সমাজ-বিচ্যূত সম্প্রদায়ের জন্য `নতুন ধারণা`র উদ্ভাবন
বেরোবি প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ১০:৩৮ পিএম, ১৫ জুলাই ২০১৯ সোমবার
মূল পেশা ছিল সাংবাদিকতা, সতের বছরের ক্যারিয়ার। সর্বশেষ ছিলেন প্রধান ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এর মেট্রো এডিটর।সাংবাদিকতার পাশাপাশি গবেষক হিসেবেও স্বীকৃতি পাবেন বা সফল হবেন এমন উদ্দেশ্যও ছিল না।গবেষণাও যে তাঁর পেশা ও নেশা এটা তিনি কাউকে প্রকাশও করেননি। কিন্তু সম্প্রতি তিনি গবেষণার মাধ্যমে নতুন এক ধারণা 'সমাজ-বিচ্যূত সম্প্রদায়ের জন্য ডিজিটাল সামাজিক মিথস্ক্রিয়া' উদ্ভাবন করেছেন এবং স্বীকৃতি পেয়েছেন।এ উদ্ভাবক হচ্ছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি)-এর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাহামুদুল হক।
টরেন্টো ইউনিভাসির্টিতে এক আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে মিডিয়া গুরু মার্শাল ম্যাকলুহান-এর শিষ্যদের দ্বারা পরিচালিত মিডিয়া ইকোলজি অ্যাসোসিয়েশনের “মিডিয়া নীতি: যোগাযোগীয় বিশ্বে মানবিক প্রতিবেশ” শীর্ষক চার দিনব্যাপী কনভেনশন-এর তৃতীয় দিন গত ২৯ জুন মার্শাল ম্যাকলুহান-এর প্রোপুত্র এ্যান্ড্রু ম্যাকলুহান মাহামুদুল হকের পক্ষে ওই ধারণাটি উপস্থাপন করেন।
শিক্ষক মাহামুদুল হক অনিবার্য কারণশতঃসরাসরি যোগ দিতে পারেননি।যদিও তিনি একমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে থেকে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন।
মাহামুদুল-হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান “গবেষণার মাধ্যমে আমার উদ্ভাবিত নতুন ধারণা প্রচলিত সামজিক মিথস্ক্রিয়ার বিকল্প হিসেবে(সমাজ-বিচ্যূত সম্প্রদায়ের জন্য ডিজিটাল সামাজিক মিথস্ক্রিয়া) আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে মার্শাল ম্যাকলুহানের শিষ্যদের দ্বারা জাস্টিফাইড হয়েছে।আমার এ ধরণার প্রয়োগে হিজড়া জনগোষ্ঠীসহ সমাজ-বিচ্যূত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।আমি এর পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব দাঁড় করাতে কাজ করে যাচ্ছি।”
এদিকে এ্যান্ড্রু ম্যাকলুহান তাঁর এ গবেষণাকে “গ্রেট ওর্য়াক” হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং সেই সঙ্গে তার এ উদ্ভাবন উপস্থিত পন্ডিতদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কীভাবে এ ধারণা পেলেন -এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহামুদুল হক বলেন, আমি ২০১৮ সালে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ এবং ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম এন্ড কমিউনিকেশন-এর হিজড়া জনগোষ্ঠী বিষয়ক যৌথ গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক হিসেবে কাজ করার সময় এ ধারণাটির ক্লু পাই। পরবর্তীতে আলাদাভাবে আমি আরেকটি গবেষণা করি ধারণাটির জাস্টিফিকেশনের জন্য। এরপর টরেন্টো ইউনিভার্সিটির ওই কনফারেন্সে ধারণাটি উপস্থাপন করলে তা সকলের প্রশংসা অর্জন করে। এখন এ বিষয়ে আরেকটি গবেষণার প্রয়োজন যা থেকে একটি তত্ত্বের উন্নয়ন ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস।এ তত্ত্ব প্রমাণিত হলে হিজড়াদের মতো সমাজ-বহির্ভুত সম্প্রদায়গুলোর জীবনমান উন্নয়নে কাজে আসবে। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্থের প্রয়োজন।
এই গবেষক জানান, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে “গবেষণা ক্লাব” চালু করার পরিকল্পনা আছে আমার। জিজিটাল যুগে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বিশ্বমানের গবেষণা করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণ করা সম্ভব। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষকগণ শিক্ষাদান ও গবেষণার বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে ক্যাম্পাস-ভিত্তিক রাজনীতির দিকে বেশি মনোযোগী হচ্ছেন। একাডেমিশিয়ান যখন পলিটিশিয়ান হয়ে যান তখন বিদ্যায়তনিক প্রতিবেশ ধ্বংস হতে বাধ্য।
তবে এত অল্প সময়েই কিন্তু তিনি গবেষক হননি।তাঁর গবেষণার হাতে খড়ি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে। আর মার্স্টাস থিসিসে তিনিই বাংলাদেশে প্রথম মানুষের সচেতনতা-জ্ঞান-দৃষ্টিভঙ্গি-আচরণ পরিমাপে “কমিউনিকেশন সার্ভে রির্সাচ” পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করলেও এর পাশাপাশি গবেষণাও চালিয়ে যান।
তিনি ইউকে-ভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর কর্পোরেট অ্যাকাউন্টিবিলিটি কর্তৃক পরিচালিত বাংলাদেশ ওর্য়াকাস সেইফটি প্রোগামের (পরে সেইফটি অ্যান্ড রাইটস নামে নিবন্ধিত) গবেষক ছিলেন। এছাড়া সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের কয়েকটা গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ পিয়ার রিভিউ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণার আগ্রহের বিষয় স্বাস্থ্য যোগাযোগ, সাংবাদিকতা, নয়া মাধ্যম, শ্রম অধিকার, মানবাধিকার প্রভৃতি।
তিনি তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক কনফারেন্সে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যোগাযোগ মডেল-এর উন্নয়নেও কাজ করছেন।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও বেশ অবদান রেখেছেন মাহামুদুল হক। তিনি তাঁর “সাংবাদিকতাঃ অফলাইন অনলাইন” গ্রন্থে সাংবাদিকতার নতুন ধারণা ও উদ্ভাবনীসমূহের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন এবং নয়া মাধ্যমের যুগে সংবাদ ব্যবস্থাপকদের 'সংবাদ প্রকৌশলী' অভিধায় অভিহিত করেছেন। এ প্রপঞ্চটি তাঁরই সৃষ্টি।
চাঁপাইনবাগঞ্জের অধিবাসী মাহামুদুল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি মানবিক বিভাগে থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজে রের্কড পরিমাণ নম্বর পান।
তিনি একাধারে সাংবাদিক, প্রশিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী, গবেষক, লেখক ও শিক্ষক। তিনি জ্ঞানসৃজনকারী প্রতিষ্ঠান নলেজ ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠাতা।
এনএস/কেআই