বাবাকে হত্যা করেও মানুষের হৃদয়ে তারা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:১৩ পিএম, ২৩ আগস্ট ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৫:২২ পিএম, ২৩ আগস্ট ২০১৯ শুক্রবার
বাবাকে হত্যার সময় অ্যাঞ্জেলিনার বয়স ছিল ১৮, মারিয়ার ১৭ আর ক্রিস্টিনার ১৯ ২০১৮ সালের জুলাই মাসে রাশিয়ার মস্কোয় কিশোরী তিন বোন ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তাদের বাবাকে ছুরিকাঘাত এবং আঘাত করে হত্যা করে। এই বোনদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থাকলেও তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে রাশিয়ায় উত্তপ্ত বিতর্ক শুরু হয়েছে।
এর মধ্যেই তিন লাখ মানুষ একটি পিটিশন সই করে তাদের মুক্তি দেয়ার আহবান জানিয়েছে। কেননা তদন্তকারীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, মেয়েদের বাবা বছরের পর বছর ধরে তাদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে পীড়ন করে আসছিলেন। বাবার কি হয়েছিল?
২০১৮ সালের জুলাই মাসের বিকালে ৫৭ বছরের মিখাইল খাচাতুরিয়ান তার তিন মেয়ে, ক্রিস্টিনা, অ্যাঞ্জেলিনা এবং মারিয়াকে একে একে ডেকে পাঠান। তিনজনই সে সময় ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। ফ্ল্যাট পরিষ্কার পরিছন্ন করে না রাখার জন্য তিনি তাদের বকাঝকা করেন এবং মুখে পেপার গ্যাস স্প্রে করেন।
কিছুক্ষণ পরে তিনি ঘুমিয়ে পড়লে মেয়েরা ছুরি, হাতুড়ি আর পেপার স্প্রে নিয়ে তার ওপর হামলা করে। তারা মাথায়, গলায় এবং বুকে মারাত্মক আঘাত করে। পরবর্তীতে তার শরীরে ৩০টির বেশি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। এরপর মেয়েরা পুলিশে খবর দেয় এবং ঘটনাস্থলেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
তদন্ত করতে গিয়ে ওই পরিবারের মধ্যে চরম নির্যাতন ও সহিংসতার ইতিহাস বেরিয়ে আসে। মি: খাচাতুরিয়ান গত তিন বছর ধরে তার মেয়েদের নিয়মিত মারধর করতেন, নির্যাতন করতেন, দাসী করে রেখেছিলেন এবং যৌন নিপীড়নও করতেন। তিন বোনই তাদের বাবার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেছে।
এই মামলাটি দ্রুতই রাশিয়ায় আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি করে যে, এই বোনরা কোন অপরাধী নয়, বরং ভুক্তভোগী। কারণ নির্যাতনকারী পিতার কবল থেকে বাইরে গিয়ে সাহায্য চাওয়ার কোন জায়গা বা সুরক্ষার কোন উপায় তাদের ছিল না। রাশিয়ায় পারিবারিক নির্যাতন থেকে ভুক্তভোগীদের রক্ষায় কোন আইন নেই।
২০১৭ সালে প্রথম আইনে কিছু পরিবর্তন আনা হয়, যার ফলে পরিবারের কোন সদস্য অপর সদস্যকে যদি এমনভাবে মারধর করে যাতে তার আঘাত হাসপাতালে ভর্তি করার মত গুরুতর না হয় তাহলে তাকে শুধুমাত্র জরিমানা করা যাবে অথবা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আটক রাখা যাবে। রাশিয়ার পুলিশ সাধারণত পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে 'পরিবারের ব্যাপার' বলে গণ্য করে থাকে, ফলে আসলে কোন সহায়তাই করে না।
এই বোনদের মাও অতীতে মি: খাচাতুরিয়ানের কাছে মারধর ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, পুলিশের কাছেও গিয়েছিলেন। প্রতিবেশীরাও তার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং তাকে প্রচণ্ড ভয় পেতেন। কিন্তু এসব ঘটনায় পুলিশ কোন ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন নজির নেই। হত্যাকাণ্ডের সময় কিশোরী বোনদের মা তাদের সঙ্গে বসবাস করতেন না এবং মেয়েদের সঙ্গে মায়ের যোগাযোগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন মি: খাচাতুরিয়ান।
মনোবিজ্ঞানীদের পর্যালোচনা অনুযায়ী, মেয়েরা বসবাস করতো নিভৃতে এবং মানসিক কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছিল (পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস)।
মেয়েদের মা অরুলিয়া ডুনডুক বলছেন, মিখাইল ২০১৫ সালে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল তদন্তের সময় কি ঘটেছিল? খাচাতুরিয়ান বোনদের মামলাটি খুবই আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। তারা আটক অবস্থায় নেই, তবে তাদের চলাফেরার ওপর কিছু বিধিনিষেধ আছে। তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, এমনকি নিজেদের মধ্যেও না।
