যুদ্ধ এখন মশা ও মানুষের মধ্যে
মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)
প্রকাশিত : ১২:১২ এএম, ৫ আগস্ট ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৪:০৭ পিএম, ৫ আগস্ট ২০১৯ সোমবার
সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে মশা আর মানুষের মধ্যে তুমুল এক যুদ্ধ এখন চলমান। তাতে মশার ভয়ে মানুষ সর্বদাই আতঙ্কিত এবং সন্ত্রস্ত। কখন কোন ফাঁকে সেই প্রাণঘাতি এডিস মশা আক্রমণ করে বসবে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে ইতিমধ্যেই ৫০ জন মানুষকে হত্যা (মৃত্যু) করেছে মশক বাহিনী। আহত হয়ে কয়েক হাজার মানুষ এখন হাসপাতালে শায়িত। মানুষের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের কনভেশন অনুযায়ী হাসপাতাল থাকে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে। কিন্তু মশক বাহিনী, হাসপাতালে ঢুকে ডাক্তারদেরও ছাড়ছে না। ইতিমধ্যে এক ডাক্তারের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। এ এক অন্যরকম শত্রু। ঘরের মধ্যে থেকেও মানুষ নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারছে না। ঘরের মধ্যে বসেও আতঙ্কময় সময় কাটাতে হচ্ছে।
আক্রমণ প্রথমে ঢাকায় শুরু হলেও স্বল্প সময়ের মধ্যে মশক বাহিনী বিজয় ডঙ্কা বাজাতে বাজাতে ৬৪ জেলায় পৌঁছে গেছে। রাজধানীবাসীর প্রতি সঙ্গত কারণেই মফস্বলে বসবাসকারি মানুষের এক ধরনের ঈর্ষা থাকে। এতদিনে এডিস মশক বাহিনীর শুধু রাজধানীবাসীকে শত্রু হিসেবে বেছে নিয়েছিল বিধায় মফস্বলের মানুষ হয়তো পুলকিত মনে ভেবেছে, দেখো এবার রাজধানীতে বসবাস করার মজা। কিন্তু মশক বাহিনী যে এতো দ্রুত মত পাল্টিয়ে মফস্বল পর্যন্ত ধেয়ে যাবে তা কেউ ভাবতে পারেনি। রাষ্ট্রের হর্তা-কর্তারাও না। শত্রুর আক্রমণের পূর্বাভাস মফস্বলবাসী পায়নি। কেউ দেয়নি। ঢাকা শহরবাসী এখন বাথরুমে যেতেও ভয় পাচ্ছে। কারণ বাথরুমের ভেতর মানুষ আরও বড় টার্গেট হয়ে মশার কাছে ধরা পড়ে। দংশন করার বিস্তৃত জায়গা পায় মশক বাহিনী। সব যুদ্ধেরই নিয়ম হলো দুই পক্ষের মধ্যে যেপক্ষ অপরপক্ষের বিরুদ্ধে লুকিয়ে থেকে যতবেশি আকস্মিক আক্রমণ চালাতে পারবে সেই পক্ষেরই জয়লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই কৌশলের জায়গায় মশক বাহিনী অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
মানুষ আর মশার যুদ্ধ এখন তুঙ্গে। রাজধানীতে মানুষের পক্ষে উত্তর ও দক্ষিণের দুই সেনাপতি থেকে থেকে বড় বড় হু্ঙ্কার দিচ্ছেন এবং নিজেরাও মাঝে মধ্যে সম্মুখ শহরে অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু মশক বাহিনীর বিজয় ডঙ্কা বেজেই চলেছে। মানুষের হতাহতের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মশক বাহিনীর অনেক সুবিধা। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের হতাহত যতই হোক না কেন, রাতরাতি বংশ বৃদ্ধির সুবিধাতে মশককূলের জনবল ঘাটতির কোন সংকট নেই। মানুষ যতই পিছু হটে মশারির ভেতর ঢুকে যাচ্ছে তারা ততই হুঙ্কার দিয়ে বেশি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের জন্য যুদ্ধাস্ত্রের অনেক ঘাটতি। লাফ দিয়ে চাহিদা বাড়ায় কয়েল, এ্যারোসল, রেপলেন্ট অয়েল, মলম, মশারীর ঘাটতি সৃষ্টি হওয়াতে মহাখুশিতে বগল বাজাচ্ছেন এসব দ্রব্যের ব্যবসায়ীরা। এদেরই বলা হয় জাত ব্যবসায়ী। জাত ব্যবসায়ীদের এন্টিনা অনেক লম্বা থাকে। কথায় আছে কারো সর্বনাশ, আবার কারো পৌষ মাস।
