ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

সন্দেহভাজন লোকদের মারধর

লক্ষ্মীপুরে সর্বত্র ছেলেধরা আতঙ্ক, স্কুলে কমছে শিক্ষার্থী

নিলয় মামুন

প্রকাশিত : ০৫:০৮ পিএম, ১১ জুলাই ২০১৯ বৃহস্পতিবার

লক্ষ্মীপুর জেলার সব উপজেলায় এখন সর্বত্র ছেলেধরা আতঙ্ক বিরাজ করছে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু কুচক্রী গুজব ছড়িয়ে ভীতি তৈরি করার ফলে শিক্ষার্থীদের স্কুলেও পাঠাচ্ছেন না অনেকে। আবার স্কুলে পাঠালেও তাদের সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছেন অভিভাবকরা। সচেতনতার অভাবে এমন গুজবের ফলে দিন দিন স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমছে। অন্যদিকে সন্দেহভাজন অনেক নিরাপরাধ মানুষকে আটক করে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে একাধিক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আবার কেউ না বুঝেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের টাইমলাইন ও মেসেঞ্জারে বিভিন্ন শিশু অপহরণের গুজব শেয়ার করছেন। যেসব বার্তায় উল্লেখ থাকতে দেখা যাচ্ছে, ‘বাংলাদেশের পদ্মাসেতু নির্মাণ চলছে তাই সেতু শক্ত করতে ১,০০,০০০ বা তার অধিক পরিমাণে মানুষের মাথা প্রয়োজন। পদ্মা সেতুর কাজ চালাতে তাই চীনা কোম্পানি সারা বাংলাদেশ থেকে ৪২টি দল বের হয়ে মাথা সংগ্রহ করছে। এরা পথে ঘাটে খেলার মাঠে হাট-বাজারে ইত্যাদি জায়গাই ঘুরে বেড়ায়। এদের কাছে আছে ধারালো ছুরি এবং বিষাক্ত গ্যাস, যা ১০-১৫ হাত দূর থেকে স্প্রে করলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে। বিশেষত, রাতে ও বিকালে নির্জন এলাকায় এটা বেশি হয়। তাই বাসায় কোনো ভিক্ষুক বা অপিরিচিত কেউ আসলে দরজা খুলবেন না। সকলকে সাবধান করুন। কেউ অবহেলা করবেন না মেসেজটি প্লিজ শেয়ার করে অন্যের জীবন বাঁচান।’

সব মেসেজের নিচে লেখা থাকে ‘টিম আন্ডার কাভার ৭৫০’।

এসব বার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। আর গ্রামের অনেক অসচেতন মানুষ তা যাচাই বাচাই না করে এসব বিশ্বাস করছেন। এর ফলে যেসব পরিবারে ছোট স্কুলে পড়ুয়া শিক্ষার্থী রয়েছে, তারা অজানা কারণেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। এমন গুজবের সচেতনতা তৈরির জন্য স্থানীয় প্রশাসনের এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

এদিকে স্থানীয়রা প্রায় ছেলে ধরা সন্দেহে অনেক নিরীহ ব্যাক্তিদের ধরে মারধরও করছেন। যার কারণে এমন আতঙ্ক আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা বলছে ছেলে ধরা সন্ধেহে আটককৃত অধিকাংশই মানসিক ভারসাম্যহীন।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৪ জুলাই লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ২নং দক্ষিণ হামছাদি ইউনিয়নের পশ্চিম গোপিনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী মিথিলা (৬) কে অজ্ঞাত পরিচয়হীন এক যুবক স্কুল থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে জনতার হাতে ধরা পড়ে। পরবর্তীতে জনতা ও স্কুলছাত্রীর বাবা মাসুদ আলম মিলে উক্ত (ছেলে ধরা) সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে পুলিশের হাতে তুলে দেন।

