নিবর্তনমূলক বিধি-বিধানে নিঃস্ব বিনিয়োগকারী ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা
মাহবুব হাসান সিদ্দিকী
প্রকাশিত : ০৯:৩৬ পিএম, ১ আগস্ট ২০১৯ বৃহস্পতিবার
দেশের পুঁজিবাজারে ভয়ানক এবং ক্রমবর্ধমান ধসের ফলে বিপর্যস্ত ক্ষুদ্র ও সাধারণ বিনিয়োগকারী। কারসাজিপূর্ণ এ বাজারে প্রণোদনার নামে নিবর্তনমূলক বিধি-বিধান প্রনয়ণ করে সূক্ষ্ম কলাকৌশলের মাধমে বাজারকে বড় ধসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে অভিজ্ঞ বাজার বিশ্লেষকদের অভিমত। অব্যাহত ধর পতনে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)’র সার্বিক মূল্য সূচক প্রায় তিন বছর আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন উত্তর ডিএসই’র সার্বিক মূল্যসুচক ৫৯৫০ পয়েন্ট থেকে গত ২২ জুলাই ৪৯২৫ পয়েন্টের নিচে নেমে যায়। এ সময়ে সুচক কমেছে ১০২৫ পয়েন্ট। বাজার মূলধন ৪ লাখ ১৯ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা থেকে ২২ জুলাই ৩ লাখ ৭২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকায় নেমে গেছে। এ সময়ে বাজার মূলধন হারিয়েছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া ২১ ও ২২ জুলাই দু’দিনে সূচক ২০০ পয়েন্টের বেশি তলানিতে নেমে গিয়েছিলো। বাজার মূলধন হারায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এ ঘটনা গত কয়েক বছরে নজিরবিহীন।
অথচ দুদিনে প্রায় ২০০ পয়েন্ট সূচক হারোনোর দু’দিন আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেছেন, দেশের পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকরীর সংখ্যা বেশি। বাজার শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে। আমি পুঁজিবাজারকে স্থায়ী শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য কাজ করছি।
অভিজ্ঞ বাজার বিশ্লেষকদের মতে, পুঁজিবাজার নিয়ে অর্থমন্ত্রীর অতিকথন এবং মন্তব্য বড় ধরনের স্ব-বিরোধিতায় পরিপূর্ণ। যা বাজারের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোম্পানির আর্থিক বিবরণী প্রনয়ণ এবং নিরীক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত জ্ঞানের অধিকারী এবং অত্যন্ত অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর পুঁজিবাজার সম্পর্কে অনেকটা অসগলগ্ন এবং অসঙ্গিপূর্ণ কথা বলে যাচ্ছেন। মার্চের শেষ দিকে বিএসইসি আয়োজিত বিনিয়োগকরীদের এক অনুষ্ঠানে দম্ভোক্তির সাথে তিনি বলেছিলেন- ‘বাজারের সূচক কোথায় গিয়ে নামতে পারে তা দেখতে চাই।’ তাঁর এ বক্তব্যের পর কয়েক দিনে ডিএসই ৪০০ পয়েন্ট সূচক হারায়। তাছাড়া শবে বরাতের বন্ধের দিন বিএসইসি‘র কার্যালয়ে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পুঁজিবাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নাই। বাজার চলে পত্রিকার খবরে, এখানে ভালো কোম্পানি নাই, ভালো কেউ আসলে তারাও খারাপ হয়ে যাবে।’ দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব প্রাপ্ত একজন মন্ত্রীর এভাবে প্রকাশ্যে ঢালাও নেতিবাচক মন্তব্য পুঁজিবাজারের প্রতি নেতিবাচক মানসিকতার বর্হিপ্রকাশ।
‘রোম যখন পোড়ছে নীরু তখন বাঁশি বাজাচ্ছে’ সরকারের শীর্ষ দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের আচরণ বা কর্মকা- তেমনি যেনো না হয়ে যায়; সেদিকে সতর্ক হওয়া একান্ত জরুরি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের গিনিপিগ বা বলির পাঠা বানিয়ে বাজার ব্যবচ্ছেদ করে যে কোনো ধরনের ক্ষতিকারক এক্সপ্রিমেন্ট চালানোর পথ থেকে নীতিনির্ধারক মহলের সরে আসা প্রয়োজন।
