অন্য চোখে দেখা ভালোবাসার সেই মানুষটি
রাশেদ খান মেনন
প্রকাশিত : ০৪:০৫ পিএম, ১৮ আগস্ট ২০১৯ রবিবার
ইতিহাসের বীরদের নিয়ে লেখা বেশ দুরূহ কাজ। তার ওপর সেই বীর যদি সমসাময়িক কালের হয় তখন তার সম্পর্কে লেখায় আবেগের প্রাধান্য থাকে। নির্মোহ বিশ্লেষণ থাকে কমই। আর সে ধরনের নির্মোহ বিশ্লেষণ করার মধ্যে ঝুঁকি থাকে। কারণ সে ধরনের বিশ্লেষণে ইতিবাচক মন্তব্যের পাশাপাশি সমালোচনাও থাকে, যা তার অন্ধ অনুরাগীরা সহজে গ্রহণ করতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সে ধরনের লেখার সময় এখনও হয়েছে কি-না সেটা বলা মুশকিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তার ইতিহাসকে নিয়েই যখন এত বছর পরও বিতর্ক বিদ্যমান তখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা থাকবেই। তবে সব কথার মধ্যে যে সত্যটি ইতিহাস থেকে, বাঙালি জাতির জীবন থেকে হাজার চেষ্টাতেও বাদ যাবে না, তা হলো তিনি হাজার বছরের বাঙালি জাতিকে রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতা তো বটেই, তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতাও।
বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তার মধ্য দিয়েই মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তার অবর্তমানে তার নামেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে যখন তিনি এই দেশের মানুষের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সেই মুহূর্তেই তারা তাকে পিতার আসনে অভিষিক্ত করেছিল। তার প্রতি ভালোবাসায় যেমন এ দেশের মানুষের খাদ ছিল না, তেমনি সেই ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে অপ্রাপ্তির বেদনাও তাদের আঘাত করেছে গভীরভাবে।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই ভালোবাসা এবং একই সাথে আশু আশা পূরণ না হওয়ার দুঃখবোধ তার সম্পর্কে সাময়িককালের জন্য দৃষ্টি বিভ্রম ঘটায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই ভালোবাসারই জয় হয় এবং হচ্ছে। এ কারণেই এত বছরের ধারাবাহিক বিরূপ প্রচারণা, ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টার পরও তিনিই এ দেশের মানুষের মনে সবচেয়ে উঁচুতে আছেন এবং যতদিন বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন সেখানেই থাকবেন।
আমার ছাত্র-আন্দোলনের জীবনের সূত্রপাত একজন সাবেক ছাত্রনেতাকে যিনি তার সময়ে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, জিজ্ঞাসা করেছিলাম ভালো ছাত্রনেতা হওয়া যায় কীভাবে। তার উত্তর ছিল ভালোবাসা দিয়ে। ওই ভালোবাসার ভরসায় ছাত্ররা যখন তাদের সমস্যা-সঙ্কট, প্রেম-বিরহ পরিবারের অবস্থা থেকে ভবিষ্যৎ জীবন পরিকল্পনার কথা খুলে বলবে, পরামর্শ চাইবে তখন বুঝবে সত্যিকার ছাত্রনেতা হয়েছো। দেশনেতা, জননেতার ক্ষেত্রেও সেই কথা প্রযোজ্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের মানুষকে সে ধরনের ভালোবেসেছিলেন। আর ভালোবেসেছিলেন বলেই তার জন্য জীবনবাজি লড়াই করতে এ দেশের মানুষ পিছপা হয়নি।
এই লেখায় বঙ্গবন্ধুর সাহস, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নেতৃত্বের গুণ, স্বাধীনতার জন্য তার অকুতোভয় ভূমিকার কথা বলব না। কেবল তার ওই ভালোবাসার কথা বলব। তবে এটা মূলত সীমাবদ্ধ থাকবে রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি তার ভালোবাসা- যেটা তার দলকে অতিক্রম করে নিয়তই অন্য দলের কর্মীদেরও স্পর্শ করত। রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থা ও ভালোবাসার পরিচয় যারা পেয়েছে তাদের স্মৃতিতে সেটা চিরজাগরূক থাকবে।