যাদের এভাবে ধরা হচ্ছে এরা কতটুকু ছেলে ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন প্রত্যক্ষদর্শী একজন লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার ৩নং দালাল বাজার ইউনিয়নের রুবেল হাসনাত।

যিনি বলেন, এরা যখন ধরা পড়ে তখন তারা পাগল, উন্মাদের অভিনয় করে। তবে তাদের সন্দেহ থেকেই সবাই আটক করেছে।

লক্ষ্মীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আজিজুর রহমান বলেন, ছেলে ধরা চোর অভিযোগে এক যুবককে স্থানীয়রা আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে। তবে যতটুকু বুঝেছি এই ছেলেটি বিকৃত-মস্তিক সম্পন্ন ব্যক্তি। সে নিজের নামও বলতে পারে না ঠিকমত। এগুলো গুজব ছাড়া কিছু না।

অন্যদিকে রায়পুর উপজেলার সীমান্তবর্তী সদর উপজেলাধীন মাইলের মাথা নামক স্থানে ছেলে ধরা সন্দেহে অজ্ঞাত আরেক  বৃদ্ধকে গনপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে স্থানীয়রা।

গত ৮ জুলাই  সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সদর উপজেলার দালাল বাজার ইউপির মাইলের মাথা এলাকায় স্থানীয় জয়নাল নামে এক ব্যক্তির শিশু মেয়েকে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগে স্থানীয়রা তাকে আটক করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন ওই বৃদ্ধকে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতর আহত করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয়রা আহত ব্যক্তিকে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।

এ বিষয়ে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম আজিজুর রহমান মিয়া জানান, ছেলেধরা সন্দেহে এক বৃদ্ধকে গনপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। লোকটি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে মনে হচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কেউই সরাসরি কাউকে হাতে নাতে আটক করতে পারেননি।  সবাই শুধু ছেলে ধরার কথাই শুনেছেন।

অন্যদিকে সচেতনতার অভাবে ক্রমেই এসব গুজবে ভীতি তৈরি হওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে ভয় পাচ্ছেন। এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মহাদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শরিফ হোসেন বাচ্চু বলেন, ইদানিং ছেলে ধরা আতঙ্কের কারণে অভিভাবকরা বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছে। এছাড়া অনেকে অফিস না গিয়ে বা নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ না করে বাচ্চাদের সঙ্গে স্কুলে আসছেন।

বাংগাখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক শামছুন নাহার বেগম জানান, ছেলে-মেয়ে ধরে নেওয়ার আতঙ্কে তাঁর বিদ্যালয়ে বেশ কয়েকজন অভিভাবক স্কুল ছুটির পূর্বে স্কুলে আসেন। পরে তারা সন্তানকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরেন। ছেলে ধরার আতঙ্ক নিয়ে সদর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই অবস্থা বিরাজ করছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমছে।  

এমন ছেলেধরা আতঙ্ক ও সন্দেহভাজন হিসেবে যাকে তাকে ধরে মারধরের বিষয়ে  লক্ষ্মীপুরের পুলিশ সুপার আ স ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, আটককৃতদের বেশির ভাগই মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই গুজবে কান না দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য অভিবাবকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। 

সচেতনতা তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এসব ঘটনার একটিরও কোনো সত্যতার প্রমাণ পায়নি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি জানান, মাঠ পর্যায়ে এ নিয়ে সার্বক্ষণিক কাজ করছে পুলিশ। আমরা অভিভাবক ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আশ্বস্ত করছি এবং এ ধরনের গুজব যাতে বিশ্বাস না করা হয়। আমরা সবাইকে সতর্ক হতে বলবো কিন্তু আতঙ্কিত নয়।

পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমি মনে করি, পুলিশকে ব্যস্ত রাখার কৌশল কিংবা পদ্মাসেতুর বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হতে পারে। মনে রাখতে হবে এরকম একটা ঘটনা ঘটলে তা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল হয়ে যায়। অপপ্রচারকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে কাজ চলছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

এনএম//