বঙ্গবন্ধু ও আবুল ফজল
আবুল মোমেন
প্রকাশিত : ০৫:২৮ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৯ সোমবার
পঁচাত্তরের আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ বিবেকবান যে কোনো মানুষকেই ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। আমার বাবা অধ্যাপক আবুল ফজলকে তো বটেই। বঙ্গবন্ধু তাকে শ্রদ্ধা করতেন আন্তরিকভাবে। যোগাযোগের সূত্রপাত পাকিস্তান আমল থেকেই, বিশেষভাবে ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সময় থেকে।
এই হত্যাকাণ্ডে বাবার মনঃকষ্টের আরো একটি কারণ ছিল বলে মনে হয়। পঁচাত্তরের শেষ নাগাদ বিচারপতি সায়েমের অনুরোধে, তার কয়েকজন মান্যগণ্য প্রবীণ উপদেষ্টার পীড়াপীড়িতে তিনি সরকারে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে। বিচারপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়ার কাছ থেকে কথা নিয়ে দুটি শর্তে তিনি তাদের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।
শর্ত দুটি ছিল- সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেল হত্যার বিচার এবং বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা। তাছাড়া সায়েম ও জিয়া উভয়েরই প্রতিশ্রুতি তো ছিল দ্রুত গণতন্ত্রে ফিরে আসার।
মনে মনে তার আরেকটা প্রত্যয় হয়তো ছিল যে, তিনি সরকারে থাকলে সম্ভাব্য নির্যাতন-অন্যায় থেকে অনেককে বাঁচাতে পারবেন। সে কাজটা তিনি অনেকের ক্ষেত্রেই করেছেন। তবুও আজীবনের গণতন্ত্রের পূজারী আর সমাজতন্ত্রে আস্থাশীল মানুষটি কেবল দু’জন ভিন্ন ধাতের টেকনোক্র্যাট মানুষের প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করে থাকতে পারেন না।
অস্বস্তি নিয়েই তিনি কাজ করছিলেন। আর যখন জেলহত্যা তদন্তে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটিকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে দেখলেন এবং জেনারেল জিয়া ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার দূরভিসন্ধি নিয়ে এগুচ্ছেন বলে সন্দেহ হচ্ছিল, তখন তিনি তার অবস্থান আবিষ্কার করার দিকে মনোযোগ দেন। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার গুঞ্জন শুনে উপদেষ্টা বিনীতা রায়কে নিয়ে তাদের আপত্তির কথা জানান।
এসময় উপদেষ্টা পদে থেকেই তিনি পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে ছোটগল্প লেখেন- ‘মৃতের আত্মহত্যা’। গল্পটি দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকা সমকালে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পাঠকদের নজর কাড়ে। বেশ হৈ চৈ পড়ে যায়, কপি করে বিলি হয়ে হাতে হাতে ফিরতে থাকে।
গল্পটি তৎকালীন সরকারের নেপথ্য নায়ক জেনারেল জিয়ার প্রতি একজন উপদেষ্টার প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জও বটে। জিয়া তখন ধূর্ততার সঙ্গে খেলছিলেন, ফলে বিচারপতি সায়েম ও বয়োজ্যেষ্ঠ উপদেষ্টাদের আড়াল তার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বাবা যখন স্পষ্ট বুঝে গেলেন জিয়া কোনো প্রতিশ্রুতিই রাখবেন না, তখন সংঘাতের পথটা আরো অনিবার্য করে তুললেন পর পর একই বিষয়ে আরো দুটি গল্প প্রকাশ করে। তার আগে থেকেই বাবা সবসময় পকেটে পদত্যাগপত্র রাখতেন এবং সায়েম ও জিয়াকে জানিয়েও রাখলেন তিনি আর সরকারে থাকতে চান না।