এমনকি অন্য দলের এই রাজনৈতিক কর্মীরা যখন তার সাথে ঘোর রাজনৈতিক বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে, তখনও তাদের প্রতি তার ওই ভালোবাসা কখনও উবে যায়নি। আর নিজের সমসাময়িক রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে তাদের ঘোর রাজনৈতিক-বিরোধী অবস্থানের কথা জেনেও তিনি তাদের সম্মান দিতে কুণ্ঠা করেননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-বিরোধিতাকারীরা এমনকি যুদ্ধাপরাধীরা যখন তাদের বিচারের দাবি থেকে রেহাই পেতে বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আড়ালে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে, তখন তারা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ঔদার্য্যের বিষয়টিকে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেয়। এ কথার মধ্য দিয়ে অবশ্য ওই স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থেকে রেহাই দেয়ার কোনো কথা বলা হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু তার ওই সাধারণ ক্ষমতায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে ক্ষমা করেননি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। এখানে যেটা বলার সেটা হলো রাজনীতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর সম্মান ও ভালোবাসার সম্পর্ক তাকে এখনও বিশিষ্ট করে রেখেছে। বাংলাদেশ পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য যেসব রাজনৈতিক নেতা জেলে আটকে ছিলেন, জেলখানায় তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে তো বটেই, তাদের পরিবার-পরিজনের সংবাদাদিও তিনি রাখতেন। তাদের সহায়তাও করতেন।
কথিত আছে যে বিশিষ্ট মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর রাজনীতিকদের প্রতি তার এই সম্মানবোধ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতেন বলে সেই ভরসায় জেল থেকে তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে আবেগস্পর্শী চিঠি দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার সেই চিঠির জবাবে তাকে তার বিশেষ দূত পাঠিয়ে জেল থেকে বের করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যখন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জনমন থেকে মুছে দেয়ার প্রক্রিয়ার প্রচার অভিযান শুরু হয়েছে, পার্লামেন্টের বক্তৃতায় জিয়ার আশীর্বাদে নির্বাচিত নব্যরাজনীতিকরা তাদের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর কলঙ্ক লেপন করতে বিশেষ ব্যস্ত ছিল, সেই পার্লামেন্টে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাগ্মী হিসেবে খ্যাত মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরের মুখ থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কোন বিরূপ মন্তব্য শোনা যায়নি। একই কথা শাহ আজিজ সম্পর্কেও; বাকচাতুর্য্যের ফোয়ারা ছুটিয়ে পার্লামেন্টকে মাত করে রাখলেও, বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে তিনি খুব একটা কিছু বলেছেন বলে মনে পড়ে না।
এ তো গেল রাজনীতির ক্ষেত্রে চির-বৈরীদের সম্পর্কে তার মনোভাব, আর যারা রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা নিয়েও তার আন্দোলনের সহযাত্রী ছিল তাদের জন্য তার হৃদয়ে আলাদা জায়গা ছিল, ভালোবাসা ছিল। তার সেই ভালোবাসার পরশ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার বহুবার। আর তার মধ্য দিয়ে তাকে চিনেছিলাম গভীরভাবে।
৬-দফা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ের কথা। ৬-দফার কারণে বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ঘুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দেওয়ানিতে স্থিত হয়েছেন। মোনেমী-শাসনের দায়ের করা এক মামলায় তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড নিয়ে ওই কারাগারের পুরনো বিশ সেলে আমাকেও নেয়া হয়েছে। সে সময়ের প্রধান ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম তো বটেই, তার কিছুদিন আগ পর্যন্ত ডাকসুর ভিপিও ছিলাম।
