ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

গণপিটুনিতে হত্যার বিচার হয় না কেন?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:২৬ পিএম, ২৬ জুলাই ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৪:৩৮ পিএম, ১৯ আগস্ট ২০১৯ সোমবার

২০১১ সালের ১৭ জুলাই সাভারের আমিনবাজারে ৬ ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মারার ঘটনায় বিচার এখনো চলছে। দেশজুড়ে আলোচিত ওই ঘটনার বিচার সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সূত্র মতে, ২০১১ সাল থেকে পরবর্তী আট বছরে দেশে প্রায় আটশ মানুষ গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।

সম্প্রতি পদ্মা সেতু তৈরির জন্য মানুষের মাথা দরকার এমন গুজবে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্নস্থানে ছেলেধরা আতঙ্কের জের ধরে গণপিটুনিতে অন্তত ৭ জন নিহত হয়েছেন। গণপিটুনির প্রবণতা নিয়ে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজীব নন্দী।

তিনি বলছেন, ভারতের বিহার, লক্ষ্মৌ, দিল্লী, আসাম, আগরতলা, কলকাতা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া ও ঢাকার তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। নন্দীর মতে সম্প্রতি 'ছেলেধরা' গুজবের ফলে সৃষ্ট গণপিটুনি অতীতের গণপিটুনির প্যাটার্নগুলোর চেয়ে ভিন্ন।

ভারত-বাংলাদেশ: গণপিটুনিতে মিল আছে বলে জানান রাজীব নন্দী। তিনি বলছেন, ভারত ও বাংলাদেশে গণপিটুনির মাত্রাগত পার্থক্য আছে।

ভারতে গোরক্ষকদের গণপিটুনির শিকার হয় মূলত মুসলিম সম্প্রদায়, যারা ভারতে সংখ্যালঘু। ভারতের এ গণপিটুনি সংস্কৃতির পেছনে রাষ্ট্রীয় নীরবতা একটি বিশেষ উৎসাহ হিসেবে কাজ করে।
তবে বাংলাদেশে গণপিটুনি ও প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা পুরোপুরি ভারতের মতো নয়। বাংলাদেশের ঘটনায় মূলত জনতার প্রতিরোধহীনতা তথা নিষ্ক্রিয়তা অন্যতম দিক।

তিনি বলেন, ‘আমিনবাজারে ৬ ছাত্র, নোয়াখালীতে কিশোর, শাবিপ্রবির দুই ছাত্রকে গণপিটুনি সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করলেও তা ভারতের মতো সুনির্দিষ্ট ইস্যু ভিত্তিক ছিলো না।’

রাজীব নন্দী বলছেন, ভারতে গত ২০১৮ সালের মে-জুন মাসে ছেলেধরা গুজবে হোয়াটসএপের বার্তা বিকৃতির কারণে ১৯ জনকে পিটিয়ে মারা হয়। এক বছর না যেতেই ফেসবুক ও নিউমিডিয়া ব্যবহার করে বাংলাদেশেও চলতি জুন-জুলাই মাসে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির ঘটনা বাড়ছে। 
তিনি বলেন, ‘দুই দেশেই সমাজে জনতার হাতে আইন তুলে নেয়ার প্রবণতা দিনদিন ভয়াবহ হচ্ছে। এবং বাংলাদেশের কিছু কিছু গণপিটুনির ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গণপিটুনির পর জনতা নিজ উদ্যোগে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে ভিকটিমকে।’

কেন এ হত্যার বিচার হয় না? 

রাজীব নন্দী বলেন, ‘দুই দেশেই গত ১০ বছরে চাঞ্চল্যকর ২০টি গণপিটুনির কোন বিচার হয়নি এবং সঠিক তদন্তও হয়নি। গণপিটুনি এবং সামাজিক সহিংসতার জন্য মানুষের নির্বিকার হিংস্র মনোভঙ্গি এবং অপরাপর মানুষের নিষ্ক্রিয়তা অন্যতম দায়ী। দুই রাষ্ট্রই এই গণপিটুনির দায় এড়াতে পারে না।’

আইনজীবী কিংবা এ সব ঘটনার দিকে নজর রাখেন এমন অনেকে বলছেন, ভিকটিম পরিবারগুলো থেকে কেউ এগিয়ে না আসার কারণেও ঘটনার পর বিষয়গুলোর দিকে খুব বেশিদিন কারও নজর থাকে না। আবার পুলিশ বাদী মামলাগুলোতে অনেক অজ্ঞাত আসামী থাকে যেগুলো নিয়ে পরে তদন্ত আর বেশি দুর অগ্রসর হয় না।

তবে মানবাধিকার কর্মী নিনা গোস্বামী বলেছেন, ২০১৮ সালে পুরো বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলো ৩৯ জন আর এবার প্রথম ছয় মাসেই ৩৬ জন নিহত হয়েছে।

গোস্বামী বলেন, ‘এ থেকেই বোঝা যায় যে প্রবণতা কেমন হারে বাড়ছে। এর কারণ হলো এসব ঘটনায় ভিকটিমদের পক্ষে কেউ শক্তভাবে দাঁড়ায় না। মামলাগুলোকে এগিয়ে নেয়া, অপরাধীদের সনাক্ত করার ক্ষেত্রে যদি সরকার দৃঢ় হতো তাহলে এমন পরিস্থিতি হতো না।’

তিনি বলেন, ‘সংঘবদ্ধ হয়ে করলে কোনো শাস্তি হয় না এমন ধারণাও অনেকের মনে আছে এবং সে কারণে তারা এর সুযোগ নেয়। এটা যে অপরাধ। সেই বোধটাই কথিত সংঘবদ্ধদের মাথায় আসে না। বিচার না হওয়ার কারণেই এমন ধারণা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন এখানে সুনির্দিষ্ট আইন আছে কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ হয় না বলেই একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘ধরুন মব হলো, যে কোনো কারণেই হোক। কিন্তু কাউকে আঘাত করলে ও তাতে ইনজুরি হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুনির্দিষ্ট বিধান আছে। আঘাত করলে কোন ধারায় আসবে কিংবা হত্যায় কোন ধারায় আসবে সবই যথেষ্ট নির্ধারিত আছে। আর এগুলো প্রকাশ্যে ঘটে বলে প্রমাণ করাও কষ্টকর কিছু না।’

তিনি বলেন, ‘সমস্যা হলো এসব বিষয়ে নীরবতা কাজ করছে। আর সে কারণেই আইনের প্রয়োগ নেই। আবার বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই মানুষেরও আস্থা নেই।’

নিহত বা ভিকটিমের পরিবার থেকে বিচার চাইতে এগিয়ে না আসা ঘটনার বিচার না হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছে কিনা, এমন প্রশ্নে বড়ুয়া বলেন, ‘অভিযোগ হলো কিনা তা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।’

তার মতে, ‘কেউ খুন হলে কোনো অভিযোগ না আসলেও রাষ্ট্রের দায়িত্ব অপরাধীকে খুঁজে বের করে বিচারের ব্যবস্থা করা। এখন অনেক ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, যারা ঘটাচ্ছে তারাও সাধারণ মানুষ, আবার ভিকটিমও সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে কেউ অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে আবার কেউ তার শিকার হচ্ছে। এর দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।’ সূত্র: বিবিসি

এমএস/এসি