ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

ঘুম নিয়ে যাতনা দূর হবে যেভাবে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৩:০৪ পিএম, ১২ জুলাই ২০১৯ শুক্রবার

১০-১২টি কোম্পানির মালিক মাহমুদ চৌধুরী (ছদ্মনাম)। অর্থ-বিত্ত সব কিছু আছে তার। জীবনে কোন কিছুরেই অভাব নেই। তবে সারাদিন ব্যাস্ত সময় পার করতে হয় তাকে। দিন শেষে যখন রাতে বাসায় ফিরে বিশ্রামের চিন্তা করেন। আর বিছানায় শুয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে একটি প্রশান্তির ঘুমের ডুবিয়ে রাখতে চান, তখনি ঘটে বিপত্তি। কারণ কোনোভাবেই চেষ্টা করে তিনি ঘুমের দেখা পান না।

বিশ্বে এমন বহু মানুষ রয়েছে যারা ঘুমের সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধে নামতে হয় প্রতিনিয়ত। আর এসব সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।  এমনকি বিশ্বে তৈরি হয়েছে ঘুম চিকিৎসা কেন্দ্র। আর সেই যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের জেলিকোতে অবস্থিত আপালাচিয়ান স্লিপ ডিসঅর্ডার সেন্টারের শাখা এখন বাংলাদেশেও রয়েছে। যেখানে ঘুম সমস্যায় ভোগা মানুষ ঘুমোতে যায়।    

অন্যদিকে ঘুম না আসার কারণে অনেককেই বিভিন্ন ঘুমের ওষুধও খেতে দেখা যায়। আবার সে ওষুধ কাজ না করলে মাদকের দিকেও অনেকে ঝুঁকে  পড়ে।

মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত, বিষণ্ন, কোনো কারণে দুশ্চিন্তা বা শারীরিক কোনো সমস্যা, বিশেষ করে হরমোনজনিত রোগের ক্ষেত্রে সাধারণত ঘুমের সমস্যা হয়ে থাকে। শরীর ও মনের মধ্যে থাকা চাপা চাপগুলো সরিয়ে ফেলতে না পেরে দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধের দ্বারস্থ হন অনেকে। অজান্তে কখন এই অভ্যাস আসক্তিতে রূপ নেয় বোঝাই যায় না। অনেকে ভাবেন, ঘুমের ওষুধই তো খেয়েছি, নেশা তো করিনি। এই ভুল ধারণা ডেকে আনে বিপত্তি।

ঘুমের সমস্যা, ঘুমের ওষুধ নগরজীবনের সঙ্গে লেপটে আছে। ছোট্ট একটি লাল, নীল বা সাদা রঙের ওষুধের দিকে ঝুঁকে পড়ি আমরা। এভাবেই শরীর একসময় ঘুমের ওষুধে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন ওষুধ না খেলে ঘুম আসতে চায় না। অযথা ঘুম নিয়ে ভয়ে ভীত হয়ে খেয়ে ফেলেন ঘুমের ওষুধ। নিয়ম থাকা সত্ত্বেও অনেক ওষুধ বিক্রেতাই চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ঘুমের ওষুধ বিক্রি করেন, যা আমাদের দেশে বেশ সহজলভ্য। সবচেয়ে শঙ্কিত হওয়ার কথা হলো এই যে, গত কয়েক বছরে গাঁজা, ইয়াবার পাশাপাশি ঘুমের ওষুধ খাওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ঘুমের ওষুধ অজান্তেই জন্ম দিয়েছে নেশাতুর মানুষের।

ঘুম কী?

দিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ঘুম হচ্ছে সেই সময় যখন আমরা আমাদের চারপাশ সম্বন্ধে অবহিত থাকি না। প্রধানত দুধরনের ঘুম হয়ঃ

রেম

সারা রাতের পাঁচ ভাগের এক ভাগ আমাদের এই ঘুমে কাটে। রেম ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক সজাগ থাকে, আমাদের মাংসপেশি শিথিল থাকে, আমাদের চোখ এদিক থেকে ওদিকে ঘুরতে থাকে এবং আমরা স্বপ্ন দেখি।

নন রেম

এই ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় থাকে, তবে শরীর নড়াচড়া করতে পারে। এই সময় হরমোন নি:সৃত হয় এবং দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে শরীর আবার সতেজ হয়ে ওঠে। নন রেম ঘুমের চারটি স্তর আছে।

১। ঘুমের আগের স্টেজ - মাংসপেশি শিথিল হয়, হৃদস্পন্দন কমে আসে, শরীরের তাপমাত্রা কমে।

২। হাল্কা ঘুম - এই স্টেজে সহজেই ঘুম ভেঙ্গে যায়, চারপাশ সম্বন্ধে স্বাভাবিক সচেতনতা থাকে।

৩। ‘স্লো ওয়েভ ঘুম’ – ব্লাড প্রেসার কমে, এই স্টেজে লোকে ঘুমের ঘোরে হাটে বা কথা বলে।

৪। গাঢ় ‘স্লো ওয়েভ ঘুম’ – ঘুম সহজে ভাঙতে চায় না। ভেঙ্গে গেলে চারপাশ সম্বন্ধে স্বাভাবিক সচেতনতা থাকে না।

আমরা রাতে রেম এবং ননরেম ঘুমের মধ্যে থাকি, অন্তত পাঁচবার এই স্টেজগুলি ঘুরে ঘুরে আসে। সকালের দিকে আমরা বেশি স্বপ্ন দেখি।

রাতে আমাদের ঘণ্টা দুয়েক বাদে বাদে মিনিট খানেকের জন্য ঘুম ভাঙতে পারে। এটা আমাদের সবসময় মনে থাকে না। এগুলি আমাদের মনে থাকে যদি আমরা চিন্তায় থাকি, কিংবা অন্য কোনো অসুবিধা হয় (যেমন অন্য কেউ যদি নাক ডাকায় বা বাইরে যদি কোনো আওয়াজ হয় ইত্যাদি)।

কতটা ঘুম আমাদের দরকার?