সাতাত্তরের জুনে, প্রায় কুড়ি মাস দায়িত্ব পালনের পর, উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ফিরে এলেন চট্টগ্রামে। তাকে তো অনেক চাপাচাপি করে উপদেষ্টা পদে যোগ দিতে রাজি করানো হয়েছিল। তাকে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে তিনি এ পদে যোগ দেবেন ও স্বল্পসময় দায়িত্ব পালনের পর ফিরে যাবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। উনি অবশ্য পুনরায় উপাচার্য পদে ফেরার কথা ভাবেননি, ভেবেছিলেন নজরুল অধ্যাপক বা এরকম কোনো পদে যোগ দেওয়ার সুযোগ হবে। তবে জিয়া এবং তার শূন্যস্থান পূরণে অশালীনভাবে ব্যতিব্যস্ত সৈয়দ আলী আহসানের মনে ছিল অন্য চিন্তা। বাবার আর কোনো দায়িত্বে ফেরা হয়নি।
ষাটের দশক থেকে বাবা তার ছাত্রজীবনের অর্জিত মুক্তবুদ্ধির চেতনাকে শাণিত করে নানা বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। কথাসাহিত্যিক থেকে মননশীল প্রাবন্ধিক আবুল ফজলের উত্তরণ ঘটে এ সময়। তখন আইয়ুবের সামরিক ও ছদ্ম সামরিক শাসনের বর্ম ভেদ করে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটছিল। এতে সমকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইস্যুতে আবুল ফজলের লেখনীর ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম তীব্র রূপ নিচ্ছিল মূলত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে।
৬-দফা, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা প্রাবন্ধিক আবুল ফজলের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন তাদের চিন্তাবিদকে। বঙ্গবন্ধু এ সময়েই তার লেখার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং দুটি লেখা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পুনঃমুদ্রণের জন্য দু’দফা চিঠিও লেখেন। ছোট্ট এ দুটি চিঠিতে বাবার প্রতি শেখ মুজিবের শ্রদ্ধাপূর্ণ সৌহার্দ্যের প্রকাশ ঘটেছে। দুটি চিঠিই তিনি লিখেছেন তার ব্যক্তিগত প্যাডে।
চিঠি-১
শেখ মুজিবুর রহমান
ফোন: ২৪২৫৬১
৬৭৭ ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা
রোড নং ৩২, ঢাকা
তারিখ: ১৭-১১-৬৯ ইং
জনাব অধ্যাপক সাহেব,
আমার ছালাম গ্রহণ করবেন। আশা করি ছহিছালামতে আছেন। সম্প্রতি ইত্তেফাকে প্রকাশিত আপনার প্রবন্ধ ‘শক্ত কেন্দ্র কেন ও কার জন্য’ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। আপনার সাবলীল লেখনি নিঃসৃত সৃজনশীল এই প্রবন্ধটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করে অধিকসংখ্যক মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে পারলে নির্যাতিত মানুষের পরম কল্যাণ সাধিত হবে বলে আমার স্থির বিশ্বাস। প্রবন্ধটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করতে মনস্থ করেছি। আপনার অনুমতি পেলে কৃতার্থ হবো।
আপনার স্নেহের
মুজিব
চিঠি-২
শেখ মুজিবুর রহমান
ফোন: ২৪২৫৬১
৬৭৭ ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা
রোড নং ৩২, ঢাকা
তারিখ: ২-১২-৬৯ ইং
জনাব অধ্যাপক সাহেব,
আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করিবেন। আপনার চিঠি পেয়ে আমি সত্যই আনন্দিত হয়েছি। আপনার মতো জ্ঞানী, গুণী এবং দেশপ্রেমিকের সাথে দেখা করতে পারলে খুবই আনন্দিত হতাম। আবার যখন চট্টগ্রাম যাব ‘সাহিত্য নিকেতনে’ যেয়ে নিশ্চয় আপনার সাথে দেখা করব। আপনার লেখা ‘রাজধানী’ বের হলেই শক্ত কেন্দ্রের সাথে এক করে পুস্তিকাকারে বের করার চেষ্টা করব।
