মানব পাচার প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:১৮ পিএম, ৩০ জুলাই ২০১৯ মঙ্গলবার
মানব পাচার এমন একটি অপরাধ, যা অভিবাসী শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, হয়রানি, জোরপূর্বক শ্রম, অবৈধ ও জোরপূর্বক বিবাহের ঝুঁকি বাড়ায়। মানব পাচার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।একই সাথে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার, আইন প্রয়োগকারী, নাগরিক সমাজ, বেসরকারী খাতসহ সকলের সম্মিলিত কাজ করা প্রয়োজন।
মঙ্গলবার বিশ্ব মানব পাচার প্রতিরোধ দিবস ২০১৯ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায় অনুষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘আই স্ট্যান্ড এগেইনস্ট হিউম্যান ট্রাফিকিং’ নামের একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মানব পাচার প্রতিরোধে কাজ করা বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এ কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা(আইওএম)এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক সংসদ ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং সুইডেন দূতাবাস এর সহযোগিতায় এই অনুষ্ঠোনের আয়োজন করে।যার মূল উদ্দেশ্য মানব পাচার সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আরও সচেতনতা তৈরি করা।
এছাড়া মানব পাচার, অভিবাসন ও এর প্রভাব সম্পর্কে তুলে ধরতে এই প্রতিযোগিতাটি নীতিনির্ধারক, ছাত্র, শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, উন্নয়ন অংশীদার, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বেসরকারী খাতকে এক জায়গায় নিয়ে আসাও এই প্রতিযোগিতার লক্ষ্য।
প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আইওএম এর “মাইগ্র্যান্ট প্রটেকশন অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্স” এর প্রধান- আসমা খাতুন মানব পাচার সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন।
তিনি বলেন, বিশ্বায়নের কল্যাণে এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ এখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ১২ মিলিয়ন বাংলাদেশি বিদেশে কর্মরত আছেন। মূলত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত কারণে বাংলাদেশিরা বিপুল সংখ্যায় বিদেশে পাড়ি জমান।
২০১৮ সালে আনুমানিক ৮.৯ মিলিয়ন বাংলাদেশি অভ্যন্তরীণভাবে অভিবাসিত হয়েছেন।এই সময়ে প্রায় ৭৩০,০০০ জন নিয়মিত চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে বিদেশে কাজ করার জন্য পাড়ি জমান। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর ট্রাফিকিং ইন পারসন্স(টিআইপি) রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, প্রতিবছর অনেকেই অনিয়মিত চ্যানেলগুলির মাধ্যমে পাচার হন এবং পাচারকারীদের হাতে শোষণ এবং নির্যাতনের শিকার হন এই মানুষগুলো।যারা অবৈধভাবে বা অনিয়মিতভাবে বিদেশে যান বা যেতে বাধ্য হন তারা সীমাবদ্ধ চলাচল, ঋণচুক্তি, জো্রপূর্বক শ্রম, যৌন নিপিড়ন, জোরপূর্বক বিবাহ এবং দাসত্বের মত সমস্যায় পরেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড.এমএম আকাশ বলেন, “আমাদের দেশে পর্যাপ্ত চাকরির সুবিধা নেই। সে কারণে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা, বিদেশে যান।এদের অনেকেই পাচারের শিকার হন।যারা এই পাচারের শিকার হন তাদের অধিকাংশই গরীব। ফলে চাইলেই তারা অনেক কিছু করতে পারেন না।বাস্তবতা হলো, পাচারের বিষয়টি এখন উদ্বেগজনক। এটি ঠেকাতে আমাদের দরিদ্রতা কমাতে হবে। বৃদ্ধি করতে হবে তরুণদের দক্ষতা। একইসাথে যারা বিদেশে যেতে আগ্রহী তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হব্।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আাইন বিভাগের অধ্যাপক ড.নাকিব মো. নাসরুল্লাহ বলেন,“মানব পাচার একটি বহুদেশীয় অপরাধ। আমাদের দেশে মানাব পাচার রোধে পর্যাপ্ত আইন আছে, সমস্যা আছে বাস্তবায়নে। পাচার রোধে আইনগুলো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার যাতে পাচারকারীরা দ্বিতীয়বার এই অপরাধ করতে ভয় পায়।মানব পাচার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আরও বেশি কাজ করতে হবে।”
মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।এর মধ্যে নীতিমালা প্রণয়ন, টাস্কফোর্সকে শক্তিশালীকরণ, জিও-এনজিও ন্যাশনাল কোওরডিনেশন কমিটি গঠন, মানব পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতীয় পরিকল্পনার উপর নজরদারি করার কমিটি ২০১২-২০২২ কারা।এছাড়া উদ্ধার, পুনরুদ্ধার, প্রত্যাবাসন এবং একত্রীকরণ টাস্কফোর্স গঠন, ভিজিল্যান্স কার্য জোরদার করা হয়েছে।জেলা, উপ-জেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে কাউন্টার-ট্র্যাফিকিং কমিটি (সিটিসি) গঠন করেছে সরকার।
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইএমও মানবাপাচার প্রতিরোধে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে।তথ্য প্রচার ও প্রসার, ক্ষতিগ্রস্থদের প্রত্যক্ষ সহায়তা করা এরমধ্যে অন্যতম।দেশব্যাপি সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে আইওএম।এছাড়া অভিবাসী প্রত্যাশিদের নিয়ম মাফিক ও যৌক্তিক নিয়োগের জন্য বেসরকারী খাতের সাথেও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আইওএম এর ডেপুটি চীফ অফ মিশন শ্যারন ডিমাঞ্চ বলেন,“দেশে বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান থাকায় একজন ব্যক্তি বিদেশে যেতে চায়।এই সুযোগে ভবিষ্যত অর্থনৈতিক উন্নতির লোভ দেখিয়ে পাচারকারীরা মিথ্যা স্বপ্নে আকৃষ্ট করে সাধারণ মানুষ পাচার করে।এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য সব পক্ষের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।”
সম্প্রতি, জাতিসংঘ অধিন সংস্থাগুলো অভিবাসন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নীতিমালা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকারকে সমন্বিত জাতিসংঘের কান্ট্রি টিম-ওয়াইড সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় অভিবাসন নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। নেটওয়ার্কের আওতায়, অবৈধ মানব পাচারের বিষয়ে আন্তঃসম্পর্কীয় সমন্বয়কে সমর্থন করার জন্য জাতিসংঘ অধিন সংস্থাসমূহ এবং সিএসও-র সমন্বয়ে একটি কাউন্টার-ট্র্যাফিকিং টেকনিক্যাল ওয়ার্কিং গ্রুপ চালু হয়েছে। যার ঘোষণা আসে এই বিতর্ক প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী পর্বে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬টি ডিবেটিং ক্লাব বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
কেআই/