এটা প্রধানত আমাদের বয়সের উপর নির্ভর করে।

 ছোট শিশু দিনে সতের ঘন্টা ঘুমোয়।

 একটু বড় হলে তারা রাতে আট নয় ঘন্টা ঘুমোয়।

 প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারনতঃ সাত আট ঘন্টা ঘুম লাগে।

বেশি বয়স হলে একই রকম ঘুম দরকার হয়। তবে তাদের রাতে সাধারনতঃ একবার ভালো ঘুম হয়, প্রথম রাতে ঘন্টা তিন চারের জন্য। তারপর তাদের ঘুম সহজে ভেঙ্গে যায়।বেশি বয়সে লোকে স্বপ্ন কম দেখে।

একই বয়সের লোকের মধ্যেও ঘুমের তারতম্য হয়। বেশির ভাগ মানুষের সাত বা আট ঘণ্টা ঘুমোন। অল্পসংখ্যক কিছু মানুষের শুধুমাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। নিয়মিত সাত আট ঘণ্টার বেশি রাতে ঘুমানো ভালো নয়।

ঘুমের মধ্যে অল্প যে সময় আমরা জেগে থাকি সেই সময়টাকে অনেকটা দীর্ঘ মনে হয়। কাজেই আমাদের মনে হয় যে আমাদের যথেষ্ট ঘুম হয়নি।

ঘুম না হলে কী হবে?

ঘুম না হলে দুশ্চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক। এক আধ রাত না ঘুমোলে পরদিন ক্লান্ত লাগবে, কিন্তু এতে আপনার শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হবে না।

কিন্তু বেশ কয়েক রাত ঘুম না হলে, আপনি দেখবেনঃ

 সবসময় ক্লান্ত লাগছে

 দিনের বেলা চোখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে

 মনঃসংযোগ করতে অসুবিধা হচ্ছে

 সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হচ্ছে

 মন খারাপ লাগছে

গাড়ী চালালে বা মেশিন চালালে এতে অসুবিধা হতে পারে। প্রতি বছর বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটে মানুষ গাড়ী চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়বার ফলে।

ঘুমের অভাবে দরুন আমাদের ব্লাড প্রেসার বাড়া, ওজন বাড়া এবং ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

ইসলামের দৃষ্টিতে ঘুম:

ঘুম আল্লাহ তাআলার একটি বিশাল নেয়ামত , এর মাধ্যমে তিনি নিজ বান্দাদের উপর বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। এবং তাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। আর নেয়ামতের দাবি হল শুকরিয়া আদায় করা তথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন : তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্যে রাত ও দিন করেছেন যাতে তোমরা রাত্রে বিশ্রাম গ্রহণ কর ও তার অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী।

দিনের ক্লান্তিকর চলাফেরার পর রাত্রে শরীরের প্রশান্তি শরীর সুস্থ থাকাকে সাহায্য করে। অনুরূপভাবে শরীরের বর্ধন এবং কর্ম চাঞ্চল্যতেও সাহায্য করে। যাতে করে ঐ দায়িত্ব পালন করতে পারে যার জন্য আল্লাহ তাআলা তাকে সৃষ্টি করেছেন।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে যা কিছু অতি জরুরী ঘুম তার অন্যতম। মুমিন বান্দা যদি ঘুমের মাধ্যমে দেহ ও মনকে আরাম দেওয়ার নিয়ত করে , যাতে করে সে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের বিষয়ে আরো দৃঢ় হতে পারে। অতঃপর ঘুমের সমস্ত সুন্নত ও শরয়ী আদব পরিপূর্ণ রূপে পালন করার চেষ্টা করে , তবে তার ঘুম এবাদত হিসাবে পরিগণিত হবে এবং সে পুণ্য লাভ করবে।

সাহাবী মুআয বিন জাবাল রা. বলতেন: আর আমি (রাতে) ঘুমাই এবং জাগ্রত হয়ে সালাত আদায় করি, জাগ্রত থেকে সালাত আদায়ের মাধ্যমে যেভাবে ছাওয়াবের আশা করি ঠিক তেমনি করে ঘুমানোর মাধ্যমেও ছাওয়াবের আশা করি। ইবনে হাজার র. বলেন এর অর্থ হল: তিনি আরামের ভিতর পুণ্য আশা করতেন যেমন কষ্টের ভিতর আশা করতেন। কেননা, আরামের উদ্দেশ্য যদি এবাদত করার জন্য সাহায্য সঞ্চয় করা হয়, তবে সে আরামের দ্বারা পুণ্য হবে। এখানে মুয়ায ইবনে জাবাল রা.-এর জাগ্রত হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হল রাতের নামাজ।