আমাদের চিন্তা আর মননের স্বাধীনতা
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
প্রকাশিত : ১১:২৯ পিএম, ৮ জুলাই ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ১২:১৮ পিএম, ১৪ জুলাই ২০১৯ রবিবার
আমার ডাক্তার হওয়াটা অনেকটাই প্রয়াত পিতা মাহতাব উদ্দিন আহমেদের আগ্রহে। পেশায় তিনি ছিলেন প্রকৌশলী। তার জমানায় পেশাগত দক্ষতার কারণেই তাকে চিনতো অনেকেই। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতির জন্য তার ফাইলটি যখন সে সময়কার দোর্দ- প্রতাপশালী সিএমএলএ লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের টেবিলে, পুরো পরিবার যখন উদ্বেল একটি সুখবরের অপেক্ষায়, ঠিক তখনই তখনকার যোগাযোগ সচিব, আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের একটি ফোনে আমরা জানতে পেরেছিলাম পদোন্নতি নয়, বরং জেনারেল সাহেব আমার প্রয়াত পিতাকে সরকারী চাকরি থেকে অপসারণের নথিতে স্বাক্ষর করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা ছিলেন আমার মামা প্রয়াত মাসুদ আহমেদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একই ব্যাচের সিএসপি কর্মকর্তা তারা। ছোটবেলা থেকে দেখা প্রিয় বন্ধুর ছোট বোনের পরিবারের কাছে এই ‘ব্রেকিং নিউজটা’ ব্রেক করা নিশ্চয়ই তার জন্য কোন সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না। হয়ত বাধ্য হয়েই তিনি কঠিন এই কাজটি করেছিলেন যাতে পরদিন অফিসে গিয়ে আমার প্রয়াত পিতাকে আরও বড় কোন অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি না হতে হয়।
শুনেছি, সেই সময়ে পাকিস্তান ফেরত প্রভাবশালী এক জেনারেলের ঠিকাদার ভাতিজার অন্যায় আবদার পূরণে অসম্মতি আমার প্রয়াত পিতার জন্য এমন পরিণতি ডেকে এনেছিল। ‘ভাতিজা’ ভদ্রলোক এখন দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার বিষয়ে আলোচনা না হয় আর না-ই করলাম। ১৯৮৫ সালে আমার এসএসসি পরীক্ষার সময়ে বাসার বড় ছেলের পরীক্ষার প্রস্তুতি বাদ দিয়ে আমার পরিবার ব্যস্ত ছিল সরকারী বাসা ছেড়ে ভাড়া বাসায় শিফটিংয়ের দৌড়াদৌড়িতে। আমার প্রকৌশলী পিতা সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ছেলেকে চিকিৎসক বানাবেন, যাতে আমি কোন ফার্মেসিতে বসে প্র্যাকটিস করে হলেও সংসার চালাতে পারি। কোন ঠিকাদার যেন আমার ক্যারিয়ারের পরিণতির নির্ধারক হতে না পারে। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তিনি প্রায় অর্ধযুগ পর তার হারানো চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে তার সিদ্ধান্তের কোন নড়চড় হয়নি।
বিয়ের পরে জেনেছি আমার প্রয়াত পিতা যখন সামরিক জান্তার খামখেয়ালির শিকার হয়ে আদালতের বারান্দায় ছোটাছুটি করছেন, ঠিক একই সময়ে আমার সহধর্মিণী ডা. নুজহাত চৌধুরীর পরিবারের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছিল প্রথমে জেনারেল জিয়ার প্রতিমন্ত্রী আর পরে জেনারেল এরশাদের পূর্ণমন্ত্রী শহীদ ডা. আলিম চৌধুরীর ঘাতক মাওলানা মান্নান। উদয়ন বিদ্যালয়ে সরকারী সফরে আসার আগে এই মাওলানা সরকারী নির্দেশ জারি করেছিল যেন স্কুলটির শিক্ষিকা শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী তাকে স্কুলে অভ্যর্থনা জানাতে অবশ্যই উপস্থিত থাকেন।