কৌঁসুলিরা দাবি করছেন যে, মি: খাচাতুরিয়ানকে হত্যার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, যেহেতু তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন আর বোনরা সুসংগঠিতভাবে হামলা করেছে, আগেই ছুরি সংগ্রহ করে রেখেছে। তারা বলছেন, বোনদের উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশোধ নেয়া। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে বোনদের বিশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। অভিযোগ আছে যে অ্যাঞ্জেলিনা হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করেছে, মারিয়া ছুরিকাঘাত করেছে আর ক্রিস্টিনা পেপার স্প্রে ছুঁড়েছে।
তবে বোনদের আইনজীবীরা বলছেন, নিজেদের রক্ষা করতেই তারা এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে। রাশিয়ার ফৌজদারি আইনে 'আত্মরক্ষার' বিষয়টি শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক হামলা থেকে নিজেকে বাঁচাতেই নয়, বরং নিয়মিত অপরাধ থেকে বাঁচার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন কেউ জিম্মি হয়ে থাকলে, সে অবস্থায় নির্যাতনের শিকার হলে নিজের আত্মরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারেন।
২০১৯ সালের জুন মাসে অ্যাঞ্জেলিনাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, এই বোনরা ''নিয়মিত অপরাধের'' শিকার এবং এ কারণেই তাদের খালাস দেয়া উচিত। তারা আশা করছেন, মামলাটি বাতিল করা হবে, যেহেতু তদন্তকারীরা দেখতে পেয়েছেন যে, ২০১৪ সাল থেকেই এই বোনরা বাবার হাতে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
মানবাধিকার কর্মী এবং অনেক রাশিয়ান এখন দাবি করছেন যেন এক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন করা হয় এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় আশ্রয় কেন্দ্র, সুরক্ষার ব্যবস্থা এবং পীড়নকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের মতো নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
রাশিয়ায় কত নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তার কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য উপাত্ত নেই। তবে মানবাধিকার কর্মীরা ধারণা করেন, প্রতি চারটি পরিবারের মধ্যে অন্তত একজন নির্যাতন বা পীড়নের শিকার হচ্ছেন। এরকম আরো কয়েকটি ঘটনা আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তার একটি হচ্ছে মার্গারিটা গ্রাচেভার ঘটনাটি, যখন ঈর্ষার কারণে তার স্বামী কুড়াল দিয়ে তার দুই হাত কেটে দিয়েছিল।
কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে, রাশিয়ার কারাগারে যে নারীরা বন্দী রয়েছেন, তাদের অন্তত ৮০ শতাংশ নারী পারিবারিক নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে কাউকে হত্যা করেছেন। তবে খাচাতুরিয়ান বোনদের ক্ষেত্রে আরেকটি চিত্রও আছে, যা রাশিয়ার কঠোর রক্ষণশীল অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে। ''মেন'স স্টেট'' নামে একটি সংস্থা রাশিয়ার প্রধান দুটি মূল্যবোধ হিসাবে তুলে ধরছে ''পুরুষতন্ত্র'' এবং ''জাতীয়তাবাদ''-কে। এবং তারা বলছে সামাজিক মাধ্যমে দেড় লাখ সদস্যের একটি গোষ্ঠি ''মার্ডারস্ বিহাইণ্ড বারস্'' এই ব্যানারে প্রচারণা চালাচ্ছে যেন, এই বোনদের মুক্তি দেয়া না হয়।
পাশাপাশি ''চেঞ্জ ডট অর্গ'' নামের পিটিশনে আহবান জানানো হয়েছে যেন, বোনদের বিরুদ্ধে মামলাটি বাতিল করা হয়। তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে কবিতা লেখা হচ্ছে, র্যালি হচ্ছে এবং নাট্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
ডারিয়া সেরেনকো, মস্কোর একজন নারীবাদী ও অধিকার কর্মী গত জুন মাসে বোনদের সমর্থনে তিন দিন ব্যাপী একটি র্যালির আয়োজন করেছিলেন। তিনি বলছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই ঘটনাটি সংবাদে রাখা এবং সবাই যেন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলে সেটি নিশ্চিত করা।
''পারিবারিক নির্যাতনের বিষয়টি রাশিয়ায় একটি বাস্তব সত্য। আমরা হয়তো সেটা অবহেলা করতে পারি, কিন্তু সেটা আমাদের জীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলছে, এমনকি আপনি ব্যক্তিগতভাবে এরকম নির্যাতনের শিকার না হয়ে থাকলেও।'' তিনি বলছেন।
সূত্র বিবিসি বাংলা,
টিআর/