যেমন ছিল নয়ন বন্ডের উত্থান চিত্র
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৮:০২ পিএম, ২৯ জুলাই ২০১৯ সোমবার
বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যার মূল নায়ক সাব্বির আহমেদ। তবে কিশোর গ্যাং লিডার হওয়ায় 'নয়ন বন্ড' নামেই পরিচিতি পায় সে। বরগুনা সরকারি কলেজের সামনের রাস্তায় রিফাতকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয় নয়ন। সে তার দলবল নিয়ে রিফাতকে তার স্ত্রীর সামনেই কুপিয়ে হত্যা করে।
এ হত্যার একদিন পরেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড। মৃত্যুর পর গণমাধ্যমে উঠে আসে তার সম্পর্কে বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য। কিভাবে উত্থান হয় এই কুখ্যাত খুনির। এর নেপথ্য কোন কোন বিষয় ছিল এসব কিছু তথ্যই চলে আসে মিডিয়ার কাছে।
জানা যায়, অন্যান্য অপরাধীর মত নয়নের উত্থানটাও ছিল বেশ চমকপ্রদ। কেননা নয়নের উত্থানের পেছনে যে হাত ছিলো স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের। মূলত তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়েই উন্মেষ হয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় আজকের নয়ন বন্ড।
নয়নের সহপাঠীসূত্র জানায়, স্থানীয় এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ ও থানার কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার আশ্রয় প্রশ্রয়েই সাব্বির আহমেদ থেকে সে হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর নয়ন বন্ড।
নয়নের বন্ধুদের সূত্রটি জানায়, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর এমপিপুত্র সুনাম ও তার দুই চাচাতো শ্যালক শাওন তালুকদার ও অভিজিৎ তালুকদারের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে নয়নের। তারা একসঙ্গে জড়িয়ে পড়েন নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। সেগুলোর মধ্যে- বিভিন্ন ছাত্রাবাসে গিয়ে ছাত্রদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনতাই, চাঁদাবাজি এমনকি মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের মত ছোটখাট অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। যা তারা নিয়মিতই করত।
রাজনৈতিক ও পুলিশের আশ্রয়ে এভাবে ছিঁচকে চোর থেকে ধীরে ধীরে মাদক, নারী, অবৈধ টাকার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে নয়ন। হয়ে ওঠে ভয়াবহ এক সন্ত্রাসী। কলেজের পাশে নিজেদের বাড়ি থাকায় বিশেষ কক্ষে নিয়ে বহু তরুণীর সর্বনাশ করেছে নয়ন। যখন যাকে ইচ্ছা তকেই বাসায় নিয়ে যেত। নারীর পাশাপাশি মাদকের নেশাতেও চরম আসক্ত হয়ে পড়ে নয়ন। সেইসঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায়ও ছিল তার বড় হাত।
এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানেই এলাকার নেতৃত্বাস্থানীয়দের নজরে চলে আসে নয়ন। সখ্য গড়ে ওঠে এলাকার রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে। আর এরই সুবাদে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গেও নয়নের ওঠাবসা ছিল চোখে পড়ার মত। এমনকি নয়নের শিকার হওয়া বহু তরুণীকে নিজের কক্ষেই পুলিশ কর্মকর্তাদের ভোগ করার সুযোগ করে দিত সে।
স্থানীয়রা জানান, প্রথমদিকে ছিঁচকে চোর পর্যায়ের ছিল নয়ন। মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগ, মোবাইল ফোন নিয়ে দৌড় দিত সে। তবে মাদকের জগতে ঢুকেই ভয়ঙ্কর ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে সে। বছর খানেক ধরে জেলার প্রভাবশালীদের সঙ্গে ওঠবস শুরু হয় নয়নের। মূলত এরপরই বেশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে সে।
