হুজুগ, গুজব এবং মানসিক রোগ
আউয়াল চৌধুরী
প্রকাশিত : ০৮:১০ পিএম, ৩০ জুলাই ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ১০:৩৩ পিএম, ৩০ জুলাই ২০১৯ মঙ্গলবার
বাঙালি হুজুগে মাতাল- এমন একটি প্রবাদ আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। কোন কিছু শোনার আগেই দৌড় দেওয়ার ভিষন প্রবণতা রয়েছে। এমন হুজুগের পাল্লায় পড়ে কত দুর্ঘটনা যে ঘটছে তার কোনো হিসেব নেই। ইতিমধ্যে এই হুজুগে পড়ে অনেকের জীবন প্রদীপ নিভে গেছে।
আমার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালিন সময়ের একটি ঘটনা মনে পড়ে। নিয়মিতই দশ নাম্বার বাসে চড়েই ক্লাসে আসা যাওয়া করা লাগতো। লক্কর জক্কর বাসগুলো যাত্রী নিয়ে সব সময় ই একটি আরেকটির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লেগে থাকতো। তেমনি একদিন ক্লাস শেষ করে ফিরছি, এ সময় অন্য একটি বাস আগে যাওয়ার চেষ্টা করলেই শুরু হয় প্রতিযোগিতা। কে কার আগে যাবে। এর মধ্যে কয়েকজন প্যাসেঞ্জার শুরু করলো চিৎকার চেঁচামেচি। তারা বাসের ড্রাইভারকে উত্তেজিত করতে লাগলো, চালিয়ে যা- শালারে যাইতে দিবি না, তুই গাড়ি চালা আমরা আছি, এ সময় আমরা কয়েকজন এসব বন্ধ করার জন্যে প্রতিবাদ করে উঠলে আমাদেরকে থামিয়ে দেওয়া হলো। বাসবর্তী লোকজন এক যোগে শুরু করেছে। সব হুজুগে মাতাল হয়ে উঠলো। মার মার শব্দ করে একেকজন একেকভাবে নিজেদের জাহির করতে লাগলো, এর মধ্যে এক মধ্যবয়সী লোক অনেক বেশি উত্তেজিত। তাকে দেখে অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনি কোনো এক চিপা থেকে বড় একটা কাঠ বের করে আনলেন। এ সময় ওই বাস থেকে এক ভদ্রলোক বের হয়ে এসে ড্রাইভারকে বলছিলেন যে তুমি এমন করছ কেন, বার বার আমাদের বাসকে ধাক্কা দিচ্ছ। তখন মধ্যে বয়সী লোকটি মার মার বলে ড্রাইভারকে শক্ত কাঠটি দিল, ড্রাইভার প্যাসেঞ্জারদের শক্তি পেয়ে ওই লোকের মাথার উপর জোরে আঘাত করলো। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত পড়া শুরু হলো। ওই লোকের রক্তে সমস্ত জামা কাপড় ভিজে একাকার।
ইতিমধ্যে ওই বাস থেকেও লোকজন নামা শুরু করেছে। এমন অবস্থা দেখে এবার আমাদের বাসের লোকজন যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে, ড্রাইভার এক ফাঁকে পালিয়ে গেল। আহত লোকটিকে হাসপাতালে নিতে চাইলেও সে যাবে না, সে হামলাকারী ও তার সহযোগী মধ্য বয়সী ওই লোকটিকে ধরতে চায়। তখনো তার মাথা থেকে মুখ বেয়ে রক্ত পড়ছে। সে আমাদের বাসে ওঠার চেষ্টা করছে। এদিকে লোকজন যে যেদিকে পারছে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে হলেও পালাচ্ছে। আমরা কয়েকজন চরম বিপদের মধ্যে পড়ে গেলাম। বাসের লোকজন ইতিমধ্যে পুরা চেঞ্জ হয়ে গেল। মুহূর্তের ভিতর এখন ওই লোককে গালাগালি দেওয়া শুরু করলো। লোকটি কি করবে বুঝতে পারছে না, বাসের মধ্যেই কয়েকজন এবার তাকে মারতে চায়। আমরাও পালানোর কোন পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কারণ ইতিমধ্যে ওই বাসের লোকজন দরজার সামনে চিৎকার করছে আর বলছে নাম শালারা---।
এর মধ্যে মধ্যবয়সী লোকটি পাগলের মত হয়ে গেছে, কিভাবে বাস থেকে পালাবে পথ খুঁজছে। সবাই অলরেডি তার নাম বলে দিয়েছে, সেই সব কিছুর হোতা আর সবাই সাধারণ। তাদের কোনো দোষ নেই। এখন এই লোক জান বাঁচানোর জন্য চটপট করতে থাকলো, পরবর্তীতে সে পেছনের জানালার একটা কাঁচ ভেঙে লাফিয়ে পড়ে কোন রকম জান বাঁচিয়েছে। আর আমরাও সেভাবে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে পালিয়েছি। এই হলো ভয়াবহ রকমের হুজুগ। একটা বিষয় নিয়ে কথা উঠলে বুঝে হোক না বুঝে হোক প্রত্যেকটা মানুষই তখন সেটা নিয়ে লাফিয়ে ওঠে। এবং সেটার পরিণতি কি হবে সেটা নিয়ে একবারও ভাবেনা। আবার মুহুর্তের মধ্যে পল্টি দিতেও একমিনিট সময় লাগে না।