পূর্ব বাংলার অবস্থা আপনি ভালোভাবেই জানেন। আমি আমার কর্তব্য করতে চেষ্টা করছি। এদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছে, তাদের রক্তের সাথে যেন বেঈমানি না করি। দোয়া করবেন। আপনার স্নেহ ও ভালোবাসা আমার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকুক।
(‘কেন্দ্রীয় রাজধানী বনাম পূর্ব পাকিস্তান’ নামে বাবার আরেকটি প্রবন্ধ তখন ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘রাজধানী’ বলতে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত সেটির কথাই বলেছেন।)
ইতি
আপনার স্নেহের মুজিব
শেখ সাহেব এবং বাবারও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সেই উত্তাপ সময়ে চট্টগ্রামে একে অপরের আস্তানায় ঢুঁ মেরেও ঘটনাচক্রে তারা দেখা করতে পারেননি। অল্পের জন্যে অপরজনের সাক্ষাৎ লাভে তাদের উভয়ের চেষ্টা বিফলে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর একান্ত আগ্রহে তার গণভবনের দপ্তরে তাদের সাক্ষাৎ পরিচয় ও আলাপের সূচনা হয়েছিল। তারিখ ২০ মার্চ ১৯৭২।
প্রথম দেখা ও আলাপের টুকরো স্মৃতির সূত্রে বাবার কলমে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও ফুটে উঠেছে :
‘আমি বারান্দার মাঝপথে থাকতেই তিনি তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে বসালেন। তিনি নিজেও বসলেন পাশে। হুকুম করলেন চায়ের। মুহূর্তে এক অসাধারণ উষ্ণ হৃদয়ের যেন পরশ পেলাম। (শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি, পৃ. ২৩)।
বঙ্গবন্ধু বাবাকে প্রস্তাব দিলেন গণভবনে এসে থাকতে ও বসে বসে লিখতে। শুনে বাবা হাসলেন বটে কিন্তু ভেতরে ভেতরে ‘মুগ্ধ হলাম তাঁর আন্তরিকতায়-গুণগ্রাহিতায়’। (ঐ প্রথম সাক্ষাতের মূল্যায়নে কোনো পূর্বধারণার ছাপ থাকে না, স্বতঃস্ফূর্ত ও সতেজ মনের অনুভূতিই তাতে মেলে। বাবা লিখছেন :
ফিরে এলাম এক অসাধারণ মানবিক উষ্ণতার স্পর্শ নিয়ে, এ উষ্ণতা অত্যন্ত আন্তরিক ও অকৃত্রিম এবং স্বতঃস্ফূর্ত।
তারপর শেখ মুজিবকে ‘দেশের এ যুগের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব’ আখ্যায়িত করে তিনি লিখছেন :
‘শালপ্রাংশু দেহ শেখ মুজিবের মুখের দিকে চেয়ে থাকা যায় অনেকক্ষণ ধরে। ঐ মুখে কোনো রুক্ষতা কি কর্কশতার চিহ্ন ছিল না। তার হাসি ছিল অপূর্ব, অননুকরণীয়। এমন হাসি অন্য কারো মুখে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’ (ঐ: পৃ. ২৫)।
আর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর তার কাছে এসেছে বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো। অবর্ণনীয় সেই ক্ষতি তাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে। ‘বাংলাদেশের স্রষ্টা স্বয়ং শেখ মুজিব, এমন ‘অকল্পনীয়’ হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারেন তা ছিল তার কাছে অবিশ্বাস্য। লিখেছেন-
‘শেখ মুজিব না থাকাটা যে বাংলাদেশের জন্য কত বড়ো শূন্যতা তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না, তিনি ছিলেন সারাদেশের সামনে ঐক্যের প্রতীক ও ঐক্য রক্ষাকারী মহাশক্তি। সে প্রতীক, সে শক্তি আঁততায়ীর গুলিতে আজ ধুলায় লুণ্ঠিত। এ নির্মম ঘটনায় যন্ত্রণাবিদ্ধ আমরা সবাই। যে যন্ত্রণা ভাষার অতীত’। (ঐ:পৃ.৯)
