ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

‘দখল মুক্ত করে প্রযুক্তির মাধ্যমে নদী দূষণরোধ করব’

মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্রকাশিত : ০১:৪০ পিএম, ১৮ জুলাই ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:৪২ পিএম, ১৮ জুলাই ২০১৯ বৃহস্পতিবার

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরের নদীগুলো দখল মুক্ত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকার বুড়িগঙ্গাকে দখল মুক্ত করতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) অভিযান পরিচালনা করছে।

ঢাকা নদীবন্দরের মূখ্য কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন ঢাকা’র নদীসমূহকে দখলমুক্ত করতে অভিযানসমূহ পরিচালনা করছেন। এর আগে তিনি নারায়নগঞ্জ, চাঁদপুর ও খুলনায় কাজ করেছেন। 

নদী দখল মুক্ত করতে উচ্ছেদ অভিযান ও অভিযান পরবর্তী পরিকল্পনা ও কার্যক্রম নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ। 

একুশে টেলিভিশনের পাঠাকদের জন্য তার এই স্বাক্ষাৎকারের বিশদ অংশ তুলে ধরা হলো-

একুশে টেলিভিশন: নদী দলখমুক্ত ও পরবর্তী কর্যাক্রম নিয়ে কি কোন মহাপরিকল্পনা আছে?

এ কে এম আরিফ উদ্দিন: অবশ্যই আছে। এটা বিশদ এক পরিকল্পনা যা বাস্তবায়ন করা গেলে ঢাকার নদীগুলো তার আগের অবস্থা ফিরে পাবে। 

একুশে টেলিভিশন: নদী দখল মুক্ত করার কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।

এ কে এম আরিফ উদ্দিন: ঢাকা শহরে আমরা নদী দখল মুক্ত করতে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালাচ্ছি। ঢাকা পাঁচটি নদী দ্বারা বেষ্টিত। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদী ঢাকা আর শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদী নারায়নগঞ্জ বিআইডব্লিউটিএ’র অধীনে। আমরা নদীকে দখল মুক্ত করতে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ (৩৫০৩/২০০৯) পেয়ে কাজ করছি। আমরা চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি বুড়িগঙ্গা নদীতে এ উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করি। আগামী কয়েকটি কর্মদিবস অথাৎ ২৫ জুলাই আমাদের অভিযান শেষ হবে। এর মধ্যেই বুড়িগঙ্গা নদী পুরোপুরি দখল মুক্ত করতে পারব। উচ্ছেদ অভাযানের পরেও বেশ কয়েকটি কার্যক্রম আমাদের হাতে রয়েছে। নদী দখলমুক্ত যেন স্থায়ী হয় এ জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। 

একুশে টেলিভিশন: নদী দখল মুক্ত করার পরে ফের দখল ঠেকাতে আপনাদের পদক্ষেপ কি?

এ কে এম আরিফ উদ্দিন: অভিযান চালানোর পরে নদীকে যেন দখলদাররা ফের দখল করতে না পারে এ জন্য আমরা কয়েক ধাপে কাজ করছি। নদীকে দখল মুক্ত করার পর আমার নদীর সীমানা পিলার নির্মাণ করছি। এ সীমানা পিলারের ৩৫ ফুট থাকবে মাটির নীচে এবং ১৬ ফুট থাকবে মাটির উপরে। এরপর আমরা ওয়াকওয়ে নির্মাণ করব। ফলে ঐ স্থান দখল হওয়ার সম্ভাবনা আর থাকবে না। এতে ওয়াকওয়ের জন্য ৮ ফুট এবং পিলারের জন্য ১২ ফুট জায়গা লাগবে। অন্যান্য স্থানগুলো যার পরিধি আরও বেশি সেই স্থানকে আমরা নদীর সঙ্গে মিলিয়ে দেব। সরকারীভাবে আমার বিশেষ বিশেষ স্থানে মানুষের বিনোদনের জন্য পার্ক বা উদ্যান তৈরি করা হবে। এ জন্য অনেক প্রকল্পও হাতে নেওয়া হবে। আর এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের একত্রে কাজ করতে হবে। আমরা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতা পাচ্ছি। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতা ছাড়া আমাদের একার পক্ষে কাজ করা সম্ভব ছিল না। 

একুশে টেলিভিশন: নদী দখলমুক্ত করার অভিযান পরিচালনায় কোন প্রতিবন্ধকতা আছে কি-না? থাকলে সেটা কী? 

এ কে এম আরিফ উদ্দিন​​​​​​​: কিছুটা প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই। তবে আমরা কোন প্রতিবন্ধকতার কাছেই এবার নতি স্বীকার করিনি। আর সকল প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতা থাকায় আমাদের জন্য এ কাজ সহজ হয়েছে। তবে গণমাধ্যমের ইতিবাচক সহযোগীতার ফলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়েছে। গণমাধ্যম তো একটা জনমত গঠন করতে পারে। গণমাধ্যম যে জনমত গঠন করেছিল তা এ অভিযান পরিচালনার জন্য বেশ কার্যকরী ছিল। সব চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল যারা নদী ভরাট করেছেন তাদের সামাজিক অবস্থান। তবে এবার আমরা কোন কিছুতেই পিছপা হইনি।

একুশে টেলিভিশন: অভিযান পরিচালনার সময়ে স্থানীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া কি?