নিজের পরিচয়, পারিবারিক পরিচয়, কোনো পরিচয়তেই মোনেম সরকার আমাকে জেলখানায় ডিভিশন দিতে রাজি হয়নি। সে কারণে ডিসেম্বরের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় তিন কম্বল সম্বল করে পুরনো বিশ সেলের মেঝেতে শয়ান ব্যবস্থা। সামনে কোনো আগল নেই, যা দিয়ে শীতের হাওয়া আটকে রাখা যায়। রাতে ‘লকআপে’ ঢুকে সেভাবে রাত কাটাবার পর ভোর না হতেই দেওয়ানি থেকে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো চা আর লেপ সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল। তারপর ওই সেলে যতদিন ছিলাম প্রতিদিন ভোরের নাস্তা আসত বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে।
আবার যখন বাইরে থেকে ঘুরে সাতষট্টির মধ্যভাগে জেলে নীত হলাম সেবারও সেই দেওয়ানির পেছনে নিউ বিশ সেলের চিনতলাতে ঠাঁই হয়েছিল। আর সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন কোর্টে মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে আসা-যাওয়া উভয় পথে দেখা হওয়ার মধ্য দিয়ে এক বিরল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ভবিষ্যতে সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়া এই নেতার সাথে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তখন একের পর এক মামলা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তোলা হচ্ছে সরকারি বক্তৃতা-বিবৃতিতে। তার কিছুদিন পরেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে জড়ানো হয়। ওই কোর্টে যাওয়া-আসার পথে বাইরের জগতের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্র হিসেবে কাজ করার অনবদ্য সুযোগ পেয়েছিলাম সে সময়।
বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, তাদের সুখ-দুঃখ সম্পর্কে তার উদ্বেগ-অনুভূতির কথা জানতে পেরেছিলাম প্রায় দিনের এই যোগাযোগের আলাপচারিতায়। সব কথা স্মরণে নেই। তবে এই সময় ঈদের দিন আমাদের এলাকা থেকে জেলের পাঁচ খাতায় ঈদের জামাতে যাওয়ার সময় সমস্ত পথ কাঁধে হাত রেখে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার চাওয়ার জন্য তাকে জীবনে শেষ করে দেয়ার আইয়ুব-মোনেমের যে ষড়যন্ত্রের কথা তিনি বলেছিলেন সেটা এখনও স্মৃতিতে আছে। এর কিছুদিন পর আমি জেলখানার এক-দুই খাতায় স্থানান্তরিত হই। আর বঙ্গবন্ধু তার কিছুদিন পরই স্থানান্তরিত হন ক্যান্টনমেন্টে-আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর আবার দেখা। ক্যান্টনমেন্ট থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্স ময়দানে তিনি ইতিমধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন। কিন্তু আমাদের কাছে মুজিব ভাই-ই রয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ওই গণঅভ্যুত্থানকে ধ্বংস করতে জেনারেল ইয়াহিয়ার যে সামরিক-শাসন জারি হয়, তার কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধু হায়দার আকবর খান রনোর ৩২ নম্বর রাস্তার বাসা থেকে দু’জনে তার বাসার সামনে দিয়ে আসছি, তিনি আমাদের ভেতরে ডেকে নিলেন। ৩২ নম্বরের ওই বাড়ির সবুজ মাঠে পাঁয়চারী করতে করতে শোনালেন তার স্বাধীন বাংলার স্বপ্নের কথা। সেই স্বপ্নের বাংলার সমুদ্র উপকূল কক্সবাজার হবে সব দেশের মিলনস্থল। সুইজারল্যান্ডের মতো ছোট এই দেশটি হবে একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সেই সময় কেউ ভাবিনি যে তার মাত্র কিছু সময়ের মাথাতেই ওই বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের মানুষকে অস্ত্র ধরতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রই হবে না কেবল, জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানুষের কাছে বিশেষ পরিচিতি পাবে।
ঊনসত্তরের সেই দিনগুলোর পর সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ- এসবের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেলেন যেখানে সাধারণভাবে তার ছোঁয়া পাওয়া দুষ্কর হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অসাধারণ হয়েও তিনি এ দেশের মানুষের কাছে অতি সাধারণই রয়ে গিয়েছিলেন। তার ব্যবহারে, কথায়, চালচলনে তার ওই সুউচ্চ অবস্থানের পরও দল ও দলের বাইরে নেতা-কর্মীদের প্রতি, জনগণের প্রতি তার সেই পুরান ভালোবাসার প্রকাশ একই রকম ছিল। তাকে এবং ক্ষমতাকে ঘিরে অবশ্য তখন নতুন স্বার্থবলয় গড়ে উঠেছে। স্তুতির বন্যায় যুক্তির শক্তি ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু তার মাঝেও দল ও দলের বাইরে রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি তার ভালোবাসার টান এতটুকু কমেনি।