ঠিক একি কায়দায় একজন চিৎকার করে উঠেছে দশজন এসে বাড্ডায় রেনুকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। আবার যখন ঝামেলা শুরু হল তখন সবাই সাধু হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যেন কিছুই হয়নি, তারা কিছুই করেনি। মুহূর্তের ভিতর সবাই পোল্টি নিচ্ছে। ঠিক বাসের ঘটনার মতো। একজন মার মার বলে চিৎকার করলো আর সবাই মারার জন্য মুখিয়ে উঠলো। যখনই বিপদ দেখা দিল সঙ্গে সঙ্গে পল্টি। আমি না ভাই ওই লোকটা করছে।
হুজুগে বাঙালি এখন গুজবে মেতেছে। চিলে কান নিয়ে গেছে এখন সেই কানের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে হয়রান। পদ্মা সেতুতে কল্লা লাগবে এমন এক আজব চিন্তা মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, শহর থেকে একেবারে অজোপাড়া গাঁয়ে মানুষের এখন কল্লা হারানোর চিন্তায় ঘুম নেই। গ্রাম থেকে অনেকেই ফোন করে বলেছে সাবধান থেকো পদ্মা সেতুতে কল্লা লাগবে।
কেউ একবারও ভাবছে না এই কল্লা দিয়ে সেতুর কি হবে। তবে কল্লার গুজব যারা উঠিয়েছে নিশ্চয় তাদের এখানে কোনো গেইম আছে। কৌশলে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য এমন একটি গুজব তারা তুলেছে যা ইতিমধ্যে অনেকেই কাজে লাগিয়ে ফেলেছে। ব্যক্তিগত রেষারেষির জেরে এই সুযোগকে অনেকে কাজে লাগাচ্ছে। যা ইতিমধ্যে কয়েকটি জায়গায় প্রমাণিত হয়েছে। হত্যাকারীকে পিটিয়ে হত্যা না করলে সব হত্যারই রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হতো। যে সব এলাকায় হত্যা সংঘটিত হয়েছে সেখানে পদ্মা সেতুর কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। প্রতিটি হত্যার পেছনে হত্যাকারির স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এমন হত্যাকান্ড যে কারো জীবনে ঘটে যেতে পারে। তাই সবাইকে এমনিতেই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মুক্তিপন দাবিতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং পদ্মা সেতুর নাম নিয়ে আপনার কোনো শত্রু আপনার সর্বনাশটা করে ছাড়বে। তাই হুজুগে আর গুজবে না মেতে এখনই সতর্ক হওয়া দরকার।
এরপর শুরু হলো ডেঙ্গু গুজব কাহিনি। দুই মেয়রদ্বয় এবার নিজেরাই গুজবে আসক্ত। যে বিষয়টি সত্যি সত্যি ঘটছে সেটিকেও গুজব বলে চালিয়ে দিয়েছেন। অর্থাত্ সব কিছুই গুজব নয়। নিজেদের দুর্বলতা ডাকার জন্য গুজব বলে চালিয়ে দেওয়াও অপরাধ। ইতিমধ্যে এই গুজব ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেকের প্রান প্রদীপ নিভে গেছে। স্বজনের কাছে ফিরে যাওয়ার পথে বাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা গেছেন সেটাও আমরা দেখেছি। আর এই ডেঙ্গু এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মেয়রদ্বয় এখন বিশ্বাস করছেন অন্তত এটি গুজব নয়।
আমার কাছে মনে হয় আমাদের পুরো জাতি মানসিক রোগে আক্রান্ত। প্রত্যেকের মধ্যে এক ধরনের জিঘাংসা বিরাজ করছে। মানুষের মধ্যে চরম অস্থিরতা দেখা যায়। কে কাকে মারবে, কে কাকে ঠকাবে, কার কাছ থেকে একটু বেশি নেওয়া যায়, কাকে ফাঁদে ফেলা যায়, কাউকে ধাক্কা দিয়ে আরেকটু উপরে কিভাবে উঠা যায়, এমন নানা রকমের চিন্তায় মানুষ স্বাভাবিক জীবন থেকে অস্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করছে। আমরা যদি পরিবারের দিকে তাকাই দেখতে পাই, প্রতিটি পরিবারেই কোনো না কোনো ঝামেলা লেগে আছে। হয় জমি নিয়ে বিরোধ নয়ত পারিবারিক কলহ, অফিসে দ্বন্দ্ব-মনস্তাত্ত্বিক লড়াই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক বা দাবি দাওয়া, অভাব, না পাওয়ার বেদনা, প্রেম, পরকীয়া, রাস্তা ঘাট সব জায়গায় মানুষের মধ্যে চরম অস্থিরতা দেখা যায়। এভাবে চিন্তা করলে কোনো মানুষকেই স্বাভাবিক বা সুস্থ মনে হয় না। প্রত্যেকেই কাউকে ঠেকানো, ঠকানো বা প্রতিরোধের চেষ্টা করছে বা কেউ প্রতারিত হয়ে প্রতিশোধের অপেক্ষায় আছে। কেউবা মামলা হামলার জালে আটকে বের হওয়ার পথ খুঁজছে।
এমন একটি পরিস্থিতি যদি দীর্ঘ সময় চলতে থাকে তাহলে মানুষের মধ্যে খুনোখুনি আরও বেড়ে যেতে পারে। মানসিক অশান্তিতে জাতি ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বের দিকে ধাবিত হবে। তাই এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ এখনই খোঁজে বের করা দরকার।
লেখক: সাংবাদিক