এই গল্পটা বঙ্গবন্ধুর
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০২:৩৪ পিএম, ২০ আগস্ট ২০১৯ মঙ্গলবার
আমাদের স্কুলের পশ্চিমের কোণায় কে যেন কবে একটা চারাগাছ বুনে গিয়েছিল। সেই চারা বড় হতে হতে একদিন পরিণত হলো বিশাল এক বটবৃক্ষে। আমাদের পুরো স্কুলসীমানাকে এই বৃক্ষ তার ডালপালার ছায়া দিয়ে প্রচণ্ড গরমের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে যেন সে একটা এয়ারকুলার। বটবৃক্ষ কি এয়ারকুলার? আমাদের মধ্যে তাই ধারণা হয়েছে যে বটবৃক্ষ মানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিনে পয়সার যন্ত্র। রাস্তা থেকে অথবা অন্য কোথাও থেকে কুড়িয়ে, চেয়ে-চিন্তে একটা বীজ কিংবা চারা এনে পুঁতে দাও বাড়ির চৌহদ্দিতে কিছুকাল পরে দেখবে জলজ্যান্ত এয়ারকুলার।
আজও ক্লাসে যখন নির্ধারিত সময় আবদুল লতিফ স্যার এলেন না তখন আমরা নাইনের যত প্রয়োজনীয়, অবাস্তব কাহিনী-কিচ্ছা নিয়ে যে যার মতো ফ্লোর নিয়ে জম্পেশ আড্ডা মেরে যাচ্ছি। আমাদের তিনতলার কোণের রুমটা ছিল মেথর-কলোনির পেছনের দিকে মুখ করে উজবেকিস্তানের (বন্ধুমহলে কাউকে হেয় করতে চাইলে সেই শ্রীমানের নাম দেয়া হয়- উজবুক ওরফে উজবেকিস্তান) মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
ক্লাসের ভেতর এখন দু’তিনটে গ্রুপ দেদারসে আড্ডা মারছে। কেউ সালমান শাহ, কেউ রাজনীতি, কেউ খেলাধুলা, কেউ বিতর্কের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে স্কুল উদ্ধার কার্যকলাপে লিপ্ত আবার কেউবা ধারাবাহিক নাট্যানুষ্ঠান, সংসদ অধিবেশন চলাকালীন সংসদ সদস্যদের মূকাভিনয় করে দেখাচ্ছে আর তাতেই যেন পুরো ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ছে। এর মধ্যে শাজাহান ওরফে ছক্কা বলল, জানিস তোরা, আমার বড় চাচা বলেছেন সংসদ অধিবেশনে রাজনীতিবিদরা যখন ফ্লোর নিয়ে কথা বলেন তখন তাদের অডিও বন্ধ করে দেয়া উচিত। মুখে কোনো কথা নেই অথচ তারা হাত-পা ছুড়ছেন, উত্তেজিত হচ্ছেন। দেখার মতো একটা দৃশ্য বটে। কি বলিস তোরা?
ক্লাসের সবাই তাকে ছেঁকে ধরল, তোর বড় চাচা যে এত বড় উজবেকিস্তান তা তো আমরা জানতাম না। যতসব উজবেকিস্তান চাচা। শেষের বাক্যটাতে এসে ক্লাসের সবাই একসঙ্গে কোরাস ধরল। ছক্কার তখন কী অবস্থা!