একটু পরে আফসোসের সাথে লেখেন, ‘আমাদের সামনে আজ এমন কোনো মহৎ কবি নেই, যে কবি বাংলাদেশের অন্তরের এ নীরব কান্নাকে ভাষায় কিংবা ছন্দে রূপ দিতে পারেন’।
বঙ্গবন্ধু তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেককেই নেতা মেনেছেন, কেউ কেউ ছিলেন তার রাজনৈতিক গুরু। তবে মধ্য ষাট থেকে, বিশেষত ৬-দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব বাংলা যখন বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারে জেগে উঠেছিল, তখন জায়মান অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের চিন্তানায়কদের সাথে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ ঘটেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীসহ অনেকের সাথে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যোগাযোগ বাংলাদেশের গঠন পর্বের রাজনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। এ সময় প্রবীণ আবুল ফজল মুক্তবুদ্ধির সাহসী চিন্তাবিদ হিসেবে এ বাংলায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় মনীষীর স্থান পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক চেতনার একজন চিন্তাবিদ লেখক হিসেবে আবুল ফজলকে গভীর শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন, যা তার ব্যক্তিগত চিঠিদ্বয়ে প্রকাশ পেয়েছে। বাবাকে প্রায় সত্তর বছর বয়সে উপাচার্য হিসেবে অস্থির ও প্রায় অচল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং উপাচার্যের প্রতি আচার্যের ভূমিকা ও আচরণে বরাবর শ্রদ্ধাপূর্ণ ঔদার্য দেখিয়ে প্রকাশ করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারবর্গের নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাবা কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না, ‘মনের ওপর পাপের এক গুরুভার’ নামাতে পারছিলেন না। নির্মম হত্যাযজ্ঞের সপ্তাহখানেক পরে ২৩ আগস্ট ১৯৭৫-এ ডায়েরিতে তিনি লেখেন :
‘এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। তবুও পারছি না বিবেককে এতটুকু হালকা করে তুলতে। এক দুর্বহ বোঝার ভারে বিবেক আমার স্তব্ধ ও বোবা হয়ে আছে এ ক’দিন। এ এক অকল্পনীয় পাপের বোঝা- আমার, আপনার, সারা বাংলাদেশের।’
তিনদিন পরে ২৬ আগস্ট ১৯৭৫-এ লিখেছেন:
‘বাংলাদেশের মানুষকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার হিম্মত কে জুগিয়েছে? শেখ মুজিব ছাড়া এর কি দ্বিতীয় কোনো জবাব আছে? শেখ মুজিবকে হত্যা করা মানে, এক অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হত্যা করা। তিনি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার, আমাদের হিম্মত আর সংগ্রামের প্রতীক’।
ঐদিনই আরো লিখেছেন:
নিঃসন্দেহে শেখ ছিলেন এ যুগের সর্বপ্রধান বাঙালি। সে সর্বপ্রধান বাঙালিকে আমরা বাঙালিরাই কিনা নিজের হাতে হত্যা করলাম। আশ্চর্য, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও সত্য হলো।
‘বাঙালিকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে কে জুগিয়েছিল সাহস? শেখ মুজিব নয় কি? বজ্রগর্ভ আর অমিত প্রেরণার উৎস ‘জয়বাংলা’ স্লোগান কে তুলে দিয়েছিল বাঙালির মুখে? শেখ মুজিব নয় কি?