এ কে এম আরিফ উদ্দিন​​​​​​​: আমরা যখন অভিযান পরিচালনা করি তখন সেখানে দেখেছেন অনেক স্থানীয় জনগণ উপস্থিত হয়। তারা অভিযানের জন্য আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানায়। জনগণ চায় এ দখলদারদের সমূলে উচ্ছেদ করতে। জনগণ আমাদের সহযোগীতা না করলে আমাদের জন্য কাজ কঠিন হতো। যারা মুক্ত প্রান্তর বন্ধ করে এ অবৈধ কাজ করছে তাদের কার্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণ তো থাকবেই। 

একুশে টেলিভিশন: এ পর্যন্ত যত অভিযান পরিচালনা করেছেন, যাদের স্থাপনা উচ্ছেদ করেছেন তাদের সামাজিক অবস্থান জানতে চাচ্ছি।

এ কে এম আরিফ উদ্দিন​​​​​​​: নদীর এ অবৈধ দখলে সমাজের সব শ্রেণির লোকজনই রয়েছে। দখলদারের মধ্যে আমরা সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ীকে পেয়েছি। বিশেষ করে বাংলাদেশে কিছু প্রভাবশালী গ্রুপ অব কোম্পানিজ রয়েছে তাতে তাদের স্থাপনা উচ্ছেদ করা বেশ কঠিন ছিল। তাদের সামজিক অবস্থান ও আধিক অবস্থানের কারণে তার প্রভাব তো আপনি আঁচ করতে পারেন। তাদের স্থাপনাগুলো সরানোই বেশ কঠিন ছিল।

একুশে টেলিভিশন: এই দখলদারদের মধ্যে সরকারী সাবেক আমলারা ছিলেন কিনা? 

এ কে এম আরিফ উদ্দিন​​​​​​​: দখলদারদের মধ্যে সরকারী সাবেক আমলাদেরও পেয়েছি। 

একুশে টেলিভিশন: সরকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতা কেমন পাচ্ছেন?

এ কে এম আরিফ উদ্দিন: সরকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতা ছাড়া এ কাজ প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ অভিযান তো আমরা একা পরিচালনা করতে পারব না, এখানে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগীতা সরাসরি প্রয়োজন এবং আমরা তা পাচ্ছি। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতা আমরা পাচ্ছি। 

একুশে টেলিভিশন: উচ্ছেদকৃত স্থানসমূহকে আপনারা কিভাবে কাজে লাগাচ্ছেন? 

এ কে এম আরিফ উদ্দিন: উচ্ছেদকৃত স্থানগুলোকে কাজ লাগাতে আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনা করছি। শুরুতেই বলেছি আমাদের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নদী আর দখল হবে না। 

একুশে টেলিভিশন: নদীতে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার কারণে পরিবেশ দূষণ রোধে আপনাদের পদক্ষেপ কি? 

এ কে এম আরিফ উদ্দিন​​​​​​​: আমাদের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে যেন পরিবেশ কোনভাবেই দূষিত না হয় সে দিকটা আমরা ভালোভাবেই বিবেচনা করছি। আমরা উচ্ছেদের পরে ভবন বা স্থাপনার ভাঙ্গা অংশ সরিয়ে ফেলছি। এতে সিটি কর্পোরেশন সহযোগিতা করছে। এছাড়া কিছু কিছু উপাদান আমার নিলামে বিক্রয় করে দিচ্ছি। ধ্বংসাবাশেষের কারণে দূষণ না হয় সে দিকে আমার বিশেষ নজর রাখছি। 

একুশে টেলিভিশন: পরবর্তী পরিকল্পনা কি? 

এ কে এম আরিফ উদ্দিন​​​​​​​: আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা অনেক বড়। নদীকে তো শুধু দূষণ মুক্ত করলেই হবে না। নদীগুলোকে সেই আগের মত অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে আমাদের কাজ করতে হবে। দূষণমুক্ত করে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে ১০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। সেখানে মধ্যমেয়াদি নানা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ঢাকার নদীগুলো প্রাণ ফিরে পাবে। 

একুশে টেলিভিশন: এ অভিযান পরিচালনার দলে নদী বা জলবায়ু বিশেষজ্ঞ রয়েছেন কিনা?

এ কে এম আরিফ উদ্দিন: অভিযান তো সরাসরি মাঠে পরিচালনা করতে হয়। এ দলে নদী বা জলবায়ু বিশেষজ্ঞ দরকারও হয় না। এটা নীতি নির্ধারণে দরকার হয়, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন। তবে যারা নদী দখল করে তাদের কাছে কোন বিশেষজ্ঞের মত নিয়ে দখল করেনি। এখানে আমাদের চাপ প্রয়োগ করতে হয়। নদী দখলের ক্ষেত্রে তারা তো কোন নোটিশ দিয়ে নদী দখল করেনি তাহলে আমরা কেন তাদের উচ্ছেদ করার সময়ে নোটিশ দিব। আমরা আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এ ক্ষেত্রে কেউ চাইলে মহামান্য হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ আনতে পারে। 

নদী নিয়ে তো বেশ গবেষণা হলো এখন আর দরকার আছে বলে আমি মনে করি না। এখন তা বাস্তবায়ন করার পালা। আমরা এখন প্রযুক্তির দিকে নজর দিচ্ছি। আমরা দেখছি উন্নত শহর যেমন লন্ডন, টোকিও, চীনের বিভিন্ন শহর, ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরের নদীগুলোকে কোন প্রযুক্তি দিয়ে তারা সুন্দর করেছে তা প্রয়োগ করতে চাচ্ছি। আমরা ঐ সব বিশেষজ্ঞ এনে কাজ করাব। 

এমএস/