যে নিয়ে এলো। সেই থেকে স্বপ্ন আমার একটা পূর্ণাঙ্গ সংসার হবে। অর্থাৎ আমাদের সন্তান হবে। জীবনকে গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় নিয়েছি। তারপর পরিকল্পনা অনুযায়ী অপেক্ষা।
সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি। তিনি মুখ তুলে তাকালেন। তার রহমতের দরজা খুলে দিয়ে আমার স্ত্রীর গর্ভে নতুন এক জীবনের সন্ধান দিলেন। সেই শুরুর দিন থেকে অর্থাৎ যখন ডাক্তার জানালেন আমাদের সন্তান আসছে- তখন থেকেই আমার মধ্যে কেমন যেনো পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বাবা হওয়ার অনুভূতি সত্যি বোঝানো কঠিন।
চোখের সামনে ধীরে ধীরে আমার সন্তান স্ত্রীর গর্ভে বেড়ে উঠছে। তাকে নিয়ে কত পরিকল্পনা। স্ত্রীর প্রশ্ন- তুমি ছেলে চাও নাকি মেয়ে?
আমার একটাই কথা ছিল- সুস্থ সন্তান। ছেলে-মেয়ে কোন বিষয় না। তবে মেয়ে হলে আমি বেশি খুশি। কারণ, আমাদের ঘরে মেয়ে নেই। মানে আমার কোন বোন নেই। বাবা-মায়েরও সেই আক্ষেপ দেখেছি ছোট বেলায়। যে অভাব আমার সন্তান মেটাবে।
আমি সন্তানের জন্মদাতা পিতা। কিন্তু একটি সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হতে মায়ের ভূমিকা যে কি তা আমি দেখেছি আমার স্ত্রীর এই জার্নিতে। গর্ভে সন্তান আসার প্রথম তিন মাস অনেক কষ্ট করেছে সে। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখিছি। কিছুই করার ছিল না। কষ্টগুলো নিজের মধ্যে অনুভব করা ছাড়া আর কি করার আছে তাও বুঝে উঠতে পারিনি। তারপরও যতটুকু সম্ভব বাচ্চার মায়ের যত্ন নেওয়া, বাচ্চার সঙ্গে কথা বলা, এগুলো চলেছে। শুনেছি পেটের মধ্যে থাকলেও বাচ্চারা বাবা-মায়ের কথা শুনতে পায়। তাই প্রতিদিন নিয়ম করে তার সঙ্গে কথা বলেছি, গান শুনিয়েছি, কোরআন শুনিয়েছি। শুরু থেকে চিন্তা ছিল একজন ভালো চিকিৎসক দিয়ে তার (স্ত্রী) সঠিক সেবা নিশ্চিত করা। সেজন্য ঢাকার বড় চিকিৎসক দেখিয়ে চিকিৎসা চলেছে।
প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞাতা পেয়েছি। কি কি করলে পেটের সন্তান সুস্থ থাকবে? কি করলে সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের স্বাস্থ্যও ভালো হবে? ইত্যাদি বিষয়গুলো ইউটিউব, ওয়েবসাইড থেকে জেনে নিয়েছি।
দিনে দিনে বাচ্চা কতটুকু হচ্ছে? কত সপ্তাহে তার ওজন কতটুকু হয়? কত কি যে জানার চেষ্টা, ব্যকুলতা দুজনার। একজন মা এই নয় মাসের জার্নিতে বেশ কিছু প্রতিকুলোতার সঙ্গে লড়াই করেন। যা আমি বাবা হতে গিয়ে দেখেছি। ধীরে ধীরে সন্তান বড় হচ্ছে। তারপর পেটের মধ্যে নড়াচড়া অনুভব করতে শুরু করলাম। আমি পেটের উপর হাত দিয়ে, কান পেতে আমার সন্তানের হৃদয় স্পন্দন অনুভব করেছি। শুনেছি বাচ্চা পেটে আসলে মাকে বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। সেভাবেই চেষ্টা করেছি। কিন্তু শারিরীক অস্থিরতায় সে (স্ত্রী) খেতে অনিহা করলে আমি জোড় করে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছি। সেও সন্তানের কথা ভেবে সব অস্থিরতাকে দূরে ঠেলে চেষ্টা করেছে সব কিছু মোকাবেলা করার। এভাবে কেটেগেছে আট মাস।
