কাশ্মীরে কী চায় ভারত?
আজাদুল ইসলাম আদনান
প্রকাশিত : ০২:৩২ পিএম, ৮ আগস্ট ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০২:৫২ পিএম, ৯ আগস্ট ২০১৯ শুক্রবার
১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগের পর কেটে গেছে একে একে ৭২টি বছর। শুরু থেকে স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানিয়ে আসা কাশ্মীর নিয়ে বিতর্কের চূড়ান্ত অবসান গত তিনদিন আগ পর্যন্ত হয়নি। দেশভাগ পরবর্তী জন্মু-কাশ্মীরের শাসক হরি সিংয়ের এক সিদ্ধান্তের ফলে যুগের পর যুগ ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতনে অন্তত ৯৫ হাজার কাশ্মীরিকে প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীনতার জন্য।
সে সময় কাশ্মীর নিয়ে স্থায়ী কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়ায় ভারতের সংবিধানে জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়। সংবিধানের ৩৫ (ক) ধারা ও ৩৭০ অনুচ্ছেদে এ অঞ্চলের মানুষকে পররাষ্ট্র, যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি সবক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল। তাদের আলাদা পতাকা, প্রধানমন্ত্রী ও সংবিধান ছিল।
অখণ্ড এ রাজ্যটির জন্য চির শত্রুতায় পরিণত হয়েছে দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তান। যাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি বড় ধরনের হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। শুরু থেকে কাশ্মীরকে নিয়ে এ ধরনের যত হামলা হয়েছে তাতে এ অঞ্চলের মানুষের বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি বরং ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে বার বার।
আন্তর্জাতিকভাবেও এর সমাধানে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও, দুই দেশের ভনিতার কারণে সে উদ্যোগ বারবার ভেস্তে গেছে। এক্ষেত্রে ভারতের একঘুয়েমিতাকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সবার মনে একটাই জিজ্ঞাসা- ভূ-স্বর্গ খ্যাত কাশ্মীরে ভারত আসলে কি চায়?
গত সোমবার (৫ আগস্ট) হঠাৎ করেই প্রবল বিরোধীতা ও সমালোচনা সত্যেও ভারতীয় পার্লামেন্টে সংবিধানের ৩৯০ ধারায় কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের যে নিশ্চয়তা ছিল, মোদি সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। এর সঙ্গে ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত কাশ্মীরিদের বিশেষ সুবিধাও বাতিল হয়ে যায়। ফলে দীর্ঘদিন স্বাধীনতাকামী জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয়শাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। বিধানসভাযুক্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও বিধানসভাবিহীন লাদাখ নামে দুটি রাজ্যে ভাগ করা হয়। এর ফলে কাশ্মীরকে নিয়ে যত বাধা তার সব অতিক্রম করলেন মোদি সরকার।
এতোদিন ‘৩৫-এ’ অনুযায়ী কাশ্মীরের বাসিন্দা নন এমন ভারতীয়দের সেখানে সম্পদের মালিক হওয়া ও চাকরি পাওয়ায় বাধা ছিল। এখন চাইলেই যে কোনও ভারতীয় নাগরিক সেখান ভূমিসহ অন্যান্য সম্পদ কিনতে সক্ষম হবে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত কাশ্মীরিদের বিশেষ সুবিধা অকার্যকর করার মধ্য দিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক চরিত্রে পরিবর্তন আনতে চাইছে বিজেপি।
এদিকে গত সোমবার বিলটি পাস হওয়ার পরদিনই বিতর্কিত মন্তব্যে জড়িয়ে পড়েন মোদির শিষ্য ‘যোগী রাজ্যের’ এক বিজেপি বিধায়ক। কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করার আনন্দ-উৎসব চলছিল উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে। মঙ্গলবার খাতাওলির বানকোট হলের ওই উৎসবের মাঝেই বিধায়ক বিক্রম সাইনি দলীয় কর্মীদের বলেন, ‘ফর্সা টুকটুকে কাশ্মীরি মেয়েদের বিয়ে করতে পারবেন। আর কোনো বাধা রইল না।’