পুঁজিবাজারের মূল সমস্যা বোঝার জন্য পদক বা বিশেষ পদক বা পদবি প্রাপ্ত হিসাববিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ সচেতন বিনিয়োগকারীরাও ভালো জানেন দেশের পুঁজিবাজারের মূল সমস্যাগুলো হচ্ছে- এক কথায় সুশাসনের অভাব; প্রবৃদ্ধিহীন দূর্বল মৌলের এবং লোকসানি কোম্পানির আধিপত্য, অধিকাংশ কোম্পানির বার্ষিক স্থিতিপত্রে নানা ধরনের কারসাজি, মনগড়া আয়-ব্যয়ের তথ্য উপস্থাপন, স্পন্সর ডিরেক্টদের একক এবং সম্মিলিত ভাবে ন্যূনতম শেয়ার ধারনের নির্দেশনা উপেক্ষা, পূর্ব ঘোষণা ছাড়া স্পন্সর ডিরেক্টদের শেয়ার বিক্রি, অত্যন্ত দূর্বল মৌলের কোম্পানির তালিকাভুক্তি, স্বল্প মূলধনী কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি। অথচ এসব বিষয়গুলোকে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে বা এসব বিষয়কে পাশকাটিয়ে অর্থমন্ত্রী বিশেষ মহলের দ্বারা আর্দিষ্ট বা অণুপ্রাণিত হয়ে বিনিয়োগকারীদের কথিত প্রণোদনার নামে বোনাস লভ্যাংশ প্রদানে শর্তারোপ ও সঞ্চিতি রাখার ক্ষেত্রে করারোপসহ নানা নিবর্তনমূলক বিধি-বিধান বা আইন জারি করছেন। যা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সৃষ্টি করছে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া এবং বাজার ধসে যোগাচ্ছে বড় ধরনের ইন্ধন।
কোম্পানির অর্জিত আয়ের কতোটা কীভাবে বন্টন করা হবে এবং কতোাটা সঞ্চিতি রাখবে- এই বিধান জারি করার চেয়ে কোম্পানিগুলো যথাযথ নিয়ম মেনে চলছে কিনা, আয় প্রবৃদ্ধি ঠিক আছে কিনা এবং সঠিক ভাবে কর্পোরেট বিধি-বিধান মেনে চলছে কিনা তা নিশ্চিত করা, দূর্বল মৌলের কোম্পানির তালিকাভুক্তি এবং বাজার কারসাজি বন্ধে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কমিশনের কর্মকা- জোরদার করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব দেয়া অনেক বেশি জরুরি ছিলো। তা করা গেলে বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি উপকৃত হতো, বাজারে নিশ্চিত হতো প্রত্যাশিত স্থিতিশীলতা।
বাজেটে দেশী-বিদেশী সব ধরনের কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ফলে সম্ভাবনাময় ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তির সম্ভাবনা হয়েছে সুদূরপরাহত। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বাজারকে শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করানোর যে মিশন নিয়ে অর্থমন্ত্রী নেমেছেন তা অদূর ভবিষ্যতে বাজারকে আরো নির্জীব, নিষ্প্রাণ, নিঃস্ফলা করবে তা অনেকটাই স্পষ্ট। তাছাড়া যে সব কোম্পানির স্পন্সর ডিরেক্টরদের সম্মিলিত শেয়ার ৩০ শতাংশের কম তাদের বোনাস শেয়ার প্রদানে এসইসি’র সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা আস্থাহীন বাজারকে ঠেলে দিচ্ছে আরো বিপর্যয়ের দিকে। আস্থার সংকট যখন বাড়ছে তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেদের দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা এবং স্পন্সর শেয়ার মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বা ইচ্ছা-স্বাধীন মনোভাবের দায় প্রকারান্তরে চাপিয়ে দিয়েছে অসহায় ক্ষুদ্র সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর। যার পরিনতি অব্যাহত দরপতন।
পুঁজিবাজারের বিকাশের পথ রুদ্ধ করে এবং বোনাস শেয়ার প্রদানের নিষেধাজ্ঞার মাধমে সরকার বাজার উন্নয়নে যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা দ্রুততম সময়ে সংশোধন করা না হলে দেশের পুঁজিবাজার ভবিষ্যতে নির্জীব, বনসাই বা বামন বাজারে পরিনত হবে। সুতরাং পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী ভীতের ওপর দাঁড় করাতে গিয়ে কাদের ভীত শক্ত করা হচ্ছে তা ভাববার বিষয়।
পুঁজিবাজারকে দেশের অর্থনীতির প্রতিবিম্ব বলা হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার কথা যখন সরকারের সব মহলে সরবে উচ্চারিত, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্মরণকালের ইতিহাসে নিরুৎতাপ সহনীয় অবস্থায় বিরাজমান; সেখানে পুঁজিবাজারের ভূমিধস বিপর্যয়কে সহজে মেনে নেয়া যায় না। বাজারের অব্যাহত ক্রমবর্ধমান ধস বিনিয়োগকারীদের কাছে মূর্তিমান আতংক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কষ্টার্জিত পুঁজি হারিয়ে নিঃস্বতর হচ্ছে লাখো বিনিয়োগকারী। তাদের কষ্ট লাঘব করা বা তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা যেনো মহা অপরাধ করে ফেলেছে।
