যার ভয়ে বাঘ-মহিশ একঘাটে পানি খেত, এখন সে নিঃস্ব!
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৭:৪৪ পিএম, ৩ আগস্ট ২০১৯ শনিবার
একটা সময় প্রবল প্রতাপশালী ছিলেন তিনি। তার ভয়ে কাঁপতো সবাই, বাঘে-মহিশে এক ঘাটে এসে পানি খেত অবস্থা। কিন্তু সময়ের আবর্তনে হারিয়ে গেছে সব। নেই সেই প্রতিপত্তি-ক্ষমতা। আশেপাশে কিছুই নেই, নেই কোন প্রিয়জন। সবকিছু হারিয়ে তিনি এখন সর্বহারা, নিঃস্ব।
বলছিলাম খুলনার কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের বডিগার্ড ও ১২ মামলার রাজসাক্ষী নুর আলমের কথা। দীর্ঘ ২০ বছর পর মুক্তি পাচ্ছেন তিনি। সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ায় এবং অন্য কোনও মামলা না থাকায় গত ২৯ জুলাই নুর আলমকে মুক্তির আদেশ দিয়েছেন ঢাকার ৯ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান।
প্রায় ২০ বছর আগে ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন নুর আলম। সেই থেকে কারাগারে ছিলেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থানার আজিমপুর গ্রামের বাসিন্দা নুর আলম।
জানা যায়, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায়। খুলনায় বসবাসকালে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তিনি। দ্রুতই সন্ত্রাসী থেকে হয়ে যান গডফাদার। সে সময়েই তার সঙ্গে যোগ দেন জাহাজে চাকরি করা নুর আলম।
অপরাধ জগতের খলনায়ক এরশাদ শিকদারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন খুন-ধর্ষণসহ নানা অপরাধে। ১২ খুনের সহযোগী থেকে হয়ে যান বিশ্বস্ত বডিগার্ড। পরে এরশাদ শিকদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর রাজসাক্ষী হন বডিগার্ড নুর আলম। তার সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে খুলনার জলিল টাওয়ারের ম্যানেজার খালিদ হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হয় এরশাদ শিকদারের।
এভাবে একে একে ১১টি মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে কারাগার থেকেই এরশাদ শিকদারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন নুর আলম। যার প্রেক্ষিতেই ২০০৪ সালের ১০ এপ্রিল মধ্যরাতে খুলনা জেলা কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হয় সাড়া জাগানো কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদের।
তবুও বাকি ছিল রাজধানীর লালবাগ থানার আজিজ অপহরণপূর্বক হত্যা মামলার সাক্ষ্য দেয়া। ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট মামলাটি চার মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দিলে গত ২৯ জুলাই মামলাটির শুনানির তারিখ ধার্য করা হয়। যেখানে নুর আলমের কারামুক্তির আবেদন করেন ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের আইনজীবী মুনতাছির মাহমুদ রহমান।
শুনানি শেষে আবেদন মঞ্জুর করে নুর আলমকে কারামুক্তির আদেশ দেন বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান। শুনানিকালে নুর আলমকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে তাকে ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে নেয়া হয়।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারী জজ মো. আলমগীর হোসাইন বলেন, নুর আলম রাজসাক্ষী হয়ে ২০ বছর ধরে জেলে আছেন জানার পর তাকে লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে জামিন করানো হয়। তার বিরুদ্ধে খুলনার একটি মামলায় প্রডাকশন ওয়ারেন্ট দেয়া আছে বলে জানতে পেরেছি। ওই প্রডাকশন ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার হলে কারামুক্ত হবেন নুর আলম।
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে কারাগারে আছেন নুর আলম। এ সময়ের মধ্যে তার ছেলে রাফী (১৮) মারা গেছে আর স্ত্রীর বিয়ে হয়েছে অন্য জায়গায়। বর্তমানে বাড়িঘর জমিজমা কিছুই নেই তার। প্রথম জীবনে জাহাজে চাকরি করতেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থানার আজিমপুর গ্রামের বাসিন্দা নুর আলম। সেই চাকরি ছেড়ে যোগ দেন এরশাদ শিকদারের বডিগার্ড হিসেবে।
এদিকে, কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের জন্ম ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামে। তার বাবার নাম বন্দে আলী শিকদার। ১৯৬৭ সালে জন্মস্থান নলছিটি থেকে খুলনায় চলে যান এরশাদ। কিছুদিন পর রেলস্টেশনের কুলির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তিনি। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে রেললাইনের পাত চুরি করে বিক্রি করা শুরু করেন।
পরে একটি দল গঠন করেন এবং এলাকায় ‘রাঙ্গা চোরা’ নামে পরিচিতি পান এরশাদ শিকদার। মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই ১৯৭৬ সালে ‘রামদা বাহিনী’ নামে একটি সন্ত্রাসী দল গঠন করেন এরশাদ শিকদার। যারা খুলনা রেলস্টেশন ও ৪ নম্বর ঘাট এলাকায় চুরি-ডাকাতি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এই রামদা বাহিনী নিয়েই ১৯৮২ সালে রূপসার ৪ ও ৫ নম্বর ঘাট এলাকা দখল করেন এবং এর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এরশাদ শিকদার।
এরপর ওই বছর থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ১৪ বছরে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ যে দলই ক্ষমতায় আসে, তাতেই যোগ দিয়ে নিজের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন এরশাদ। সর্বশেষ আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার কিছুদিন পরই নানা সমালোচনার মুখে বহিষ্কৃত হন সন্ত্রাসী এরশাদ।
যদিও ১৯৯৯ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন এরশাদ শিকদার। কারণ রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর আরও ক্ষমতাসীন হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত খুলনার রেলওয়ের সম্পত্তি এবং জোরপূর্বক ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। এসময়ের মধ্যে ৬০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন এরশাদ শিকদার। যেগুলোর মধ্যে ২৪টি হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন বডিগার্ড নুর আলম।
এনএস/এসি