কলেজের পাশেই পরিত্যক্ত ইটের ঘেরা একটি জায়গায় ছিল নয়নের আস্তানা। সেখান থেকে সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বসে থাকত কলেজের সামনে। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ধরে ধরে কেড়ে নিত মোবাইল ফোন। না দিলে দিত বেদম মারধর। কলেজের ছাত্রাবাসেও যখন-তখন দলবল নিয়ে ঢুকে তাণ্ডব চালাত নয়ন বন্ড। ছাত্রীদের মধ্যে কাউকে পছন্দ হলে তার আর রেহাই ছিল না। তাকে কাছে পেতে যা কিছু করার সবকিছুই করত সে।
তবে শৈশবে এমনটা ছিল না উল্লেখ করে নয়নের মা শাহিদা বেগম জানান, নয়ন ছোটবেলায় ভালো ছাত্র ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছিল। ২০০৭ সালে ব্যাংক কর্মকর্তা বাবার মৃত্যুর পর লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয় সে।
একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নূর হোসেন জানায়, ওর বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটে। ছ্যাকা খেয়ে গাঁজা ধরে নয়ন। ২০১১ সালে মাধ্যমিক পেরোনোর আগেই ইয়াবা ও হেরোইনে আসক্ত হয়ে পড়ে সে। তাইতো মাদকের টাকা জোগাতে নারী-পুরুষের মুঠোফোন, গয়না ইত্যাদি ছিনিয়ে নিতো সে।
মাদকের টাকার জন্য নয়নের এমন অপরাধ দিন দিন বাড়তে থাকে এবং ২০১৫ সালের মধ্যে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, ছিনতাইসহ নানা অভিযোগে পাঁচটি মামলাও হয়। ভুক্তভোগীরা নয়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছেও অভিযোগ করতে শুরু করেন। নয়নও পাল্টা রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজতে শুরু করে। একপর্যায়ে জেলা ছাত্রলীগের নেতা মুরাদ হোসেইনের হাত ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয় নয়ন।
নয়নের বন্ধুরা জানায়, রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পরই মূলত এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ ও তার দুই শ্যালক শাওন ও অভিজিতের সঙ্গে নয়নের সখ্য গড়ে ওঠে। আর এতেই সে জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। যদিও বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ।
আরও জানা গেছে, নয়ন বন্ডের ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে। যা বরগুনা শহরের কারও কাছেই অজানা নয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমাবেশে নয়নকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন শহরবাসী। অসাধু রাজনীতিবিদরা বখাটে নয়নকে নষ্ট রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে তাদের অভিযোগ।
এদিকে, হলিউডের বিখ্যাত ‘জেমস বন্ড ০০৭: লাইসেন্স টু কিল’ সিনেমার নায়কের নামানুসারে নিজের নামের সঙ্গে ‘বন্ড’ যুক্ত করেন নয়ন। এরপর সিনেমাটির গল্পের আদলে গড়ে তোলেন এক সন্ত্রাসী বাহিনী। নয়নদের বাড়িতে তার ঘরের সাদা দেয়ালে লাল রঙ দিয়ে এক জায়গায় ‘০০৭’ (নয়নের সন্ত্রাসী গ্রুপের সাংকেতিক নাম) লেখা দেখা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, ওই ছবি দেখেই নাকি বিশেষভাবে প্রভাবিত হন নয়ন। এরপর নিজেকে ‘০০৭ লাইসেন্স টু কিল’ সিনেমার নায়ক ভাবতে শুরু করেন। একপর্যায়ে নিজের নামের সঙ্গে নিজেই যুক্ত করে দেন ‘বন্ড’ শব্দটি এবং একইসঙ্গে গড়ে তোলেন ০০৭ নামের সন্ত্রাসী বাহিনী। যে বাহিনীর সদস্যরা নানা জায়গায় নানা অপকর্ম করে বেড়াত তার নির্দেশমতই।
স্থানীয় পুলিশের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা থাকায় নয়ন চাইলেই যে কাউকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি বা গ্রেফতার করাতে পারত। পুলিশের বিশ্বস্ত সোর্স হিসেবেও সে কাজ করত বলে জানিয়েছেন শহরের বাসিন্দারা।
এদিকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার পাশাপাশি নারী ও নেশায় আসক্ত নয়নের হাতে যে ঠিক কতজন তরুণীর সর্বনাশ হয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই পুলিশের কাছেও। তবে নয়নের ‘বিশেষ কক্ষ’ থেকে উদ্ধার করা একটি ল্যাপটপে বহু পর্নো ভিডিও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সেখানে কলেজ পড়ুয়া বহু মেয়ের সর্বনাশ করেছে এই বন্ড খ্যাত নয়ন।
যার কয়েকটি ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটিতে ভিন্ন ভিন্ন তরুণীর সঙ্গে বিশেষ মহূর্তের দৃশ্যে দেখা গেছে নয়নকে। একেক দিন একেক জন তরুণীকে নিজের ফুর্তির শিকার বানাতো নয়ন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নয়ন বন্ডের ওই বিশেষ কক্ষের গোপন স্থানে কৌশলে আইপি ক্যামেরা বসানো থাকত। বিশেষ উদ্দেশ্যে যাদের ওই কক্ষে আনত তারা কেউই টের পেত না সেই গোপন ক্যামেরার অস্তিত্ব।
তাইতো নয়নের সঙ্গে একবার মিলিত হওয়ার পর আর রক্ষা পেত না কোন মেয়ে। ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে বারবার কিশোরী-তরুণীদের ভোগ করত সে। যে কারণে নয়নের হাত থেকে বাঁচতে কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে অনেক তরুণী। অনেকে আবার নয়নের চাহিদামতো মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছে। এমন অন্তত ১২ জন তরুণীর তথ্য আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তবে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নয়ন নিহত হওয়ার পর এসব ভিডিও কে বা কারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াচ্ছে তার সন্ধান করতে পারেনি পুলিশ।
নয়নদের বাড়িটি বরগুনা শহরের ডিকেপি রোডের মাঝ বরাবর একটা সরু গলির শেষ প্রান্তে। বাড়ির সামনে অনেকটা জায়গা খোলামেলা। নতুন করে ঘর তোলার জন্য কয়েক মাস আগে সেখানে ইট এনে রাখা হয়েছে। বাড়িটির মূল দরজার পাশেই একটা ছোট বৈঠক ঘর। ওটাই ছিলো নয়নের কক্ষ। যার কক্ষের দরজা খোলা থাকত গভীর রাত পর্যন্ত। সারাদিন এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরির পর গভীর রাতে বাড়ি ফিরত নয়ন।
আর রাত ১২টার পর তার কক্ষে বেড়ে যেত লোকজনের আনাগোনা। যে তালিকায় ছিলেন পুলিশের সদস্যরাও। প্রতিবেশীরা জানান, পুলিশের কয়েকজন অসাধু সদস্য যুক্ত ছিলেন নয়নের মাদক ব্যবসার পার্টনার। নয়নকে ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে মাদক ব্যবসা চালিয়ে গেছে তারা। শহরের অনেকেই মাদকের সঙ্গে যুক্ত ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের চিনলেও ভয়ে মুখ খুলছেন না কেউ-ই।
বরগুনা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, নয়নের ওই ঘর থেকে যে ল্যাপটপটি উদ্ধার করা হয়েছে তাতে রয়েছে কয়েকশ’ নীল ভিডিও। স্থানীয় বহু তরুণীই যে তার লালসার শিকারে পরিণত হয়েছে তা ল্যাপটপের ওই ভিডিও-ই প্রমাণ করে। জেলা পুলিশের উচ্চতর কর্মকর্তারা এসব ভিডিও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন বলেও জানান তিনি।
যদিও শেষ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে শেষ হয় সাব্বির আহমেদ নয়ন থেকে ‘নয়ন বন্ড’ হয়ে ওঠা এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের। কিন্তু বরগুনাসহ সারাদেশে এমন হাজারো নয়ন রয়েছে, যারা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর যে সব পরিচালক-প্রযোজকদের (রুপক অর্থে) ছত্রছায়ায় সাব্বির আহমেদরা ‘নয়ন বন্ড’ হয়ে ওঠেন তারা কি আজও থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরেই? বরগুনা পুলিশের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকায় এমনই শঙ্কা জেগেছে জনমনে।
এনএস/এসি