ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৫ ১৪৩১

বেনাপোলে রেকর্ড ছাড়িয়েছে রাজস্ব ঘাটতি

বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৬:০২ পিএম, ৪ জুলাই ২০১৯ বৃহস্পতিবার

দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলে রাজস্ব ঘাটতিতে রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গেল অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, সেখানে আদায় হয়েছে ৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হয়। সেই হিসেবেই বন্দরে ৫ হাজার কোটি টাকার অধিক রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা। বাণিজ্য তদারকিতে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মধ্যে পরস্পরের সমন্বয়ের অভাবের ফলে ব্যবসায়ীরা এ পথ থেকে বাণিজ্যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এতে সরকার যেমন রাজস্ব আয়ে বাধাগ্রস্থ হয়েছে তেমনি লোকশান গুনেছেন ব্যবসায়ীরাও। বৈধ সুবিধা নিশ্চিত হলে আবার গতি ফিরবে বাণিজ্যে।

আর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছেন, শুল্কফাঁকি রোধে কড়াকড়ি আরোপ করায় আমদানি কমে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। তবে ব্যবসায়ীদের বৈধ সুবিধাগুলো বাড়াতে কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।

জানা যায়, দেশের ২৩টি স্থলবন্দরের মধ্যে চলমান ১৩টি বন্দরের অন্যতম বেনাপোল স্থলবন্দর। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানির জন্য দেশে যতোগুলো বন্দর রয়েছে তার মধ্যে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর হলো বেনাপোল।

এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা দেশের অন্য যেকোনো বন্দরের তুলনায় উন্নত। বেনাপোল থেকে কলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। সে কারণে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ পণ্য এ বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানি হয়। দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী এ বন্দর দিয়ে মালামাল আমদানি করে থাকেন। যে দিন ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয় সেই দিন থেকে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই আমদানি করা পণ্য বন্দরে প্রবেশ করে।

তবে পণ্য আমদানির বেলায় এ বন্দরে চলে নানা অনিয়ম। কখনও পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা, আবার ঘোষণার অতিরিক্ত পণ্য এনে সরকারের শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়। এতে শুল্ক আয় কমে যাচ্ছে। বর্তমানে বন্দরে ২৮টি পণ্যগার, ৮টি ওপেন ইয়ার্ড, একটি ভারতীয় ট্রাক টার্মিনাল, একটি রফতানি ট্রাক টার্মিনাল ও একটি ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ডের মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

কাস্টম সূত্র থেকে জানা যায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেনাপোল কাস্টমস হাউসে চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে পাঁচ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় ৫ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। সেটিও পূরণ করতে পারেনি বেনাপোল কাস্টম হাউজ। ঘাটতি থেকে গেছে এক হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এর আগে গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা চার হাজার ১৯৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। রাজস্ব আদায় হয়েছিল চার হাজার ১৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। তখনও একই কারণে ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, সব বন্দরে আমদানি পণ্যের মূল্য এক হতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে যে পণ্যের শুল্কায়ন হচ্ছে ৪ ডলারে, বেনাপোল বন্দরে ওই একই পণ্যের ওপর সাড়ে ৪ ডলারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। প্রতিটি পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে এমন মূল্য করা হয়েছে যা আমদানিকারকরা পণ্য ছাড় করাতে মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়ছে। তারপর বিভিন্ন সময়ে ভারতে পণ্যের মূল্য কমে গেলেও বেনাপোল কাস্টম হাউজে সেই পণ্যের মূল্যে কমে না। দিন দিন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমদানিকারকদের ঘোষিত মূল্য না মানায় তারা আর আমদানিতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না। বন্দরের ধারণ ক্ষমতা ৪২ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু এখানে সব সময় পণ্য থাকে কমপক্ষে দেড় লাখ মেট্রিক টন। জায়গার অভাবে পণ্য খালাস করতে না পেরে ভারতীয় ট্রাক বন্দরে দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকছে। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে মূল্যবান পণ্যসামগ্রী পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বৈধ সুবিধা পেলে এ বন্দর থেকে বর্তমানে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে, তখন তার দ্বিগুণ আয় হবে।

সাধারণ সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীরা বলেন, একদিকে কাস্টমের কড়াকড়ি অন্যদিকে বৈধ আমদানি চালান কাস্টম কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়া আবার বিজিবি সদস্যরা তা আটক করছে। তল্লাশির নামে সেখানে ২-৩ দিন পণ্য চালান আটকে থাকছে। আবার অনেক সময় পণ্য আটক করে কাস্টমে জমা দিচ্ছে। ওই পণ্য ছাড়াতে কমপক্ষে ১৫/২০ দিন সময় লাগায় তা বাজারে বিক্রি করতে পারে না। আমদানি-রফতানি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিজিবি আর কাস্টমের মধ্যে পরস্পরের সমন্বয় দরকার। এসব অনিয়মের কারণে দিন দিন এ বন্দরে রাজস্ব আদায়ে ধস নামছে। আমদানিকারকরা চলে যাচ্ছে অন্য বন্দরে।

বেনাপোল বন্দরের উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল জলিল বলেন, জায়গা সংকটে বর্তমানে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে নতুন জায়গা অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে বেনাপোল বন্দর একটি আধুনিক বন্দরে রূপান্তরিত হবে।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, বেনাপোল বৃহৎ বন্দর হলেও এর কোন সুফল আমরা পাচ্ছিনা। সপ্তাহে ৭ দিন বাণিজ্যসেবা চালু থাকলেও কাগজে-কলমে। বাণিজ্য প্রসার করতে হলে বৈধ সুবিধা ও অবকাঠামো উন্নয়নের বিকল্প নেই। বাণিজ্য প্রসার করতে হলে বেনাপোলে সব ধরণের হয়রানিমুক্ত করা প্রয়োজন।

বেনাপোল কাস্টমের কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘কাস্টমসে পণ্য চালান খালাসে পূর্বের চেয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বেড়েছে। শুল্ক ফাঁকির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে। এ বন্দরে কাস্টম আইন এবং নিময়-কানুন যথাযথভাবে প্রয়োগ করার কারণে কিছু সুবিধাবাদী আমদানিকারকরা এ বন্দর ছেড়ে চলে গেছে। আবার উচ্চ শুল্কযুক্ত পণ্যে আমদানি কমে যাবার কারণে রাজস্ব আয় কমেছে। যে কারণে গেল অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।’ কাস্টম কর্তৃপক্ষ বৈধ ব্যসায়ীদের সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

এমএস/এসি