এই তো তোদের এক দোষ পুরো কথা না শুনে আমার চাচাকে তোরা বকাবাজি শুরু করে দিলি। চাচা বললেন, রাজনীতিবিদরা যেসব কথা দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা সেই একই কথা বলেন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নানান ঢঙে। তাদের কথার ধরন এক, দাবির রকমসকম এক, বুলি এক, চালচালন এক- শুধু অঙ্গভঙ্গি পাল্টে যায়। দেখবি অডিও বন্ধ করে দেখলে তুই মজা পাবি বেশি। একটা নতুন ডাইমেনশন আসবে। চাচার কথায় এখন আমরা বাসায় সংসদ অধিবেশনের আইটেমের অডিও বন্ধ করে দেখি।
ছক্কা কথা শেষ করতে পারে না। সে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে যায়। শুধু পেছন থেকে কে যেন বলে ওঠে, চুপ! বেয়াদবের মতো কথা বলবেন না। সমস্ত ক্লাস হাসিতে হাসিতে সয়লাব হয়ে যায়।
বোধহয় আবদুল লতিফ স্যার আজ আসবেন না। অথচ বাসায় আজ ধ্রুব বলে এসেছে সে একটা প্রাইজ এনে মাকে দেখিয়ে বলবে, দেখো তোমার ছেলে সত্যি সত্যিই একটা কাজের ছেলে। মার ভাষায়- কেজো ছেলে। গত সপ্তাহে ক্লাসে অনেকটা হঠাৎ করেই আবদুল লতিফ সাহেব তার ছাত্রদের মধ্যে একটা কমপিটিশনের আয়োজন করেন। উপস্থিত বুদ্ধির ওপর বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। ১০ মিনিটের মধ্যে কমপিটিশনের বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হলো- ধ্রুব, জুয়েল আর আলীমকে তোমরা অভিনন্দন জানাও। ওরা যেন ভবিষ্যতে আরও বড় বড় পুরস্কার জিততে পারে। হাততালি দাও। আবদুল লতিফ সাহেবের সঙ্গে পুরো ক্লাস হাততিালি দিতে লাগল। ছাত্রদের সামান্য প্রাপ্তিতে লতিফ সাহেব খুব খুশি হন। তিনি ঘোষণা দেন, পরবর্তী ক্লাসে তোমরা তোমাদের প্রাপ্তিযোগের জন্য অপেক্ষা করবে।
আজ সেই ক্লাস। অথচ স্যার আসছেন না। ধ্রুব, জুয়েল আর আলীম একসঙ্গে বসেছে। ওদের মধ্যে ধ্রুবটা সবচেয়ে ধুরন্ধর। সহজ বাংলায় যাকে বলে চালাক। বলতে গেলে ওদের দলে ধ্রুব হলো দলনেতা। ধ্রুব এতই লম্বা সে ক্লাসে উপাধিও পেয়েছে- ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে’। মাথাভর্তি সজারু-চুল। কথা বলে অবাক হওয়ার মতো ভঙ্গি করে। তাই ক্লাসের যে কেউই ধ্রুবর সঙ্গে স্বাভাবিক গলায় কোনো কথা বলে না। বলে একটু অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে। বিস্মিত হওয়ার ভঙ্গিতে চোখটা কপালের কার্নিসে উঠিয়ে। ধ্রুবটা কি এতই বোকা যে এটাও বোঝে না।
ক্লাস শেষ হওয়ার ঠিক সাত মিনিট আগে লতিফ স্যার শেষ ট্রেন ফেল করা যাত্রীর মতো হন্তদন্ত হয়ে হাতে একটা ব্যাগসমেত এলেন ক্লাসে। আমরা তখন সবাই আখেরি আড্ডায় ব্যস্ত। সবার সে কী বিব্রতকর অবস্থা! তা হলে স্যার এলেন!
স্যার ক্লাসে ঢুকেই বললেন, তোমরা যে যেখানে আছ সেখানে বসে থাকো। আমি খুব পেরেশান। নওয়াবপুর থেকে আনলাম শেখ মুজিবুর রহমান।
লতিফ স্যার ছন্দে ছন্দে কথা বলেন। ব্যাগ থেকে বের করলেন প্যাকেট করা তিনটা বইয়ের মতো প্যাকেট। ধ্রুব ভাবল এই সেরেছে লতিফ স্যার বোধহয় নিয়ে এসেছেন ‘বাণী চিরন্তনী’ মার্কা বই। স্যারদের কাছে এ জাতীয় গ্রন্থ ধর্মগ্রন্থের চেয়েও অধিক মূল্যবান। ধ্রুবর মনটা খারাপ হয়ে যায়। জুয়েল আর আলীম যথারীতি আসন্ন উপহার প্রাপ্তির উত্তেজনায় উজবেকিস্তান হয়ে গেছে। চোখে-মুখে তারা একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশেরও অবতারণা করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ধ্রুবর দিনটাই আজ বরবাদ। মাকে সে বলে এসেছে। একটা কিছু উপহার আনবেই। কিন্তু যদি ‘বাণী চিরন্তনী’ জাতীয় বই ধ্রুব উপহার হিসেবে গদগদ ভঙ্গিতে বাসায় নিয়ে যায় তবে বাড়ির কেউ কিছু বলুক আর না বলুক বড়আপা মর্জিনা বানু ধ্রুবকে ছাড়বে না। এটা নিয়ে সে ধ্রবকে টিপ্পনি কাটবে, বল তো ধ্রুব বাণী চিরন্তনীর ৮৫ পৃষ্ঠার প্রথম বাণীটি কি? পারলি না? বাণীটি খুব সহজ- মানুষ কখনও কখনও পরিস্থিতিতে পড়ে গাধা হয়। এই যেমন তুই এখন হয়েছিস।
না, আর ভাবতে পারে না ধ্রুব। সে ধ্রুত ঘামতে থাকে।
লতিফ স্যার প্যাকেট খুললেন। বাঁচা গেল। বাণী চিরন্তনী নেই। ছবির মতো। নাকি ছবির ফ্রেম। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। স্যার এবার ছবির ফ্রেম ঘুরিয়ে ক্লাসের সবাইকে দেখিয়ে বললেন, উনাকে তোমরা চেনো?