ধান ভানতে শিবের এই গীত গাওয়ার উদ্দেশ্য, বঙ্গবন্ধুউত্তর বাংলাদেশে পাকিস্তানপ্রীতি আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির দাপট আর ঔদ্ধত্য কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল তার সামান্য নমুনা তুলে ধরা। প্রয়াত জিয়াউর রহমানের ব্যাপারটা আমি বুঝি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে জড়িত কারও পক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া টিকে থাকা ছিল অসম্ভব। কিন্তু জেনারেল এরশাদের ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও অস্পষ্ট। তার তো যথেষ্ট সুযোগ ছিল ইতিহাসকে ইতিহাসের জায়গায় ফিরিয়ে আনার। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে না হোক, অন্তত জিয়া হত্যাকান্ডের নেপথ্যে তার সম্পৃক্ততার কারণে। কিন্তু কার্যত তা ঘটেনি। আমরা বরং এর উল্টোটি ঘটতে দেখেছি। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে নিগৃহীত করা আর সীমাহীন রাজাকার তোষণের যে উৎসবের সূচনা প্রয়াত জিয়ার জমানায় শুরু হয়েছিল তা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে বেড়েছে বৈ কমেনি। আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের পাকিস্তান প্রীতির রহস্যভেদ করার আগ্রহ আমার দীর্ঘদিনের। উত্তর খুঁজেই বেড়িয়েছি শুধু, পাইনি। হতে পারে দশকের পর দশক ধরে চলা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিকৃত ইতিহাসের চর্চা এর একটি বড় কারণ।
কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম বনানীর একটি আউটলেটে শপিং করতে। মাঝে মাঝেই শুক্রবার সন্ধ্যায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে হৈচৈ করে এ ধরনের আউটলেটে শপিং করায় আমাদের পরিবারের বিরাট আনন্দ। সে রকমই এক শুক্রবার সন্ধ্যায় হঠাৎই দেখলাম আউটলেটটির ‘জীবন্ত মুরগির’ খাঁচায় ট্যাগ লাগানো ‘পাকিস্তানী কক’। ম্যানেজার ভদ্রলোকের শরণাপন্ন হলাম। জানতে চাইলাম হঠাৎ করে মুরগির খাঁচায় পাকিস্তানী কক লেখার রহস্যটা কি? এমন তো না যে মুরগিগুলোকে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হয়েছে। আবার এমনও না যে- তার আউটলেটে আর কোন আমদানি করা পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে না। উত্তর পাইনি। শুধু বললেন, ‘কেউ কখনও এভাবে ধরিয়ে দেননি’। ভদ্রলোক অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই ট্যাগটি সরিয়ে নিলেন।
ঈদের শপিং-এ গুলশান-বনানী এলাকার একাধিক অভিজাত দোকানের দোকানির মুখে শুনেছি পাকিস্তানী বলে বিক্রি করলে নাকি পোশাকের কাটতি বাড়ে, এমনকি তা যদি সত্যি সত্যি পাকিস্তানী নাও হয়। অবাক হয়ে ভেবেছি যারা একাত্তরে অবলীলায় আমাদের মা-বোনদের বস্ত্রহরণ করেছে, তাদের তৈরি কাপড় গায়ে জড়াতে এতটুকুও বাধছে না আমাদের আজকের মা-বোনদের।
আমাদের কারও কারও পাকিস্তান ক্রিকেটপ্রীতি রীতিমতো দৃষ্টিকটু রকমের। ঢাকার গ্যালারিতে ‘ম্যারি মি আফ্রিদী’ লেখা ব্যানার হাতে বাঙালী ললনার আকুতি নিয়ে হালকা মন্তব্য করতে দেখেছি এমনকি পাকিস্তানী ক্রিকেটারদেরও। দেশের মাননীয় মন্ত্রীকে দেখেছি ম্যাচ জিতে গভীর মমতায় খ্যাপ খাটতে আসা পাকিস্তানী ক্রিকেটারকে জড়িয়ে ধরতে। আমাদের পাকিস্তান ক্রিকেটপ্রীতি এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে-দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যেয়ে সরকারকে নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়েছে গ্যালারিতে ভিনদেশী পতাকা নিয়ে প্রবেশের ওপর। ঢাকার গ্যালারিকে যাতে টিভির পর্দায় কোন দর্শক লাহোর ভেবে ভুল না করেন সেই চেষ্টা থেকেই এমনটা করা।
ডাক্তারির পাশাপাশি আরও হাজার কাজেই আমার ব্যস্ততা। সঙ্গত কারণেই ডাক্তারদের পাশাপাশি অন্য পেশায় আমার বন্ধু-বান্ধবও কম না। সে রকমই একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এটিএন নিউজের সিনিয়র সাংবাদিক প্রভাষ আমিন। প্রভাষ সম্প্রতি বিশ্বকাপে পাকিস্তান বনাম নিউজিল্যান্ডের ম্যাচের আগে পাকিস্তানের পরাজয় প্রত্যাশা করে স্ট্যাটাস দিয়ে পাকিপ্রেমীদের ভালই রোশানলে পড়েছেন। তিনি কেন ভারতের ধ্বংস চান না এমন প্রশ্ন থেকে শুরু করে ভারতের দালাল পর্যন্ত অনেক কথাই শুনতে হয়েছে তাকে।