সবশেষে মনের ভাব ও বিবেকের তাড়া কিছুটা হলেও লাঘব করার জন্যেই যেন লিখলেন, ‘বিবেকের সঙ্কট’ নামে প্রবন্ধ। কিন্তু ৪ অক্টোবরের ডায়েরির লেখা থেকে জানতে পারি যে লেখাটি পাঠানোর পর তিন সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও ‘ইত্তেফাক লেখাটি আজও ছাপেনি’।
এরকম দুর্বহ বিবেকের সঙ্কটে পীড়িত হতে হতেই ইতিহাসের ঘূর্ণিচক্র তাকে টেনে নিয়ে গেল বাংলাদেশের বিতর্কিত এক সরকারের ভেতরে। উদার মানবিক আদর্শবাদ, ব্যক্তিগত সততা ও আত্মমর্যাদার মূল্যবোধের বিশ্বাসী সাদাসিধে সত্তরোর্ধ্ব মানুষটি শিক্ষা ও জীবনাদর্শে মোটামুটি তার চেনা বলয়ের উপদেষ্টা ও প্রেসিডেন্টের চাপ শেষ পর্যন্ত অগ্রাহ্য করতে পারেননি।
তখন বাংলাদেশের ইতিহাসের চতুর ধূর্ত খলনায়ক জেনারেল জিয়ার অভিসন্ধি তার কাছে পরিষ্কার হয়নি। তবে দিনে দিনে তার বিবেকের সঙ্কট বেড়েছে এবং সে ভার লাঘবের দায় কেবলই জোরদার হয়েছে। লেখকের যে ইতিহাসের প্রতি, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি দায় আছে সেটা তিনি কখনো ভোলেননি। ‘মৃতের আত্মহত্যা’ গ্রন্থের ভূমিকায় (কৈফিয়ত) তিনি এ ঘটনাকে ‘শতাব্দীর করুণতম, নিষ্ঠুরতম বিয়োগান্ত এক নাটক’ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন:
‘আমি তেমন বড়ো লেখক নই। তবে ছোট লেখকও দায়িত্বমুক্ত নয়। এ বই আমার তেমন এক ছোট দায়িত্ব পালন’।
তার এ গল্পগুলো সম্পর্কে তিনি আগেই একটু সতর্ক ও রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়েছেন। তাই পাঠকদের উদ্দেশে তার নিবেদন:
‘এ গল্পগুলোকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ কিংবা প্রতিহিংসা-প্রতিশোধের মনোভাব থেকে এর উৎপত্তি নয়’।
‘মৃতের আত্মহত্যা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নভেম্বর ১৯৭৮, সমকাল প্রকাশনী থেকে। প্রকাশকের কথায় সামসুর রহমান সেলিমে জানাচ্ছেন:
‘মৃতের আত্মহত্যা’ সমকালে প্রকাশিত হওয়ার পর সারা বাংলাদেশে এক বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। শুধু তা-ই নয়, দেশ-বিদেশেও গল্পটির জন্য বিশেষ ঔৎসুক পরিলক্ষিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয় বলেও জানা গেছে। তারপর পনের আগস্টের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবুল ফজল সাহেব আরো তিনটি ছোট গল্প লেখেন। প্রথম তিনটি গল্প ‘মৃতের আত্মহত্যা’ ও ‘নিহত ঘুম’, ‘ইতিহাসের কণ্ঠস্বর’ সমকালে প্রকাশিত হয়েছে। শেষ গল্প ‘কান্না’ বর্তমান গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে’।
মুজিব হত্যার পরপরই আবুল ফজল বিবেকের বোঝা ও পীড়া অনুভব করতে থাকেন, আর উপদেষ্টার দায়িত্বভার নিয়ে সে বোঝা ও সঙ্কট কেবল গভীরতর হয়েছে। সেই বোঝা কিছুটা হলেও এবং নিজের মনের ভার হালকা করতে গিয়ে বাবা যেন একের পর এক এই গল্পগুলো লিখে গেছেন।
গল্প শিল্পোত্তীর্ণ হলো কিনা এ নিয়ে তিনি তেমন ভাবিত ছিলেন না, শিল্প সৃষ্টির চেয়ে ইতিহাসের দায় পালনই তার কাছে ছিল মুখ্য। এ মর্মন্তুদ ঘটনার সুস্পষ্ট কার্যকর প্রতিবাদের দায় তিনি কিছুতেই ভুলতে পারেননি। ৪ অক্টোবর ১৯৭৫ তারিখে ডায়েরিতে লিখেছেন:
‘শেখ সাহেবের হত্যা সম্পর্কে আমি অনবরত বিবেকের একটা দংশন অনুভব করছি। এত বড় একটা দ্বিতীয় কারবালা ঘটে গেল দেশে, নির্মমতায় যে ঘটনার জুড়ি নেই ইতিহাসে। সে সম্পর্কে দেশের সর্বাপেক্ষা সচেতন অংশ শিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছুমাত্র বিচলিতবোধ করছে না, এ ভাবা যায় না। আশ্চর্য, মননশীল লেখক-শিল্পীদের মধ্যেও তেমন একটা সাড়া দেখা যায়নি এ নিয়ে। আগের মতো এখনো আমাদের তরুণ কবিরা একটানা অতি নিরস ও নিষ্প্রাণ প্রেমের বা ‘আমি-তুমি’ মার্কা কবিতা লিখে চলেছেন’।
