বহু রূপে ইমরান খান
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:৩৩ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৯ সোমবার
ক্রিকেট সুপারস্টার থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা ইমরান খান, তার ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বছরটি বেশ আলোড়নময়। তিনি এখন এমন একটি অবস্থানে পৌঁছেছেন যে অনেকেই ভেবেছিলেন যে তিনি সেটা কখনই অর্জন করতে পারবেন না।
রাজনীতির মাঠে দুই দশকের দীর্ঘ সংগ্রামের পর ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয় পান তিনি। ওই দুই দশকের বেশিরভাগ সময় তাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মুখে পড়তে হয়েছে।
পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, যারা কিনা স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময় পাকিস্তানকে শাসন করেছে, তারা ইমরান খানের দল পিটিআই পার্টির স্বার্থে পর্দার আড়ালে হস্তক্ষেপ করছে- এমন অভিযোগ উপেক্ষা করে ইমরান খান নিজ অবস্থানে অবিচল ছিলেন।
এই উপলব্ধি এবং পাকিস্তানের সামনে অগণিত চ্যালেঞ্জ থেকেই বোঝা যায় ইমরান খানের ক্ষমতায় থাকা প্রথম বছরটি এতোটাও সহজ ছিলনা।
সমালোচকরা অভিযোগ করেন যে তিনি বিশ্বের কাছে যে চেহারা উপস্থাপন করেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তার রূপ একেবারেই আলাদা।
তবে তিনি কী করেছেন?
নির্বাচনী প্রচারণায় দুর্নীতি বিরোধী বক্তব্য সেইসঙ্গে "নতুন পাকিস্তান" প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পাশাপাশি মি. খান তার সমর্থকদের প্রায় ওবামার আদলে "তাবদিলি" (পরিবর্তন) করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের ভারসাম্যহীন অর্থনীতিকে রক্ষা করা।
প্রথম আট মাসের মধ্যে, তিনি দীর্ঘ দিনের মিত্র সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার এবং চীন সফর করেন। অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে ৯শ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা আনার ব্যবস্থা করেন।
কিন্তু এতেও সঙ্কট কাটেনি। প্রবৃদ্ধির গতি কমতেই থাকে। রুপির দাম কমে যায় এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০% ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩ সালের পর প্রথমবারের মতো এই প্রবৃদ্ধির হার দুই অংকে এসে পৌঁছায়।
অর্থনৈতিক সঙ্কট ক্রমশ বাড়তে থাকায় ইমরান খানের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থেকে ইউ-টার্ন নেয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থ সহায়তা চাইবেন না বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি সরে আসতে বাধ্য হন।
জুলাইয়ে, আইএমএফের সাথে ৬০০ কোটি ডলার প্যাকেজের একটি চুক্তি হয়। দেশটিতে ১৯৮০-এর দশক থেকে এ পর্যন্ত এটি আইএমএফের ১৩তম অর্থ সহায়তার প্যাকেজ।
ইউএস-ভিত্তিক অ্যালব্রাইট স্টোনব্রিজ গ্রুপের দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞ উজায়ের ইউনুস বলেছেন, পিটিআই সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এর নীতিগত পরিকল্পনার অভাব।
"তারা কর রাজস্বের খুব উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তবে যে মুহূর্তে তারা এই লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হবে, তখন তাদের পুরো তাসের ঘর ধসে পড়বে," তিনি বলেন।
তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন যে সরকার "আমাদের কাজ করছে"।
তিনি বলেন, " অর্থনীতির বিভিন্ন জায়গায় আমাদের একটি নিবেদিত প্রাণ দল কাজ করছে এবং আমরা মনে করি যে আগামী নির্বাচনগুলো দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে হবে," তিনি বলেন।
তিনি স্বীকার করেছেন যে এই অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যেও সরকার, পিটিআই এর মূল মধ্যবিত্ত ভোটার শ্রেণীকে কিছুটা স্বস্তি দিতে সক্ষম হয়েছে।
বিবিসির একটি উর্দু বিশ্লেষণ অনুসারে, খান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের করা ৩৪টি প্রতিশ্রুতির মধ্যে কেবল তিনটি অর্জন করতে পেরেছে। মি. চৌধুরী একটি নতুন অর্জন হিসাবে নতুন ই-ভিসা ব্যবস্থা প্রণয়নের কথা উল্লেখ করেন।
প্রধান কূটনীতিক
নির্বাচনে জয়ের পরে প্রথম টেলিভিশন ভাষণে প্রধানমন্ত্রী খান তার দেশের ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন: "ভারত যদি আমাদের দিকে এক ধাপ এগিয়ে আসে; আমরা তাদের দিকে দুই ধাপ এগুবো।"
নিজের বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য, তিনি দ্রুত করতারপুর করিডোর উন্নয়নের নির্দেশ দেন, যা পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে সহযোগিতার এক বিরল উদাহরণ স্থাপন করে।
এর মাধ্যমে ভারত থেকে আসা শিখ তীর্থযাত্রীরা পাকিস্তানে তাদের পবিত্র স্থানটিতে যাওয়ার অনুমতি পাবে।
তবে বন্ধুত্বসুলভ এই কথা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
ফেব্রুয়ারিতে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারত বিমান হামলা শুরু করলে দুই প্রতিবেশী দেশ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে পড়ে। ভারতের দাবি ছিল যে কাশ্মীরে হামলা চালানো জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ শিবির গুঁড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তারা ওই হামলা চালিয়েছিল।
এরপরে পাকিস্তান পাল্টা হামলা চালায়। একটি ভারতীয় বিমানকে ভূপাতিত করে এবং বিমানের পাইলটকে আটক করে। সে সময় উত্তেজনা আরও ঘনীভূত হতে থাকে।
কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার পরে ইমরান খান সমঝোতার ইঙ্গিত হিসাবে পাইলটকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এতে তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন, যা কিনা ভারতের জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে তার এক ধরণের কূটনৈতিক জয় বলে মনে করা হয়।
বছরের শেষের দিকে, সমস্ত প্রত্যাশার বিপরীতে গিয়ে এই পাকিস্তানি নেতা কিরগিজস্তানের বিশকেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাত করে সৌহার্দ্য বিনিময় করেন।
এরপরে জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় তিনি হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী হন। সে সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে "দুর্দান্ত ক্রীড়াবিদ এবং খুব জনপ্রিয়" বলে অভিহিত করেন।
ওয়াশিংটনে থাকাকালীন তিনি কংগ্রেস নেতাদের সাথেও সাক্ষাত করেন, মার্কিন গণমাধ্যমকে সাক্ষাতকারও দেন এবং থিংক ট্যাঙ্ক সার্কিটের সামনে "উচিত কথাগুলো" বলে আসেন।
তবে পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন করেছেন যে খানের মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্বের কারণে বিদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে কী কোন লাভ হয়েছে।
"মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি পাকিস্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ হবে এবং পুনরায় সাহায্য দেওয়া শুরু করবে?" জিজ্ঞাসা করেছেন রাজনীতি বিশ্লেষক সুহেল ওয়ারাইচ। " রাশিয়ার আচরণ কি পাকিস্তানের প্রতি নীতি পর্যায়ে বদলে যাবে? ওই বৈঠক থেকে কী লাভ হয়েছে?"
নিজ দেশে অভিযান
বিদেশে সফরকালে নিজের এবং নিজ দেশের ব্যাপারে প্রগতিশীল ভাবমূর্তি ফুটিয়ে তুললেও, পাকিস্তানিরা ইমরান খানকে দেখেন এক অন্যরকম রাজনৈতিক জীব হিসেবে।
বক্তৃতা এবং জনসভায় তিনি প্রায়শই পূর্ববর্তী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে সংঘাতপূর্ণ বক্তব্য দেন। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তিনি বলেন যে তাদের কারণে দেশ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী অন্তত ১৩জন শীর্ষ বিরোধী রাজনীতিবিদ দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারের বন্দি রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ, তাঁর কন্যা মরিয়ম নওয়াজ এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আসিফ জারদারি।
খান সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের হয়রানি করার অভিযোগও উঠেছে। কিন্তু জোর দিয়ে বলা হচ্ছে যে এর সঙ্গে দুর্নীতি দমন মামলায় কোনও যোগসাজশ নেই।
মি. চৌধুরী বলেন, "এখানে কোনও উইচ হান্ট হচ্ছেনা।"
আন্দোলনকারীরা বলছে যে, ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভিন্নমত ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম গ্রুপ রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের অভিযোগ "পাকিস্তানের প্রেস ফ্রিডমের স্বাধীনতা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পেয়েছে"। এবং এজন্য তারা মি. খানকে জরুরি ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
আন্তর্জাতিক আইন কমিশনের সাথে যুক্ত আইনজীবী রিমা ওমর বলেছেন, সরকারের কঠোর সমালোচকদেরও যতটা ভয় পেয়েছিল তার চেয়েও এই সরকার বেশি নিপীড়নমূলক।
"কী বলা যাবে এবং কী বলা যাবেনা সে বিষয়ে সতর্ক রেখা টেনে দেয়ার হার দিন দিন বাড়ছে," তিনি বলেন" "নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সরকারের ব্যাখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জায়গাটি দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে।"
জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ পলিসি অ্যান্ড গভর্নমেন্ট বিষয়ের অধ্যাপক আহসান বাট প্রশ্ন রেখেছিলেন যে, ইমরান খান এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি অনেক আগে প্লেবয় উদারপন্থী ভাবমূর্তি স্থাপন করেছিলেন এবং যিনি পুরোপুরি এই ক্র্যাকডাউনের পেছনে ছিলেন।
"[ক্র্যাকডাউন] মূলত সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলির নেতৃত্বে হয়েছিল। ইমরান খান হয় স্বেচ্ছায় এতে অংশ নিয়েছিলেন অথবা তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং এটিকে থামানোর চেষ্টা করেননি," তিনি বলেন।
পাকিস্তানের বেসামরিক কার্যনির্বাহী ও সামরিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঐতিহাসিক ভারসাম্যহীনতা বিবেচনা করে কিছু পর্যবেক্ষক গভীর সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছে, যে কে এই সমস্যার সমাধান করবে?
সেনা প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার নভেম্বরে অবসর নেওয়ার পরেও তার মেয়াদ আরও তিন বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছিল।
"ইমরান খান ক্ষমতায় আছেন সেনাবাহিনীর সহায়তা ও আশীর্বাদ নিয়ে এবং তিনি নিজেও এটি জানেন" লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক সামীন মহসিন এ কথা বলেন।
"একটা জায়গা পর্যন্ত তাদের অবস্থান অভিন্ন। আমি মনে করি না যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে সত্যিই ইমরান খান আছেন।"
ইমরান খানের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম বছর জুড়েই এই ধরনের প্রশ্নগুলো তাকে ঘিরে রেখেছিল এবং খুব শীঘ্রই তিনি যে এগুলো শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হবেন এমন সম্ভাবনাও খুব কম রয়েছে। সুত্র: বিবিসি বাংলা
এসি