এমনি সময়ে একদিন মিরপুর রোড দিয়ে রিকশায় যাচ্ছি। হঠাৎ পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ির কাঁচ নামিয়ে আমার নাম ধরে বঙ্গবন্ধুর ডাক। চমকে তাকাতেই দেখলাম তার স্বভাবসুলভ রসিকতায় হাত দিয়ে কান মলে দেয়ার ভঙ্গি করছেন। বঙ্গবন্ধু তখন কেবল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জননন্দিত নেতা। কিন্তু এখন যেমন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য আগে-পিছে নিরাপত্তারক্ষীর গাড়িবহরের পাশাপাশি সারা রাস্তা জনমানুষকে ফাঁকা করে দিতে হয়, বঙ্গবন্ধুর জন্য তার প্রয়োজন পড়েনি। অতি সাধারণভাবেই তিনি মানুষদের সাথে মিশে থাকতে পেরেছেন। কিন্তু সেই সাধারণ ব্যবহারের মধ্যেও যে অসাধারণত্ব ছিল সেটাই তাকে চিরজীবী নেতা বানিয়েছে। আর ওই অসাধারণত্বই তার রাজনীতির বিরুদ্ধবাদীদেরও স্মৃতির মণিকোঠায় অমূল্য ঐশ্বর্য হিসেবে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার তিন বছর পার হয়েছে। বহু আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে বঙ্গবন্ধু তখন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করেছেন। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী রেকর্ড সময়ের মধ্যে পাস হয়েছে। জাতীয় দলের ঘোষণা হয়েছে আর কোনো দলের অস্তিত্ব থাকবে না; গণসংগঠনেরও নয়। এ ধরনের এক অবস্থায় বঙ্গবন্ধু তার একান্ত সচিব ড. ফরাসউদ্দিন মারফত ডেকে পাঠালেন আমাকে আর হায়দার আকবর খান রনোকে।
আমাদের আবদার অনুসারে তার বাসাতেই দেখা করা স্থির হয়েছিল। সে-মতো ৩২ নম্বরের ধানমন্ডির বাসায় তার স্টাডিতে যখন অপেক্ষা করছি তখন তিনি ঘরে ঢুকেই স্টাডিতে আলমারির বইগুলো দেখতে থাকা আমাদের টিপে বললেন, ‘কি দেখছিস? মার্কসের বইও আছে।’ যে কঠিন রাজনৈতিক বিষয়ে আলাপ করার জন্য আমাদের ডেকে পাঠিয়েছেন তার সূত্রপাতেই পরিবেশ সহজ হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু তার একদল গঠন করার প্রেক্ষাপট বললেন। বললেন তিনি সমাজতন্ত্র করতে চান। তার সাথে যেন যোগ দেই। প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আলাপে কখনও তিনি আমাদের বিরোধী যুক্তি শুনে ক্ষেপে গেছেন। আত্মগোপনে গিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের আপত্তিটা বুঝেছেন। বলেছেন, ‘ওয়াচ অ্যান্ড সি, আমি কি করি।’ সেদিন তার বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনে এভাবে কথা বলার সাহস পেয়েছিলাম একটিমাত্র কারণে যে তিনি রাজনৈতিক কর্মীদের ভালোবাসতেন, তাদের আদর্শ ও বিশ্বাসকে সম্মান করতেন।
বঙ্গবন্ধুর সাথে সেটাই ছিল সরাসরি শেষ সাক্ষাৎ। তার পরের দিনগুলোর কথা সবার জানা। বঙ্গবন্ধুকে তার এই পদক্ষেপের জন্য স্তুতির বন্যায় ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে। রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক তো বটেই, সামরিক-বেসামরিক আমলারা একদলীয় ব্যবস্থার বাকশালে যোগ দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে, রোদ মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। তখনই পেছন দরজায় ষড়যন্ত্র রূপ নিয়েছে, যার পরিণতি ঘটে ১৯৭৫-এর পনেরই আগস্টে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায়। কিন্তু তারপরও সেই ভালোবাসার মানুষটিকে, তার ভালোবাসাকে হত্যা করা যায়নি। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন এ দেশের মানুষের ভালোবাসায়। সেই ভালোবাসা অবিনশ্বর।
(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেওয়া)
এএইচ/