বোঝা যায়,পঁচাত্তরের আগস্টের পর থেকেই তিনি এ নিয়ে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছিলেন। দু’সপ্তাহের মধ্যেই লেখেন ‘বিবেকের সঙ্কট’ প্রবন্ধ। আর উপদেষ্টা পদে যোগ দিয়ে বোঝেন যে তার দায়মুক্তি ওই লেখাতে ঘটেনি। সে দায় আরো ভালোভাবে তার ওপর চেপেছে। ফলে ৭৭-৭৮ দু’বছরে চারটি গল্প লিখলেন তিনি তার ভাষায় ‘দ্বিতীয় কারবালা’র ঘটনাবলি নিয়ে।
’৭৭-এ প্রথম গল্প ‘মৃতের আত্মহত্যা’ যখন প্রকাশিত হচ্ছে ততদিনে সংবিধান স্থগিত, ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর কোপ বেড়েছে, রাজনীতিহীনতার মধ্যেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের উদ্যোগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ সময় সায়েম ও তার উপদেষ্টামণ্ডলীর আড়ালে জিয়া ও তার পার্শ্বচরদের ক্ষমতা ও প্রভাব বাড়ছিল। লেখক ও বিবেকী মানুষ আবুল ফজল আর চুপ থাকতে পারেননি, নীরবে মেনে নিতেও পারেননি। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েই তিনি প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে গল্পগুলো লিখতে ও প্রকাশ করতে শুরু করেন। কোনো রকম রূপক বা প্রতীকের আশ্রয় নেননি প্রতিবাদী এ লেখক।
চারটি গল্পের মধ্যে প্রথম দুটিতে- মৃতের আত্মহত্যা ও নিহত ঘুম-ঘটনাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মানসিক যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন। আর পরের দুটিতে-ইতিহাসের কণ্ঠস্বর ও কান্না- পাই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আপন মানুষদের মনঃকষ্টের কাহিনী।
মৃতের আত্মহত্যার মূল চরিত্র সোহেলি, এক খুনি মেজরের স্ত্রী, দূর মরুভূমিতে যে কেবল দেশ ও পরিজনদের ছেড়ে থাকার নির্বাসন দণ্ড ভোগ করছে না, তার আপনজনের কৃতকর্মের জন্য সে যে আজ ‘খুনীর বৌ, বকুল খুনির সন্তান’- এ পরিণতি মানতে পারে না। বকুল তাদের সন্তান। সোহেলির জীবন থেকে আনন্দ-উৎসাহ উধাও হয়ে যায়। স্বামীর অন্যায় খুনের জের টানে সে জীবনের প্রতি সকল আগ্রহ হারিয়ে। শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় নিরাপরাধ এক বিবেকী নারী।
‘নিহত ঘুম’ গল্পটি এক অজ্ঞাতনামা সৈনিকের ডায়েরির অংশ হিসেবে তারই বচনে বিবৃত হয়েছে। এ সৈনিক ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল আর তারপর থেকে সে ঘটনা দুঃসহ স্মৃতি হয়ে তাকে তাড়াতে থাকে। একদিনের জন্যও সে আর ঘুমোতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তারও মৃত্যু ঘটে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে।
তৃতীয় গল্পটির নাম ‘ইতিহাসের কণ্ঠস্বর’। এখানে পাই বঙ্গবন্ধুর ছোট চাচা শেখ আহমদ আলীর জবানিতে ‘দ্বিতীয় কারবালার’ ফলে তাদের জীবনও কীভাবে সেই একই ঘটনার দ্বারা তাড়িত হচ্ছে সে বিবরণী। তিনি চাইলেন বঙ্গবন্ধুর ঘরটি আবার সজীব করে তুলতে, বেঁচে যাওয়া নাতনিদের ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু এ ঘটনার অভিঘাত এতই প্রবল যে, কারো পক্ষেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। অদৃশ্য আওয়াজ তাদের অস্থির করে তোলে- তফাত যাও, সব ঝুট হ্যায়।
