সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে!
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০১:৫০ পিএম, ২১ আগস্ট ২০১৯ বুধবার
গভীরতম শোকের মাস আগস্ট। বাঙালি জাতির বুকে কষ্টের এক নীল পাহাড় হয়ে চেপে আছে এ মাসটি। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে অভিভাবকহীন করা হয়েছিল বাঙালি জাতিকে। শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই শান্ত হয়নি বিপথগামী সেনাসদস্যরা। তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। ঘাতকের বুলেট বাঁচতে দেয়নি শিশু রাসেলকে। বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর সহধর্মিণী আরজু মনিসহ পরিবারের ১৬ সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। বিদেশে থাকায় সেই কালরাতে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট, গ্রেনেড হামলায় গুরুতরভাবে আহত হন দেশরত্ন, জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসের নৃশংসতম সে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন আইভি রহমান সহ ২৪ জন।
১৯৭১ সালের ২১ আগস্টে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ছায়া ঢাকা, কোকিল ডাকা নিভৃতপল্লী শালীহরে নেমে এসেছিলো এক দুর্বিষহ দিন। পাকিস্তানী দোসর আলবদরদের সহায়তায় পাক সেনারা রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে ছিলো গোটা গ্রামটিকে।
৭১’র এই দিনে ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জগামী ট্রেন শালীহর গ্রামে এসে থেমে যায়। পাকবাহিনীর দু’টি প্লাটুন একটি দক্ষিণমুখী আরেকটি উত্তরমুখী যাত্রা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে বের হওয়া হানাদারদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় বিসকা রেলওয়ে স্টেশনের অবাঙালী মাস্টার ছলিম উদ্দিন এবং আলবদর কমান্ডার আব্দুল মান্নান ফকির।
উত্তরে এসেই মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসিমের বাড়ি ঘিরে ফেলে হানাদার বাহিনীর একটি দল। ছেলেকে যুদ্ধে পাঠানোয় আটক করে পিতা প্রসিদ্ধ পাট ব্যবসায়ী ছাবেদ হোসেনকে। জিজ্ঞাসাবাদ করে ধরে নিয়ে যায় তাকে। ছাবেদ হোসেন আর কোনোদিন ফিরে আসেননি। পাকিরা শালীহর গ্রামে প্রথম অগ্নি সংযোগ করে মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসিমের বাড়িতে। পরে, মুক্তিযোদ্ধা আশুতোষ রায়ের বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেয় হানাদাররা। একযোগে পোড়ানো হয় আরো ৪০টি বাড়ি। হানাদাররা সেদিন বাঁচতে দেয়নি জনপদের অন্যতম জনপ্রিয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, আপোশহীন মধু সুদন ধরকে। বিসকা ঠাকুর বাড়ীতে কোমরে দড়ি বেঁধে ৩শ’ মানুষের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন।
ভয়াল সেই দিনে পাকি হানাদারদের ব্রাশফায়ারে প্রাণ দেন মোহিনী কর, জ্ঞানেন্দ্র মোহন কর, যোগেশ চন্দ্র পন্ডিত, নরব আলী, কিরদা সুন্দরী, শচীন্দ্র চন্দ্র দাস, তারিনী মোহন দাস, খৈলাশ চন্দ্র দাস, শত্রুঘœ দাস, রামেন্দ্র চন্দ্র দাস, কর মোহন সরকার, দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস, কামিনী মোহন দাস। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বর্বরতা চলে। পাকিরা সেদিন ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে শালিহর গ্রামটিকে।
আমার বাবা, মো. আবুল হাসিম তাঁর পিতা ছাবেদ হোসেনের খবরটি পান যুদ্ধক্ষেত্রেই। সহযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ তাকে খবরটি প্রথম জানান। বুক ফাটা আর্তনাদ, চোখ ভরা জল নিয়েই দেশ মায়ের জন্য রণাঙ্গনে লড়েছেন তিনি। নয় মাস যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে যখন তিনি এলেন, মা জমিলা খাতুনকে পিঁড়ি মাথায় শুয়ে থাকতে দেখেন পোড়া ভিটায়। শুনেছি, আমার দাদী জমিলা খাতুনের শাড়িসহ সকল প্রসাধনী কোলকাতা থেকে আনা হতো। লজ্জা নিবারনে তাকে পড়তে হয়েছে মার্কিন থান কাপড়। যুদ্ধ ফেরত অভুক্ত ছেলেকে কচুমুখী খেতে দিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীন দেশে শুরু হয় তার নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম। প্রতি মুহূর্তে সইতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানী প্রেতাত্বাদের নির্যাতন। এমন কষ্টের ইতিহাস শুধু আমাদের পরিবারেরই নয়। বরং বাংলাদেশের সকল শহীদ পরিবারের মত শালীহরের স্বজনহারা পরিবারগুলোরও।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারে আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় ২০১০ সালে শালিহর বদ্ধভূমির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয়। জ্ঞানেন্দ্র করকে যেখানে পাক সেনারা হত্যা করেছিল, সেই কদমতলা বদ্ধভূমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের সহায়তায় স্মৃতিস্তম্ভটি ২০১১ সালে উদ্বোধন করা হয়।
স্মৃতিস্তম্ভটিতে শহীদদের নামের কোন ফলক না থাকায়, স্বজন হারানো পরিবারগুলো বেশ উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। কারন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে শালীহর গণহত্যার ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরতে, নাম ফলকের কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি, প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় দিবসগুলোতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহীদ পরিবারের সদস্যদের বিশেষভাবে সম্মান জানানো উচিত। এতে করে, সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের যে পদক্ষেপ, তা আরো দৃপ্ত হবে।
(লেখক: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী)
এসএ/