তিনি বলেন, ‘মোদিজি আমাদের স্বপ্নপূরণ করেছেন। কর্মীরা আজ ভীষণ খুশি। বিজেপি কর্মীরা উচ্ছ্বাস করছেন। আগে কোনো কাশ্মীরি মেয়ের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের কারও বিয়ে হলে নাগরিকত্ব বদলাতে হতো। উপত্যকার মেয়েদের বাইরে বিয়ে হলে নাগরিকত্ব বাতিল হতো। এবার আর বিয়েতে কোনো বাধা রইল না। ওখানের ফর্সা-সুন্দরী মেয়েদের বিয়ে করতে পারবেন উত্তরপ্রদেশের নাগরিকও।’এর আগেও বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছিলেন এ বিজেপি নেতা।
অপরদিকে গত সোম ও মঙ্গলবার ব্যাপক সমালোচনার মুখে ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা ও নিম্নকক্ষ লোকসভায় ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত অনুমোদনের একদিন পরই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ গতকাল বুধবার বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে অযোধ্যায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠায় আরও একধাপ এগোলো ভারত। খুব অল্প সময়ে সেখানে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা পাবে বলে জানান বিজেপির এ নেতা।
এদিকে, ভারত যেভাবে রাতারাতি কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ভাগ করছে, তাতে সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। তাদের সম্পাদকীয় কলমে মোদি সরকারের এ পদক্ষেপের নানা দিক খতিয়ে দেখা হয়েছে।
আমেরিকার ওয়াশিংটন পোস্টে লাফায়েত্তি কলেজের অধ্যাপক হাফসা কাঞ্জওয়াল লিখেছেন, মোদি সরকার সংবিধানবিরোধী কাজ করেছে। খুব পরিকল্পিতভাবে একটি রাজ্যে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।
তার লেখায়, ভারতীয়রা এখন কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবেন। স্থানীয় মানুষকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের তাড়িয়ে দিয়েছে, সেই একই পদক্ষেপ নিচ্ছে ভারত। সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাশ্মীরে বিরাট সংখ্যক সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। কাশ্মীরের বিরাট এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট, ক্যাম্প আর বাঙ্কার। ভারতের রুলিং পার্টির বহুদিনের পরিকল্পনা হল, সেখানে অনেক হিন্দুর বসতি করানো। তাহলে রাজ্যের সংখ্যাগুরু মুসলিম জনতার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে সহজে দমন করা যাবে।
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় কাশ্মীর নিয়ে লিখেছেন সাংবাদিক জ্যাসন বার্ক। তার ধারণা, কাশ্মীরের যুবকরা আগামী দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ন’য়ের দশকে কাশ্মীরে অনেক খুনখারাবি হয়েছে। সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা প্রবীণরা জানেন। তরুণ প্রজন্ম সেই সময়টা দেখেনি। বড়দের মুখে গল্প শুনেছে। যারা ন’য়ের দশকের হানাহানি দেখেছে, তারা সহজে কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দেয়নি। কিন্তু এখনকার যুবকরা তাদের মতো নয়। বহু তরুণ ভাবছে, এতদিনে সময় এসেছে। এর পরিণতি কাশ্মীর ও ভারতের পক্ষে হয়তো ভালো হবে না।
আল জাজিরা টিভিতে রাজনীতি বিশেষজ্ঞ আথের জিয়া বলেছেন, ৩৭০ ধারার বিলোপ করে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে আরও এক ধাপ এগোলো মোদি সরকার। তা নিয়ে মোদি ১৫ আগস্টের ভাষণে আস্ফালন করবেন। তার দক্ষিণপন্থী সরকার দাবি করবে, তারা হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। মোদি সবাইকে বোঝাতে চাইবেন, তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ভীত নন।
জেরুজালেম পোস্টে পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ সেথ ফ্রাঞ্জম্যান লিখেছেন, কাশ্মীর ইস্যু মানে শুধু আর্টিকেল ৩৭০ নয়, তার গুরুত্ব অনেক বেশি। তার সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সম্পর্ক আছে। ভারতের সঙ্গে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তারা নিজেদের সেনাবাহিনীকে আরও আধুনিক করে তুলতে চায় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আই/