শেষ গল্প ‘কান্না’য় তিনি সেদিনের হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর শিকার শিশু রাসেলের এক সহপাঠী বন্ধুর জীবনেও এ ঘটনা কী ভয়ানক ছাপ ফেলে গেছে তা জানিয়েছেন। অধ্যাপক শহীদ ও আলফা বেগমের ছোট ছেলে শাহীন শেখ রাসেলের সাথে (গল্পে রুশো) একই স্কুলে একই সঙ্গে পড়ে। দু’জনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে মূলত রুশোরই টানে। এ গল্পে শিশু রাসেলের সারল্য ও জীবনের সৌন্দর্য, বেগম মুজিবের স্নেহমাখা মাতৃত্ব এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অনাড়ম্বর সাদাসিধে রূপ ফুটে ওঠে।
আবুল ফজল পঁচাত্তরের ঘাতকদের দায়মুক্তির বিধান নিয়ে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং যে দুই শর্তে তিনি উপদেষ্টা পদে যোগ দিয়েছিলেন, তাতে হত্যার তদন্ত ও বিচারের বিষয়টি ছিল প্রধান। বিচারের বিষয়ে সরকারের উদাসীনতা দেখে এবং প্রথম পর্যায়ে ইতিহাসের এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডে লেখক-শিল্পীদের তেমন প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে তিনি ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছিলেন। তিনি প্রতিবাদের যে আয়ুধ হাতে তুলে নেন, তাতে তা-ই যেন জোর পড়েছে প্রকৃতির বিচারের দিকে। মানুষ তার বিচার ব্যবস্থাকে অচল করে রাখলেও প্রকৃতির বিচার বন্ধ করা যায় না।
তবে এ প্রত্যাশার মধ্যে যেমন সততা ছিল তেমনি ছিল সারল্য। ইতিহাস আদতে তখন সরল ও সৎ পথ ছেড়ে ষড়যন্ত্র ও মিথ্যার কুটিল কুহকে ঢুকে পড়েছে। বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি ধীরে ধীরে মাথা তুলেছে বটে; কিন্তু সেই কুটিল কুহকের পথ থেকে যেন সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসতে পারেনি। সংবেদনশীল বিবেকী লেখক আবুল ফজল যেমনটা আশা করেছেন যে খুনি ও তাদের স্বজনদের আত্মোপলব্ধি ঘটবে, তারা আক্ষেপে ও অনুতাপে জ্বলবে- অন্য কথায় মনোযন্ত্রণার ভেতর দিয়ে সত্যের পথে আসবে তেমনটা বাস্তবে ঘটেছে বলে মনে হয় না।
শেষ দুটি গল্পের মধ্যে এ ঘটনায় সৎ সরল মানুষের কষ্টের কথা আছে, তারা এর থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাবেন, সরাসরি তার ইশারা নেই। তবে স্বজনদের এমন কষ্টভোগের পরিণতি নিশ্চয়ই আবার মানুষের শুভবুদ্ধির জাগরণ ঘটাবে এবং দ্বিতীয় কারবালার ঘটনার বিচার- আদালতের ও প্রকৃতির উভয় বিচার নিশ্চিত করবে, এমনটাই তিনি বিশ্বাস করেছেন।
এখন ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মূল্যায়ন করলে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও রূপকার নন, তিনিই এ জাতির মহানায়ক। হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক ধকল কাটিয়ে সৃজনশীল মানুষ তাকেই উপজীব্য করে কবিতা, গান, প্রবন্ধ লিখতে শুরু করে। তার বহুমাত্রিক ভূমিকা, অবদান ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজনীতিতে, জাতীয় জীবনে ও ইতিহাসে তার অবস্থান সবার আগে, সবার ওপরে।
একজন ‘ছোট লেখকের’ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের প্রয়াস জাতির পক্ষ থেকে ঋণ স্বীকারের এবং প্রতিবাদ ও বিচারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল।আজীবন মুক্তবুদ্ধির সাধক আবুল ফজল এ গল্পগুলোর মাধ্যমে নিজেকে দায়মুক্ত করলেন আর আপন বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকলেন।
(লেখাটি বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম গ্রন্থ থেকে নেওয়া)
এএইচ/