দুই সিটি কর্পোরেশনের সৈন্যবাহিনী খালি হাতে বীর দর্পে যুদ্ধের ময়দানে আছেন। অসীম সাহসের স্বীকৃতি স্বরূপ জনগণ দুই সিটি কর্পোরেশনের সৈন্যদের জন্য বীরত্ব পদকের সুপারিশ করতে পারেন। কারণ, খালি হাতে শত্রুর সম্মুখে দাঁড়ানো তো চাট্টিখানি কথা নয়। উত্তর ও দক্ষিণের দুই প্রধান সেনাপতির হুঙ্কার দেখে মনে হচ্ছে এই মহাশত্রু মশক বাহিনী খাল, বিল, রাস্তা, নর্দমা, পুকুর, বাড়ির ছাদে, এমন কি বাথরুমের ভেতরে থাকলেও তাদের ধ্বংস করা হবে। মশক বাহিনীর কাছে সারেন্ডার! নো নেভার! ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করার জন্য দুই সিটি কর্পোরেশনের অনুকূলে এবছর নাকি ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তারপরেও ঢাল তলোয়ারহীন দুই সেনাপতির হুঙ্কার শুনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে চার্চিলের সেই বিখ্যাত ভাষণের কথা মনে পড়ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে হিটলারের বাহিনী ফ্রান্সসহ পশ্চিম ও উত্তর ইউরোপের সব ভূ-খণ্ড দখল করে যখন ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মূল ভূ-খণ্ড ইংল্যান্ড দখল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ব্রিটের প্রধানমন্ত্রী চ্যাম্বারলীন ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করেন। তাঁর স্থলে প্রধানমন্ত্রী হন চার্চিল। চার্চিল দেখলেন ততদিনে ব্রিটিশ জনগণ ও সেনাবাহিনীর মনোবল একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে এবং যুদ্ধের অস্ত্র-সরঞ্জামাদিও অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। চার্চিল ভাবলেন এই মুহূর্তে ব্রিটিশ জনগণ ও সেনাবাহিনীর মনোবল বৃদ্ধি করাই হবে তাঁর প্রথম অনিবার্য কাজ। তাই ১৯৪০ সালের জুন মাসে পার্লামেন্টে চার্চিল সেই বিখ্যাত ভাষণটি দিলেন। ভাষণের মধ্যে বললেন, জলে, স্থলে, সমুদ্রে, পথে-ঘাটে, রাস্তায়, পাহাড়ে, জঙ্গলে, আকাশে, অন্তরীক্ষে, সর্বত্র শত্রুর সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করব, কখনোই সারেন্ডার করবো না। চার্চিলের জোরালো উদ্দীপক শক্তিশালী কথা ও ভঙ্গিমায় পার্লামেন্টের সদস্যগণ মুগ্ধ এবং উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ভীষণভাবে তালি দিতে থাকেন প্রায় দুই-তিন মিনিট ধরে। তালির এই শব্দের আড়ালে পাশে উপবিষ্ট বন্ধুর কানের কাছে চার্চিল মাথা নিচু করে অত্যন্ত আস্তে আস্তে বলেন, কাঁচের মদের বোতলের ভাঙ্গা বাট দিয়েই আমাদের যুদ্ধ করতে হবে, কারণ এটা ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র আর আমাদের হাতে নেই।
রাজধানীর উত্তর-দক্ষিণের দুই সেনাপতি যুদ্ধ করবেন কি অস্ত্র দিয়ে। তাদের কাছে তো কাঁচের ভাঙ্গা বোতলের বাটও নেই। প্রায় পাঁচ মাস আগে এডিস মশক বাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি ও আক্রমণের পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তাছাড়া ঢাকা শহর এখন বসবাসের জন্য অযোগ্য হিসেবে বিশ্বের মধ্যে দুই বা তিন নম্বরে আছে। এর বহুবিধ কারণের মধ্যে বলা হয়েছে ভয়ানক পরিবেশ দূষণ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দারুণ অভাব। বৃহত্তর অর্থে পরিবেশ দূষণের অনেক বড় বড় কারণ রয়েছে, যার সব কিছু সিটি কর্পোরেশন একা দূর করতে পারবে না। আবার অনেক কিছুই আছে সিটি কর্পোরেশনের সদিচ্ছা আর দায়বদ্ধতা থাকলে দূর করা সম্ভব। রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখা থেকে শুরু নর্দমা, খাল, পুকুর ও বর্জ্য পরিষ্কারের কাজটি তো অন্য কারো সহযোগিতা ছাড়াই সিটি কর্পোরেশন করতে পারে। ঢাকা শহরের অনেক অলি-গলিসহ বড় বড় রাস্তা আছে যেখানে এখনো মুখে রুমাল না দিয়ে চলাফেরা করা যায় না।