আমি কাজের সূত্রে ঢাকায় থাকি। কিন্তু আমার আত্মিয়-স্বজন সব খুলনাতে থাকেন। তাই সিদ্ধান্ত হলো খুলনাতেই বাকি কাজটা শেষ করবো। সেখানেও ভালো ক্লিনিক-হাসপাতাল আছে। তাকে খুলনাতে রেখে আসলাম। মেয়েরা এসময়টাতে মায়ের কাছে থাকতে বেশি পছন্দ করে। তাই তাকেও তার মায়ের কাছে রেখে আসলাম। যদিও আমাদের বাড়ি তাদের বাড়ির কাছেই। তাই আমার বাবা-মাও খোঁজ খবর রেখেছেন প্রতিনিয়ত। স্ত্রীর এ সময়টাতে স্বামী কাছে থাকলে বেশি ভালো হয়। কিন্তু জীবন তো বিচিত্র। বাস্তবতা দুজনকে দূরে রেখেছে। এরপর অপেক্ষা। চিকিৎসক আল্ট্রাসোনোগ্রাফী করলেন। তবে ঠিকঠাক বলতে পারলেন না সন্তান কি হবে! তবে বলেছিলেন- হয়তো মেয়ে হবে। আমরাও সেভাবে জানতে চাইনি। মেয়ে হলেই আমরা বেশি খুশি। তবে সুস্থ সন্তানই সবার আগে কাম্য ছিল। সব পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে ১৬, ১৭ ও ১৮ তারিখ দিলেন তিন চিকিৎসক। আমিও ঢাকা থেকে সেই অনুসারে খুলনাতে গেলাম। কি যে কষ্ট সন্তানের মা হওয়া তা চোখে না দেখলে বোঝা যেতো না। শেষ মুহুর্তে তার নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে কোন লক্ষণ নেই। ১৯ তারিখ আমরা ডাক্তারের কাছে গেলাম। আবারও আল্ট্রাসোনোগ্রাফী করে, রক্ত পরীক্ষা করে, সিদ্ধান্ত দিলো ২১ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে সিজার করতে হবে। বসে রইলাম না, পরের দিন ২০ জুন তারিখ অন্য আরেক হাসপাতালে গেলাম। তারা দেখে বুঝে সিদ্ধান্ত নিলো যে আজই (২০ জুন) সিজার করতে হবে। এই হাসপাতালটির চিকিৎসা ব্যবস্থা দেখে আমার আস্থা হলো। রাজি হলাম। ভর্তি করলাম সন্তানের মাকে। বিকেল ৫টায় অপারেশন। বাড়ির সবাই হাসপাতালে উপস্থিত হলো। চিকিৎসক রক্ত ম্যানেজ করে রাখতে বললেন। আমরা দুজন ডোনার ঠিক করে রাখলাম। কত কি যে করতে হয়েছে এই অল্প সময়ের মধ্যে! আমার স্ত্রী ভয় পাচ্ছে। ভয় পাওয়ারই কথা। সবাইকে রেখে অপারেশন থিয়েটারে যেতে হচ্ছে। কান্না করছে অনেক। আমি চেয়ে চেয়ে দেখেছি। কিছুই করার নেই শান্তনা দেওয়া ছাড়া। সেটুকুও দিতে পারিনি। সবার সামনে চোখের ইশারা দিয়ে তাকে বিদায় দিয়েছি। এরপর অপেক্ষা। হাসপাতালটিতে দৈনিক প্রায় ৩০/৪০টি সিজার হয়। খুলনার বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে সবাই চিকিৎসা নিতে আসেন। কম খরচে অসাধারণ চিকিৎসার কারণে আস্থার একটা জায়গা হয়ে উঠেছে এটি।
আমরা সবাই বসে আছি। টিভিতে বাংলাদেশের খেলা হচ্ছে। সবাই টিভির দিকে তাকিয়ে, কিন্তু আমি চেয়ে আছি দরজার দিকে। নার্সদের জিজ্ঞাস করলাম অপারেশন রুমে ঢোকানোর কত সময় পর বাচ্চা দেখানো হয়? ওরা জানালো ১ ঘন্টা পরে। আমার সন্তান জন্ম নেওয়ার আগে আরও প্রায় ৮/১০টি বাচ্চা নিয়ে এসেছে নার্সেরা। অর্থাৎ এক একটি অপারেশন হচ্ছে আর বাচ্চাটাকে বাইরে এসে তার স্বজনদের দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মনে হলো প্রায় ২০টি অপারেশন হচ্ছে একই সময়ে। আমার মধ্যে চিন্তা হলো। সন্তান আবার বদলে না যায়। এ যেনো কোন সন্তান উৎপাদনের কারখানা। কাপড়ে মোড়ানো ছোট্ট ছোট্ট শিশু নিয়ে আসছে এক এক করে। যাদের পেয়ে স্বজনদের মধ্যে সে কি উৎসাহ, উদ্দিপনা, আনন্দ। আমার আর ধৈর্য্য নেই। অস্থিরতা কাজ করছে। এরই মধ্যে দেখলাম একটি