যতই এসব দেখি ততই ভাবি কারণটা কি? অনেককে বলতে শুনেছি, ‘রাজনীতির সঙ্গে খেলাকে মেলান কেন?’ আবার এরাই খেলায় পাকিস্তানের পরাজয় প্রত্যাশা করলে, না চিনে, না জেনে প্রভাষকে অবলীলায় ভারতীয় দালাল বলে দিচ্ছে। অনেকে আবার বলেন এটা তাদের পাকিস্তানপ্রীতি না, ওরা মুসলমান বলে মুসলমান দেশকে সমর্থন করছেন তারা। কই এবারের বিশ্বকাপে আমি তো ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়েও একজন আফগান ক্রিকেট সমর্থক খুঁজে পাইনি। আর কই ওরা তো মুসলমান বলে একাত্তরে একজন বাঙালীকেও ছেড়ে কথা বলেনি? অথচ আমাদের কারও কারও পাকিস্তানপ্রীতি এমনই যে- তা খেলার মাঠ থেকে খাবারের টেবিল পর্যন্ত গড়িয়েছে।
জাতি হিসেবে বাঙালী আর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে পূর্ণভাবে বিকশিত হতে হলে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়াটা জরুরি। এদেশের জন্য অনেক কিছুই করছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালীদের কারও কারও কাঁধে যে ‘পেয়ারে পাকিস্তানের’ ভূত তা দূর করতে কত কি-ই না করছে তার সরকার। কাজ করছে সিভিল সোসাইটিও। ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ আর ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ নিয়ে দেশের এক মাথা থেকে অন্য মাথা চষে বেড়াচ্ছেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শাহরিয়ার কবির আর কাজী মুকুলরা। বলে চলেছেন ডা. নুজহাত চৌধুরীরাও। ছুটছেন ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ আর ‘সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম’। ছুটছেন আর বলছেন আরও অনেকেই। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী আর বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী যখন দরজায় কড়া নাড়ছে তখন বুলেট ট্রেনের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ।
পদ্মাসেতু আর মেট্রোরেল এখন পুরনো খবর। বাংলাদেশ এটা উৎপাদনে প্রথম তো সেটা উৎপাদনে দ্বিতীয়, এসব কথা শুনতে এখন আর আমাদের কাছে নতুন লাগে না। কিন্তু শুধু একটা সমৃদ্ধ আর উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার তাগিদে তো বঙ্গবন্ধু তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কারাগারে কাটিয়ে দেননি, আত্মাহুতি দেননি ত্রিশ লাখ শহীদও। বাঙালী জাতির জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য।
পথচলার সত্তরটি বছরে আওয়ামী লীগ এই দেশ আর জাতিকে দিয়েছে অনেক, দিচ্ছে এবং দেবেও। বাঙালীর ভৌগোলিক স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধু আর আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। জননেত্রী শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগ এখন বাঙালীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার। কিন্তু আমাদের চিন্তার আর মননের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে এখনও পাড়ি দিতে হবে বহুটা পথ। আর সেই পথচলায় বাঙালীর বিশ্বস্ত সহযাত্রী যেমন আওয়ামী লীগ, বিশ্বস্ত পথ প্রদর্শকও তেমনি বঙ্গবন্ধুর পরিবার। সম্প্রতি ধাক্কাটা খেয়ে কথাটা আরও বেশি করে আত্মস্থ করতে পেরেছি। সারা শহর যখন আওয়ামী লীগের সত্তরতম জন্মদিনের আলোকমালায় সুসজ্জিত, আমি তখন আরও একবার বুঝে নিয়েছি এদেশ আর এই জাতির পূর্ণাঙ্গ মুক্তি আসতে পারে শুধু বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগের হাত ধরে এবং শুধু বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার ধমনিতে বহমান তেমনি কারও নেতৃত্বেই।
লেখকঃ অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) -চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় -সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।