দখলবাজির দৌরাত্মে নদী, খাল, পুকুরের পানি প্রবাহ ও নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বন্যা ও বৃষ্টির পানিতে এই জলাবদ্ধতার জায়গাগুলো পরিণত হচ্ছে মশা বৃদ্ধির কারখানায়। বর্ষার সময়ে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট খোড়াখুঁড়ি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় খানাখন্দে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে সীমাহীন মাত্রায় এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি ঘটছে। ফলে ডেঙ্গু জ্বর এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। মণীষীরা বলেছেন, প্রকৃতির ক্ষতি সাধন করলে তার প্রতিশোধ প্রকৃতি নিবেই। ইংরেজিতে বলা হয় রিভেঞ্জ অব নেচার কেউ এড়াতে পারবে না। তাই দার্শনিক ও বিজ্ঞানের শিক্ষা হলো, মানিয়ে চলতে পারলে প্রকৃতি সব সময়ই মানুষের সহায়ক শক্তি হতে পারে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট জগতের সীমাহীন লোভ প্রলোভনের শিকার হওয়াতে প্রকৃতি এখন ক্রমশই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব প্রতিনিয়তই এখন ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন ও সুনামির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে, যা এক সময় সীমাবদ্ধ ছিল এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর ভেতর। জলবায়ু দূষণের পরিধি ও প্রভাব এখন প্রশান্ত মহাসাগর ছাড়িয়ে আটলান্টিকের ওপারে আমেরিকার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধে বৈশ্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশ অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এডিস মশা নিধনের দায়িত্ব এতদিন শুধুমাত্র ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ওপর ছেড়ে দিয়ে মানুষ আজ সত্যিই অসহায় বোধ করছে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা চেষ্টার ত্রুটি করেনি। কিন্তু মানুষ তাদের কথায় আস্থা রাখতে পারছে না।
অন্যদিকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় দেশের মানুষ যখন দিশাহারা তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপরিবারে বিদেশ ভ্রমণে বাহির হয়ে জনগণের তোপের মুখে পড়েছেন। এতদিনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্পর্কে ভালো কথাই শুনেছি, খারাপ কিছু শুনিনি। কেন তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিলেন তা কেবল তিনিই বলতে পারবেন। ডেঙ্গুর আক্রমণে দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যখন নাজুক অবস্থায় তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিদেশ গমন মানুষ ভালো চোখে দেখবে না সেটাই স্বাভাবিক। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে কেউ থাকতে পারবেন না এটা যেমন সত্য, তেমনি এমন দুর্যোগের সময় শুধু দোষারোপ করে লাভ হবে না। জনগণ, সরকার ও সিটি কর্পোরেশন, সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামতে হবে।
মশার সঙ্গে যুদ্ধে এই একবিংশ শতাব্দিতে মানুষ হেরে যাবে তা তো হতে পারে না। নমরূদের যুগ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এডিস মশা প্রতিরোধের ওষুধের জন্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বসে থাকলে চলবে না। জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিলে স্বল্প সময়েই তা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে টাকার কথা ভাবলে চলবে না। সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। নিজ নিজ বাসা, বাড়ি ও তার আশপাশে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ডেঙ্গু সৃষ্টিকারি মশার জন্মস্থল ধ্বংস করতে পারলে মশক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হবে। মনে রাখতে হবে ডেঙ্গু মফস্বল শহর ও গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। শুধুমাত্র সরকারের একার পক্ষে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। প্রশাসনিক তৎপরতার পাশাপাশি জনগণ সতর্ক হলে মানুষের অবশ্যই জয় হবে, মশক বাহিনীর নয়।।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
sikder52@gmail.com