শিশুকে নিয়ে একজন নার্স বের হলেন। দেখেই মনে হলো এটা মনে হয় আমার বাচ্চা। তার গায়ের রং চাঁদের আলোকে হারমানাবে। ফুটফুটে শিশুটাকে এনে নাম ধরে ডাকতেই সবাই ছুঁটে গেলাম। তারা জানালেন আপনাদের একটি ফুটফুটে সুন্দরী কন্যা সন্তান হয়েছে। সবার চোখে মুখে আনন্দের বন্যা। মেয়েকে সবার আগে আমার বাবার কোলে দেওয়া হলো। বাবা নাতনিকে কোলে নিয়ে কানের কাছে আযান দিলেন। দেখলাম তার চোখ থেকে পানি ঝড়ছে। এই কান্না আনন্দের। আমাদের ঘরে নতুন অতিথি। ভাই-বোন মোবাইলে ছবি তুলছে। আমি জানতে চাইলাম- মেয়ের মা কেমন আছে? তারা জানালো এখনও অপারেশন চলছে। মেয়েকে দেখে দিয়ে দিন। তাকে তার মায়ের কাছে রাখতে হবে।
ওরা প্রতিটি বাচ্চার হাতে টোকেন লাগিয়ে রেখেছে। যাতে মায়ের সঙ্গে সন্তানকে চিনতে কষ্ট না হয়। এরপর অপেক্ষা সন্তানের মায়ের জন্য। আমার সন্তানটা দেখতে সুন্দর বর্ণের হয়েছে। ঠিক তখনই আমি মনে মনে ওর নাম রেখেছি সুবর্ণ।
চিকিৎসক ছয় ঘন্টা পর্যবেক্ষণে রেখেছে মেয়ে ও তার মাকে। আমরা অপেক্ষা করছি। এরই মধ্যে কেবিন নিয়ে নিলাম। সবাই কেবিনে উঠে গেছে। আমি বসে আছি। রাত ১১টায় ছয় ঘন্টা শেষ হলো। ওরা মেয়ের মাকে নিয়ে কেবিনে যাচ্ছে। আমার কাছে মেয়েকে দেওয়া হলো। লিফটে করে ছোট বাচ্চা নেওয়া যাবে না। আমি সিড়িতে হেটে হেটে উপরে উঠলাম। কিন্তু এ সময়টুকুতে বারবার মেয়ের মুখের দিতে তাকিয়ে দেখছি। সুবর্ণ দেখতে কার মত হয়েছে? বোঝা গেলো না। এ সময় সব শিশুকেই এক রকম দেখায়।
কেবিনে নিয়ে আসলাম। সবাই কোলে নিচ্ছে। কত কথা বলছে। কেউ বলছে- আমার মত হয়েছে, কেউ বলছে- ওর মায়ের মত। আমি বলছি- একটি সুস্থ সন্তান হয়েছে, সে জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমাদের কাছে আত্মিয়দের মধ্যে অনেকের ঘরে মেয়ে সন্তান। তারা বলছে- সোহাগের একটা ছেলে হলে ভালো হতো। আমি তাদের বলেছি- ছেলে মেয়ে বড় নয় সন্তান হতে হবে মানুষের মত মানুষ। পুরো রোজার মাস সেটাই আমি চেয়েছি সৃষ্টিকর্তার কাছে।
এই জার্নিতে সৃষ্টিকর্তার পরে আমার আত্মিয়-স্বজন, অফিসের সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, চিকিৎসকসহ সবার উপর কৃতজ্ঞতা।
এরপর পালা সন্তানের নাম রাখা নিয়ে। অনেকেই অনেক নাম রেখেছেন। আমি বলেছি সবাই যার যার মনের ইচ্ছে মত নামে ডাকো। সুবর্ণ’র এক দাদি তার নাম রাখলো ‘প্রজ্ঞা’। নামটা সবার পছন্দ হয়েছে। তাই আমার রাখা নামের সঙ্গে জুড়িয়ে ওর পুরো নাম রাখা হয়- ‘সুবর্ণ আশরাফ প্রজ্ঞা’।
প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার অনুভূতি ভাষায় লিখে প্রকাশ করা যাবে না। তার উপর প্রথম কন্যা সন্তান। সবাই বলে যার প্রথম কন্যা সন্তান হয় তার সৌভাগ্যের দরজা খুলে যায়।
যা হোক; ‘প্রজ্ঞা’- তুই সারা জীবন বাবার আদর নিয়ে থাকবি। তোর মাঝে আমি আমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আমার না পাওয়াগুলো তুই পূরণ করবি। তোর কাছে একটাই চাওয়া- জীবনে হতাশ হবি না, অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকবি, অহংকার, ঘৃণা যেনো তোকে স্পর্শ করতে না পারে। সর্বপরি একজন মানুষ হয়ে উঠবি। যে হবে- মানবিক ও শিক্ষিত মানুষ।
এসএ/