ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হংকং’র বাংলাদেশিরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৪২ এএম, ১৯ আগস্ট ২০১৯ সোমবার

হংকং-এ প্রায় তিনমাস ধরে চলা গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলন দমনের জন্য চীনের হস্তক্ষেপ নিয়ে আশংকা ক্রমশ বাড়ছে। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ নিলে তা চীনের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর এর সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে তাও এই মুহূর্তে অনুমান করা কঠিন।

তবে বিবিসির চীন বিভাগের সম্পাদক হাওয়ার্ড ঝ্যাং বলছেন, হংকং সঙ্কট মোকাবিলায় চীন হস্তক্ষেপের জন্য যে প্রস্তুতি নিচ্ছে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

গত কয়েকদিনে চীন বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান শক্ত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তীক্ষ্ম ভাষায় মন্তব্য করেছে, এমনকি তাদের ‘সন্ত্রাসীদের’ সঙ্গে তুলনা করেছে।

হংকংবাসীদের জন্য উদ্বেগের কারণ হল উপর্যুপরি এগারো সপ্তাহ ধরে চলা বিক্ষোভের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে হংকং-এর অর্থনীতিতে।

হংকং-এর অর্থনীতির প্রায় ২০ শতাংশ পর্যটন এবং খুচরা ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল আর এই বিক্ষোভের ফলে এই দুটি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

হংকং-এর বড় একজন ব্যবসায়ী বাংলাদেশি সৈয়দ ইকরাম ইলাহী। তিনি হংকং-এ ২৪ বছর ধরে বসবাস করছেন।

বিবিসিকে বলছিলেন তার ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসার কেন্দ্র হিসেবে হংকং-এর যে পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল, তা তার ভাষায় অনেকটাই খর্ব হয়েছে।

‘ব্যক্তিগতভাবে আমার ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের বায়াররা স্কেয়ারড্ (ভীত)। ওরা আমাদের ব্যবসা দিতে একটু ভয় পাচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা। ওরা দেখছে আমাদের এখানে এরকম সমস্যা চলছে,’ বলছিলেন ইলাহী।

‘ওরা চিন্তিত যে আমরা আসলে ওদের মাল ঠিকমত রফতানি করতে পারব কি না। ওরা আমাদের ফ্যাবরিক আর অ্যাকসেসরিসরের অর্ডার দিয়ে থাকেন। আমরা যদি ঠিক সময়মত ওগুলো এক্সপোর্ট করতে না পারি, ওনারা তো ওনাদের গার্মেন্ট শিপমেন্ট করতে পারবেন না’।

এই মুহূর্তে ব্যবসায়ীরা যে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবেন তাদের উদ্বেগ নিয়ে, তার কোন সুযোগ নেই বলে জানালেন সৈয়দ ইকরাম ইলাহী। কারণ এখন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তার মতে বিক্ষোভ দমনে পুলিশ বা হংকং সরকার কোন কিছুই করতে পারছে না।

‘স্টুডেন্টস, সাধারণ মানুষ সবাই এই আন্দোলনে সায় দিয়েছে। অনেকে প্রতিবাদে নেমেছে। যতদিন পরিস্থিতি শান্ত না হবে, ব্যবসা বাণিজ্য খারাপ থাকবে। শেয়ার সূচকও পড়তির দিকে, যা আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য উদ্বেগের কারণ।’

বিবিসির সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন, হংকং-এর আর্থিক খাতের কর্মকর্তারা, বিমানবন্দরের কর্মীরা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মচারিরা এই বিক্ষোভকে সমর্থন করছেন- বিক্ষোভ এবং হরতালে যোগ দিয়েছেন। যার ফলে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্য নগরীর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে।

বিবিসির চীন বিভাগের সম্পাদক বলছেন, চীন যদি হংকং-এ হস্তক্ষেপ করে, বিক্ষোভকারীদের দমনে সেখানে সেনা নামায় তাহলে তার জন্য চীনকে কড়া মূল্য দিতে হবে।

‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং মুক্ত বন্দর এলাকা বলে হংকং-এর যে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে তা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী,’ বলছেন হাওয়ার্ড ঝ্যাং।

‘চীনকে আন্তর্জাতিক স্তরে বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়তে হবে, পশ্চিমা দেশগুলো চীনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাববে এবং বিশ্বে চীনের অবস্থান ও দেশটির অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে।’

হংকং-এ বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সৈয়দ ইকরাম ইলাহীরও ধারণা চীন কড়া হাতে এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেও তারা এ ধরনের পদক্ষেপ নেবে না।

‘মনে হয় না চীন সরাসরি নাক গলাবে। চীন হংকং-এ অনেক বিনিয়োগ করেছে। হংকং-এর অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য চীনের অবদান অনেক। হংকং-এ ব্যবসার ক্ষতি হয়, সেটা চীন হতে দেবে না। কারণ চীন ব্যবসার জন্য হংকং-এর ওপর নির্ভরশীল। আশা করছি একটা সমাধান নিশ্চয়ই হবে।’

পাঁচ বছরের ওপর হংকং-এ থাকেন বাংলাদেশি গৃহবধূ ফাহমিদা মজুমদার। বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, হংকং ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য তো বটেই এমনকি বসবাসের জন্যও শান্তির ও নিরাপদ শহর ছিল।

হালের এই বিক্ষোভ তাকে এবং তার মতো সেখানে বসবাসরত বহু বাংলাদেশি পরিবারের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

‘হংকং-এর এই বিক্ষোভের পরিণতি কী হয়- পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। মা হিসেবে আমার সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। বর্তমানে আমরা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’

‘আমার সন্তানদের অনেক বন্ধুবান্ধব হংকং-এর বাসিন্দা। তারা বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে। আমার ছেলেমেয়েরা এই বিক্ষোভে জড়িয়ে পড়বে কি না সেটা নিয়ে অবশ্যই উদ্বেগ আছে। চীন যদি হস্তক্ষেপ করে, হংকং-এর প্রশাসন যদি চীনের হাতে চলে যায়, আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত কী দাঁড়াবে এসব নিয়ে অনিশ্চয়তা আর আশংকায় দিন কাটছে আমাদের।’

ফাহমিদা মজুমদার বলছেন, হংকং-এ বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশ নানা ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই বিক্ষোভ দীর্ঘায়িত হলে এবং তা অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেললে সেটা বাংলাদেশিদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

হংকং-এ বিতর্কিত প্রত্যর্পণ বিষয়ক এক আইনের বিরোধিতা করে শুরু হওয়া এই আন্দোলন অবসানের আহ্বান জানিয়ে সম্প্রতি হংকং-এর সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী লি কা-শিং সেখানকার সংবাদপত্রে অনেকগুলো পূর্ণ পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।

উত্তেজনা প্রশমন এবং সহিংসতা বন্ধের ডাক দিয়ে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে হংকং এর আরও অনেক বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একই ধরণের বিবৃতি দিয়েছে।

সূত্র: বিবিসি