আত্মোপলব্ধির বিষয়টিকে বিসর্জন দিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসিও এখন সব কিছুতে কারসাজি খুঁজে বেড়ায়। বাজার সংশ্লিষ্ট কেউ কোনো কারসাজি করলে তা ধরতে এসইসি’র সেকেন্ড/মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়। জানা যায়- ব্যাপক দরপতনের বিষয়টিকে কারসাজি হিসাবে দেখছেন এসইসি’র কর্তাব্যক্তিরা। তাই কারসাজির কারণ খুঁজতে গঠন করা হয়েছে চার সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি। প্রায় এক দশক যাবত বাজার রসাতলে নিমজ্জিত হলেও এসইসি’র শীর্ষকর্তা ব্যক্তিরা স্বপদে রয়েছেন বলীয়ান। বহুবিদ ব্যর্থতার দায় নিয়ে তারা কোন মন্ত্রবলে স্বপদে বহাল থাকেন তা অণুসন্ধিৎসু সাংবাদিকতার বিষয় হতে পারে।
বাজারের ১০০০ পয়েন্টের বেশি সূচক ক্ষয়ে যাওয়া এবং প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বাজার মূলূধন নিঃশেষ হওয়ার পর এসইসি’র গঠিত তদন্ত কমিটির ঘটনা কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙ্গার পৌরণিক কাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ছোট-বড় ৫/৬ লাখ বিনিয়োগকারীর ৫০ হাজার কোটি ফোঁটা রক্তক্ষরণের পরও অভিভাবক বোঝতেই পারছে না অসুখের কারণ কী! বিপর্যস্ত বাজারে বিনিয়োগকারীরা যখন দিশেহারা; তখন এসইসি’র কর্তাব্যক্তিরা নীরব নির্বিকার থাকলেও ‘কপারটেক’ নামের আরেকটি বিতর্কিত ও দূর্বল মৌলের কোম্পানিকে চাপিয়ে দিতে অনেক বেশি সরব এবং সক্রিয় ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সমস্ত দায় চাপছে অসহায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ওপর।
কয়েক বছর আগে এ্যাপোলো ইস্পাত কোম্পানির তালিকাভুক্তি নিয়েও টানাপোড়েনের ঘটনা ঘটে ছিলো। বহুবিদ আপত্তি থাকা সত্ত্বেও এসইসি ১২ টাকা প্রিমিয়ামসহ ২২ টাকা দরে শেয়ার ছেড়ে কোম্পানিটি আইপিওতে আসার সুযোগ করে দেয়। এই কোম্পানির শেয়ারের বর্তমান বাজার মূল্য ৫ টাকার নিচে।
পুঁজিবাজারে নানা ব্যক্তি/গোষ্ঠির অনিয়ম বা অপকর্মের সব দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে অসহায় বিনিয়োগকরীদের কাঁধে। নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের বুক ফাটা আর্তনাদ নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ শাসক মহলের কাউকে স্পর্শ করছে না। অসহনীয় লোকসান তাদের জীবনক করে তোলেছে দুর্বিসহ ও বিপর্যস্ত। তাদের প্রতি কি সরকার বা রাষ্ট্রের কোনো দায়বদ্ধতা নেই?
সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ- স্মরণকালে দু’বার ব্যাপক কারসাজির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বুদবুদ সৃষ্টি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পথে বসানোর ঘটনা আওয়ামীলীগ সরকারের সময় ঘটেছিলো। তখন উচ্চ মূল্যের শেয়ারে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করে নিঃস্ব করা হয় অসংখ্য সাধারণ মানুষকে। এবার সূক্ষ কারসাজির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে ব্যাপক ধস সৃষ্টির মাধ্যমে অসহায় বিনিয়োগকারীদের চরম ভাবে নিঃস্ব করার চক্রান্ত চলছে। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় এলেই শেয়ার বাজারে বিপর্যয় ঘটে- এ ধারণা যেনো বদ্ধমূল হয়ে না যায়; সে জন্য স্পর্শকাতর এ বাজারের প্রতি সরকারের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
ভিত্তি মজবুত করার নামে পুজিঁবাজারে যে সব নিবর্তনমূলক বিধি-বিধান জারি করা হয়েছে, বাজার এবং বিনিােগকারীদের স্বার্থের দোহাই দিয়ে আগামীতে তা যে প্রতাহার করা হবে না তার নিশ্চয়তা কী? তখন এখনকার পথে বসা নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের দায়ভার কে নেবে? ব্যক্তি গোষ্ঠী বা কোনো প্রতিষ্ঠান এ জন্য দায়বদ্ধ না থাকলেও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা রয়েই যাবে। রাষ্ট্র কোনো অস্বাভাবিক বিপর্যয়ের দায়ভার এড়াতে পারে না।
মাহবুব হাসান সিদ্দিকী, বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।
abmh07@gmail.com
আরকে/