জ্বি স্যার। ক্লাসের সবাই তখন বলল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি- শেষ কথাটা ধ্রুব বেশ পণ্ডিতসুলভ গলায় বলল।
আরেকটা পরিচয় আছে তার, তোমরা কেউ জানো সেই পরিচয়?
উত্তর নেই। তখন স্যার বললেন, শেখ মুজিবুর রহমান একজন বড় কবি ছিলেন। তিনি দুই লাইনের একটা মাত্র কবিতা লিখেছিলেন। তোমরা জানো সেই কবিতা। ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার এই কবিতা পড়ে দেশের মানুষ সেই কবিতার ভাবসম্প্রসারণ করল। দেশ স্বাধীন হলো। আমরা স্বাধীন হলাম।
স্যারের কথায় আমরা কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করি। তারপর তিনি পুরস্কারগুলো ধ্রুব, জুয়েল আর আলীমের হাতে তুলে দিলেন। ফ্রেমের ভেতরে বাঘের মতো অসীম সাহসী শেখ মুজিবুর রহমান হাতের আঙুল উঁচিয়ে বক্তৃতা করছেন। গায়ে কালো কোট। তিনি কী বলছেন অথবা তিনি কি বলতে চান এটা এই ছবির নতুন প্রজন্ম বোঝার চেষ্টা করবে, সেই রকম কথাই স্যার সবাইকে বোঝালেন।
যাক ধ্রুব উপহারটা পেয়ে বেশ খুশি হলো। পছন্দের বই, পছন্দের মানুষ সামনে এলে মন ভালো হয়ে যায়। মন প্রসন্ন হয়। মার কাছে ধ্রুব এতবার এই মানুষটার কথা শুনেছে যে মানুষটার জন্য তার ভেতরে ভেতরে জন্ম নিয়েছে একটা চারা বটগাছ। একদিন হয়তো সেই বটচারা পরিণত হবে বিশাল বটবৃক্ষে। এয়ারকুলারের মনপ্রাণ জুড়ে থাকবে কোমলতা। স্নিগ্ধভাব। মানুষটার জীবনী পড়ে ধ্রুব রীতিমতো মুগ্ধ। এ রকম একজন মানুষ হতে ইচ্ছা করে ধ্রুবর। মনের এই গোপন অভিব্যক্তি গোপনই থেকে যায়। আজকের এই উপহার পেয়ে ধ্রুব এতই খুশি হয়ে উঠল যে সে তার মাকে বলবে, দেখো তোমার ধ্রুব শেখ মুজিবকে উপহার হিসেবে পেয়েছে। ধ্রুবর কথায় মা তখন নিশ্চয়ই খুশি হবেন?
আমার বাবা ঘরে থাকেন কম। একটা বেসরকারি ফার্মে কাজ করেন। বাবার বড়কর্তা বাবার কাজে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। অতিমাত্রায় ধর্মকর্ম বাবার কাজকে বিঘ্নিত করে। যে কারণে বাবার প্রায়ই চাকরি থাকে না। বাবা তখন বেকার মানুষ। ইদানিং বাবা রাজনীতিও করেন। মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত বাবা সব সময় ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটান। মার সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া বাবা কথাবার্তা বলতে নারাজ। বাবা যখন মার সঙ্গে কথা বলেন তখন মনে হয়, বাবা উপায়ান্তুর না দেখে অপরিচিত, দূরের কোনো নাম না জানা মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। ইদানিং মাও বাবার সঙ্গে কথা একরকম বন্ধই করে দিয়েছেন। তবে নিয়মটা অলিখিত।
দেখ ধ্রুব, তোর বাবা টুপি, গাড়ি পরে মৌলবাদীদের হাত-পা বেঁধে রাজনীতিতে নেমেছেন। পোগানের কী বাহার, ‘আমরা সবাই তালেবান/বাংলা হবে আফগান।’ মা বাবাকে তীব্রভাবে পরিহাস করার ভঙ্গিতে বলেন। ধ্রুব মার কথায় কিছু বলে না। মা যে ওদের কাছে ধ্রুব সত্য সেটা ওরা ভাইবোন সবাই বোঝে। মা-ভক্ত পরিবার হিসেবে ওরা সবার কাছে পরিচিত। ধ্রুবদের নানা বসুবাজার লেনের এই দোতলা বাড়িটা তার ছোট মেয়ের নামে লিখে দিয়েছেন। একতলার পুরোটা ভাড়া। সেই ভাড়া দিয়ে ধ্রুবর মা পুরো পরিবার চালিয়ে নেন কোনোরকমে।
