ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

‘জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের খেদমত করে যাব’

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৫:১৫ পিএম, ৫ জুলাই ২০১৯ শুক্রবার

 

বর্তমান যান্ত্রিক যুগে সন্তানরা যেখানে নিজের পিতা-মাতাকে ভুলতে বসেছে। যান্ত্রিক সভ্যতা ও নিজেদের ব্যস্ততার কারণে অনেকেই ভুলতে বসেছে তাদের প্রিয়জনকে। অনেকেই নিকট আত্মীয়কে অস্বীকার করছে।এই যুগেই অন্যরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বরিশালের উজিরপুর গ্রামের মিল্টন সমাদ্দার (৩২)। পেশায় একজন নার্স  হয়েও নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীর কল্যাণপুরে স্থাপন করেছে চাইল্ড এন্ড ওল্ড এইজ কেয়ার নামে একটি বৃদ্ধাশ্রম। ২০১৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে এই বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন মোট ৫৪জন। তাদের মধ্যে ২৩জন পুরুষ বৃদ্ধা, ৩০ বয়স্ক মহিলা রয়েছে।

অসহায় ও আশ্রয়হীন বৃদ্ধদের খুঁজে বাড়ানো তার নেশা ও পেশা হয়ে গেছে। নিজের ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া বৃদ্ধাদের ভরণপোষণ করান তিনি।

নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে রাস্তা থেকে অসুস্থ অসহায় বৃদ্ধদের পরম মমতায় বুকে তুলে নেন মিল্টন সমাদ্দার। এসঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করছেন তার স্ত্রী মিঠু হালদার। শুধু বৃদ্ধা নয় মানসিক ভারসাম্যহীন ও প্রতিবন্ধীদের তার নিজেদের ছায়াতলে আশ্রয় দেন। এমনকি মৃত্যৃর পর তাদের দাফন-কাফনের দায়িত্বও পালন করেন নার্স এই দম্পতি। তার ইচ্ছা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের দেখমত করে যাবো মিল্টন ও তার স্ত্রী দু’জনেই পেশায় নার্স। তাদের উপার্জিত অর্থ দিয়েই চলে বৃদ্ধাশ্রমটি। নার্সিং এজেন্সি নামে একটি এজেন্সি রয়েছে মিল্টনের। যেখানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা দেয়া হয়। সেখান থেকে মিল্টনের যে আয়, আর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে কর্মরত তার স্ত্রী যে অর্থ পান তাতেই চলে মিল্টনের এই বৃহৎ সংসার। নিজেরা সেই বৃদ্ধদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেন।

এবিষয়ে মিল্টনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় একুশে টিভি অনলাইন প্রতিবেদেকের। এবিষয়ে মিল্টন বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে যা আয় তার সবকুটু এই বৃদ্ধাশ্রমে ব্যয় করেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে ১০ জন লোক কাজ করে। তাদেরকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। ভাড়া হিসাবে প্রতিমাসে গুণতে হয় ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা দিতে হয়। একজন চিকিৎসক সবসময় এই এদের দেখা শুনা করে। তাকে প্রতিমাসে দিতে হয় ১৬ হাজার টাকা। এদের ওষুধ কিনতে প্রতিমাসে ৭৫ হাজার টাকা দিতে হয়। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা গুনতে হয়।

শুরুটা কেমন হয়েছিলো জানতে চাইলে মিন্টল বলেন, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে রাস্তার পাশে রোগ-শোকে জরাজীর্ণ এক বৃদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারেন তার স্মৃতি হারিয়েছে। দেরি না করে দ্রুত তাকে বাসায় নিয়ে যান। বৃদ্ধা সেখানে মিল্টনের পরিবারের সদস্যের মতই থাকতে থাকে।

এর পরই মিল্টনের মাথায় চেপে বসে মানবতার কল্যাণের এই নেশা। শুরু করেন বৃদ্ধদের খোঁজ। সন্তান পরিত্যাক্ত, অসুস্থ, স্মৃতিভ্রষ্ট, রোগাক্রান্ত বয়স্ক মানুষ দেখলেই নিয়ে আসেন তিনি। ভাড়া নেন তাদের জন্য একটি আলাদা টিনশেড ঘর।

মাস ছয় যেতে না যেতেই সেখানে যেনো স্থান সংকুলান হয় না। আর তাই একটি বাড়ির ছয় তলার নিচ তলার দুই ইউনিট ও আরেকটি দোতলা বাড়ির নিচ তলার পুরোটা নিয়ে রাখতে থাকেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। বর্তমানে মোট ১৬ টি রুমে ৪২ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন। যাদের মিল্টন ও তার স্ত্রী বাবা-মা বলেই ডাকেন।

এবিষয় মিল্টন বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী যা আয় করি তার পুরোটাই আমরা আমাদের বাবা-মায়ের পেছনে খরচ করি। আমরা কোনো টাকা সঞ্চয় করি না। চার বছরের একটি ছেলে আছে আমাদের। ওর যখন ছয় মাস বয়স তখন থেকেই আমরা শুরু করি এ কার্যক্রম। আমার এ কাজে আমি অনেক শান্তি পাই। আমি চাই যারা বয়স্ক বাবা-মা কে অবহেলা করে, দেখে না। তারা এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুক।

 মিল্টনের এপরিবারে এখন পর্যন্ত ঠাঁই হয়েছে ৭৬ জন বাবা-মায়ের। এর মধ্যে মারা গেছেন প্রায় ১৬ জন। আর বাকিদের তাদের পরিবারের সদস্যরা মিল্টনের ফেসবুক পেজে দেখে সনাক্ত করে নিয়ে গেছেন। মিল্টনের কারণেই অনেক পরিবারের মুখে হাসি ফুটেছে তাদের হারিয়ে যাওয়া বাবা-মাকে খুঁজে পেয়ে।

তবে এখন শুধু মিল্টনই নয় মিল্টনকে বৃদ্ধ- বৃদ্ধাদের খুঁজে পেতে সহায়তা করেন আশেপাশের মানুষরাও। পুলিশ পথচারী যে যেখানে অসহায় বৃদ্ধদের দেখতে পান তারাই মিল্টনকে জানান। মিল্টন তাদের গিয়ে নিয়ে আসেন। আবার অনেকে নিজেরাও পৌঁছে দিয়ে যান অসহায় বৃদ্ধদের। তবে যারা পৌঁছে দেন তারাও আর পরে খোঁজ না নেয়ায় বেশ আক্ষেপ শোনা যায় মিল্টনের কণ্ঠে।

ভবিষ্যৎ কি পরিকল্পনা রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে মিল্টন বলেন, আগামীতে অসহায় বৃদ্ধা ও নিজের করবের জন্য একটি করব স্থান তৈরি করবো। এছাড়া প্রতিবন্ধী শিশুদের নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে। সরকারের কাছে বিশেষ কিছু চাওয়ার আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না তেমন কিছু চাওয়ার নেয়। সরকার যদি সবকিছু করে তাহলে আমরা কি করব। আমরা এসব ছোটখাটো কাজ করবো। আর সরকার দেশ উন্নয়নে কাজ করবে।

 

 টিআর/