ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি নয়, দরকার সমন্বিত উদ্যোগ 

আজাদুল ইসলাম আদনান

প্রকাশিত : ০৫:৩৮ পিএম, ২৬ জুলাই ২০১৯ শুক্রবার

দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ নতুন কিছু নয়। ২০০০ সালে প্রথম এ রোগের মহামারি দেখা দেয়। সে বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ৯৩ জন। যা ভাবিয়ে তুলেছিলো সবাইকে। দেশের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, সিটি কর্পোরেশনসহ এ বিষয়ে কাজ করা প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান আতঙ্কিত হয়েছিল। তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল কিন্তু তা কেবল নামমাত্র। এর প্রধান কারণ ছিলো সমন্বিত উদ্যোগের অভাব। বলা যায় তা নিয়ন্ত্রণে যতোটা হাকডাক হয়েছিল সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। 

দেড়যুগ পরও আজ একই অবস্থা। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আগের অবস্থারই যেন পুনরাবৃত্তি দেখছে বাংলাদেশ। যাদের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা তারা ব্যস্ত দায় এড়াতে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্তারা শুধু জনসাধারণের সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন না। তারা এখন এটাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। 

একদিকে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বলছেন ডেঙ্গু নিয়ে ছেলেধরার মতোই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অন্যদিকে স্বাস্থমন্ত্রী বলছেন এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা রোহিঙ্গাদের মতোই। তাহলে এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায় নেই? উপায় একটাই, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি নয়, চাই সমন্বিত কার্যকরি উদ্যোগ।

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ব্যাপকহারে রোগী আসায় হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এমনকি সিট না থাকায় অনেক রোগীকে ফেরত পাঠাচ্ছেন তারা। 

আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্যবারের তুলনায় এবারের সংখ্যাটা অনেক বেশি। যা গত বছরের তুলনায় পাঁচগুন। হাসপাতালগুলোতে এমনও রোগী আছেন যারা দ্বিতীয়, তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়ে আসছেন। তাদের  অবস্থা আরোও জটিল। এবারের ডেঙ্গুতে ছড়াচ্ছে ৩ নম্বর প্রজাতির মশাগুলো। যেগুলোর কারণে রোগের জটিলতা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। 

সবমিলিয়ে এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় উদ্বেগজনক ও জটিলতার দিকগুলো অনেক বেড়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। কারণ আগে ডেঙ্গু হলে জ্বর, মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতো। তবে এবার লক্ষণগুলো অন্যরকম। যেমন কেউ তীব্র পেট ব্যথা নিয়ে আসছেন, কারো বেড়েছে হার্টের সমস্যা। আবার কারও ব্রেনে অ্যাফেক্ট করেছে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘন্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫৪৭ জন। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৫৬৫ জন মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে কেবল জুলাই  মাসেই রেকর্ড ৬ হাজার ৪২১ জন হাসপাতালে গেছেন। 

কিন্তু আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই হাসপাতালে যান না এবং যারা যান তাদের মধ্যে ২ শতাংশ তথ্য সরকারি নজদারিতে আসে এমন যুক্তিতে একটি জাতীয় দৈনিকে মশাবাহিত রোগীর সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ বলে প্রকাশ পায় । যদিও এ হিসেবকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। চলতি বছরে স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া তথ্যমতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৮ জন। আর বেসরকারি তথ্যমতে মৃতের সংখ্যা ২০ জনে পৌঁছেছে। 

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। দুই সিটি থেকে অনেকরকম ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু কোনো কিছু যেন কাজে আসছেনা। তবে ডেঙ্গুর এমন প্রকোপকে ভিন্নভাবে দেখছেন কর্তৃপক্ষরা। সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করে উল্টো কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি করা হচ্ছে। অনেকে বলছেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হচ্ছে তা বাস্তবায়নের জন্য যারা দায়িত্বে আছেন তারা সেভাবে নিচ্ছে কিনা সেটাই দেখার বিষয়। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, দেশে যে হারে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে, তা নিয়ন্ত্রণে আগের পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উড়ন্ত মশা কিভাবে নিধন করা যায়, সে ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হবে।  এডিস মশা নিধনের শুধু বাড়ির আশেপাশের এলাকা নয়, বাড়ির ভেতরেও নিধন করার ব্যবস্থা করতে হবে।  এক্ষেত্রে জরুরী ভিত্তিতে লোকবল নিয়োগ ও স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে কার্যকরি ব্যবস্থা গ্রহন করা যেতে পারে। পাশপাশি আমাদেরও সচেতন থাকতে হবে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখান অনুযায়ী ২০০২ সালে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ২৩২ জন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। ২০১৬ সালে হঠাৎ করে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬ হাজার ৬০ জনে বেড়ে যায়। সে বছর ডেঙ্গুতে মারা যায় ১৪ জন। ২০১৭ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৭৬৯ জন।  মারা যায় ৮ জন।
 
এরপর প্রতিবছর আক্রান্তের সংখ্যা কমতে থাকলেও গত বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়। ওই বছর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। মারা যায় ২৬ জন। সে তুলনায় এ বছর আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই, দেশবাসীকে ডেঙ্গুর এ মহামারি থেকে বাঁচাতে হলে কোনো কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ি নয়, চাই সমন্বিত কার্যকরি পদক্ষেপ।

আই/আরকে