বাবা এটা ভালো করেই জানেন তার ছেলেমেয়েরা সব মায়ের অন্ধভক্ত। বাবা হিসেবে কোনো প্রভাব তিনি তার সন্তানদের ওপর বিস্তার করতে পারেননি। কখনও পারবেনও না। তারপরও এ বাড়ির সবাই বাবা হিসেবে তাকে ভীষণ ভয় পান। বাবা যখন ঘরে থাকেন তখন ধ্রুবরা কথাবার্তা কম বলে। টেলিভিশনের ডিশ কানেকশনটাও ভুলে ওপেন করে না। ধ্রুবরা বাবাকে ভয় করে চলে। সাধারণত বাবার ঘরের ত্রিসীমানায় ধ্রুবরা পা মাড়ায় না। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর বাবা ছুঁলে আঠার হাজার ঘা।
বাবা মার কোনো কিছুই পছন্দ করেন না।
মা তবু মার মতোই থাকেন।
আমরা মাকে অন্ধ ভিখারির মতো অনুসরণ করি।
মাও আমাদের ভালোবাসেন। মার মতো করে মা আমাদের বড় করতে চান। বাবা ঠিক চান তার উল্টো। বলাই বাহুল্য বাবা বার বার পরাজিত হন মার কাছে। বাবা কি ঘরের পরাজয়কে মানতে না পেরে অন্ধ-আক্রোশে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন বাইরে? টুপি, দাড়ি, নিয়ে মৌলবাদীর লেবাসে?
ধ্রুবকে বাবা ধ্রুব নামে ডাকেন না। বাবার ধারণায় এটা নাকি হিন্দু নাম। বাবার এ রকম ধ্যান-ধারণায় মার সাফ-জবাব, নামের আবার হিন্দু-মুসলমান কিরে? তোর বাপকে বল, রামকৃষ্ণেরও মুখভর্তি গাড়ি ছিল। রবীন্দ্রনাথেরও। এ রকম দাড়ি রেখে ভণ্ডামি চলবে না। মার কথায় বাবা নিরুত্তর থাকেন। জবাব দেয়ার মতো বোধময় কোনো উত্তর বাবার জানা নেই।
মা’র দেয়া নাম ধ্রুব। বাবা এই নামে ধ্রুবকে ডাবেন না। বাবার কাছে ধ্রুবর নাম হলো মোসলেম। নামটা ধ্রুব যতবার শুনেছে ততবার সে যেন এক অদৃশ্য ব্যথায় শিউরে উঠেছে। বাবার সেসব জানার কথা নয়। বাবা কখনও সেসব জানবেও না।
এই বাড়িতে সবার ঘরেই দিনে অন্তত একবার বাবা খোঁজখবর নেন। বাবাকে দেখলে আমরা সবাই ভক্তি শ্রদ্ধায় বাঁশঝাড়ের মতো নুয়ে পড়ি কিন্তু যেই বাবা আমাদের চর্মচক্ষুর সীমানার বাইরে গেলেন অমনি আমরা একেজন শাল, সেগুন, মেহগনি হয়ে সোজা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যাই। বাবা এসব জানেন না।
ধ্রুব বাসায় ফিরে উপহারটা মাকে দেখিয়েছে। মা ভীষণ খুশি হয়েছেন। বলেছেন ছবিটা পড়ার ঘরে সুন্দর করে ঝুলিয়ে রাখতে। পড়ার ঘরের সৌন্দর্য তাতে বাড়বে। যেই কথা সেই কাজ। ছবিটা সারাদিন পড়ার ঘরে সবার মাথার ওপরে ঝুলে থাকল এই ভঙ্গিমায়। ছবিটাতে হঠাৎ করে তাকালে মনে হবে তিনি যেন মানুষকে কিছু একটা বলছেন অথবা কোনো অব্যক্ত কথা বলার জন্য নিজেকে তৈরি করছেন। ছবিটার দিকে তাকালে আপনাআপনি হাঁটাচলার গতি কমে আসে। মনোযোগ দিয়ে শুনতে ইচ্ছে হয় তিনি কী বলছেন বা কী বলবেন তা শোনার জন্যে।
রাতের বেলা।
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু কাজের লোকটা জেগে আছে। তাও আধো ঘুম আধো জাগরণ এই অবস্থার মধ্যে রহিমালি জেগে আছে। সাহেব রাত করে বাড়ি ফেরেন। তার খাবার-দাবারও দিতে হয়। খাওয়া শেষ করে তিনি এককাপ গরম দুধ খান। তারপর রহিমালির ছুটি।
আজও দেরি করে বাড়ি ফিরলেন সাহেব।
খাবার খেলেন। দুধ খেলেন। রহিমালি ছুটিও পেলেন।
তারপর তিনি অভ্যাসবশত বারান্দায় পাঁয়চারি করলেন কিছুক্ষণ। তারপর পড়ার ঘরে ঢুকলেন। পড়ার ঘরে ঢুকেই তিনি যেন অন্ধকারের ভেতর আবিষ্কার করলেন এক ধ্রুব সত্যকে। লাইট জ্বালালেন- ধ্রুব সত্যকে পরখ করার জন্যে। আলো পেয়ে ঝলসে উঠলেন কবি, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ হাতের আঙুল উঁচিয়ে কবি আবৃত্তি করছেন তার কবিতা।
রাগে-ক্ষোভে-আক্রোশে তিনি ফেটে পড়লেন। উন্মাদ হয়ে গেলেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদ থেকে প্রতিদিন আমরা যে মুক্তির কথা বলি, সংগ্রামের কথা বলি সেটা তাহলে কী? ব্যাটা তোর কাছে কী নতুন করে শিখতে হবে মুক্তির কথা? সংগ্রামের কথা? ব্যাটা বেয়াদব কোথাকার? সংসদে থাকলে হয়তো তিনি বলতেন, চুপ! বেয়াদবের মতো কথা বলবেন না।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে বাবা আর স্থির থাকতে পারলেন না। রান্নাঘরে গেলেন। ছুরি নিয়ে আসলেন। অন্ধকার রাতে তাকে ঠিক মানুষ বলে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। মধ্যযুগের কোনো প্রেতাত্মা যেন তার ভেতর উপস্থিত হয়েছে। তিনি ছবিটাকে একটানে নামিয়ে আনলেন। ছবিটাকে দু’হাতে গায়ের জোরে প্রচণ্ড আক্রোশে ছুড়ে ফেললেন মেঝেতে। কাঁচ ভেঙে গেল। ছবির ভেতরের মানুষটা তখনও তেমনি হাতের আঙুল উঁচিয়ে কী যেন বলতে চাচ্ছেন অথবা বলছেন। সেদিকে অন্ধ-আক্রোশে তুমুল মেতে ওঠা লোকটার কোনো খেয়ালই নেই। ছবিটার মুখ বরাবর এবার ছুরি বসিয়ে দিলেন তিনি। প্রথমে একবার। তারপর বার বার। অনেকবার। এবড়োথেবড়োভাবে ছুরি চালিয়ে মাঝরাতে ঘেমে অস্থির লোকটা অদ্ভুত উল্লাসে নৃত্য শুরু করল ছবিটাকে পায়ে দলাইমলাই করতে করতে। নাকে, চোখে, মুখে, গালে, কপালে, গলায়, বুকে, পেটে অজস্রবার ছুরির আঘাত করেও ছবির মানুষটা যেন শেষবারের মতো কিছু একটা বলতে চাইলেন। বলবেন।
লোকটা শুনল না কিংবা শোনার চেষ্টা করল না।
মাঝরাতে এক অদ্ভুত পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠল লোকটা।
খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল ধ্রুবর। রাতে সে একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে। তারপর থেকেই ক্রমাগত সে আরও কয়েকটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে এবং পরিণতিতে খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙার পরপরই তার ইচ্ছে করল ছবিটা দেখার। পড়ার ঘরের দিকে পা বাড়াল ধ্রুব।
পড়ার ঘরে ঢুকেই সবিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল ধ্রুব। দেয়ালে ছবিটা নেই। মেঝেতে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে ভাঙা কাঁচ। ছবিটার মধ্যে অসংখ্য ছুরির চিহ্ন। আর পুরো ঘর ভেসে যাচ্ছে জমাট বাঁধা চাপচাপ রক্তে। ধ্রুব ভাবতে লাগলো গতকাল তো সে শুধু ছবিটাই এনেছে। রক্তমাংসের মানুষ তো আর আনেনি। তাহলে ছবি থেকে রক্ত বেরুচ্ছে কেন? আসলে ফ্রেমে কি বাঁধা ছিল কেবলই ছবি? নাকি জলজ্যান্ত মানুষ?
কে জানে?
(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেওয়া)
এএইচ/