‘বিএনপিতে প্রবীণ ও তরুণদের মধ্যে বোঝাপড়া অতি জরুরী’
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:৪১ পিএম, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০২:৪৩ পিএম, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ৪১তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আজ রোববার। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলটির যাত্রা শুরু হয়। তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতায় প্রায় এক যুগ ক্ষমতার বাইরে থাকায় কোণঠাসা হয়ে পড়া বিএনপিতে এখন নেতৃত্ব সংকটও প্রকট হয়ে উঠেছে। দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় আদালত কর্তৃক কারাদণ্ডাদেশ পেয়ে কারাগারে। তার জ্যেষ্ঠ ছেলে বিএনপির ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ তারেক রহমান হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এবং বিলেত পলাতক।
৪১তম প্রতিষ্ঠাবাষিকীতে বিএনপির উত্থান-পতন ও নেতৃত্ব সংকটসহ নানা বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া পরিষদের আহবায়ক এবং শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান। তিনি জিয়া পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক এবং এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএনপি সমর্থিত প্যানেল থেকে বেশ কয়েকবার শিক্ষক সমিতির নির্বাচন অংশ নিয়েছেন।
তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জোবায়ের কামাল।
একুশে টিভি অনলাইন : বিএনপি'র ভবিষ্যৎ কী?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী এবং দ্বিদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য বিএনপির বিকল্প নেই। বিএনপি সেজন্যই টিকে আছে এবং থাকবে। সরকারে যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে রাজনৈতিক কৌশল গ্রহন ও তা কার্যকর করার ওপর। সংগত কারণেই গণতন্ত্রকামী দেশবাসীর অংশগ্রহণে বিএনপি এই অরাজক পরিস্থিতি দূর করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
একুশে টিভি অনলাইন : বিএনপি'র ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের কি হবে?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : জিয়াউর রহমানের অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপি যখন রাজনৈতিক সংকটে পতিত ছিলো তখন বেগম খালেদা জিয়া একজন গৃহবধূ ছিলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিএনপিকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে বিএনপিকে সর্ববৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত করেন এবং তিন-তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সক্ষমতা সাথে পালন করেন। তার জীবদ্দশায় বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে কোন ধরনের সমস্যা আছে বলে মনে করি না। পাশাপাশি তার পরামর্শ ও তত্ত্বাবধায়নে বিএনপি'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিএনপিকে নেতৃত্ব দেবার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত হয়ে উঠেছেন। এক্ষেত্রে বিগত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের কঠিন রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে যে পাঠ তিনি গ্রহণ করেছেন তা তার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব প্রদানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তার নেতৃত্বে বিএনপি সকল ষড়যন্ত্র ও সংকট মোকাবেলা করে দেশকে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী পরিচালনা করবার জন্য আরো বেশি সক্ষম হয়ে উঠবে।
একুশে টিভি অনলাইন : গত নির্বাচনে অংশ নেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত ছিল?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : দুটি কারণে আমি মনে করি গত নির্বাচনে অংশ নেওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল:
প্রথমত, নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে বিএনপি আরও বেশি সমালোচনার মুখোমুখি হতো কারণে ২০১৪ সনে অংশগ্রহণ না করার কারণে সমালোচিত হয়েছে। এই সমালোচনার একটি যুক্তিযুক্ত দিক হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে যত বড় দলই হোক না কেন রাজনৈতিক কর্মীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে জাতি এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেত না এবং নির্বাচনে না যাওয়ার অভিযোগে বিএনপি অভিযুক্ত হতো। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করার বিষয় হলো এর মাধ্যমে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার পক্ষে বিএনপি যে দাবিটি করে আসছে তার যুক্তিকতা আবারো প্রমাণিত হলো এবং বাংলাদেশ নির্বাচনের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাহায্য গ্রহণের কোনো বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না।
একুশে টিভি অনলাইন : ২১ আগস্টের বোমা হামলার বিচার না করা কতটুকু দায় এড়াতে পারে দলটি?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : এ ধরনের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিচার হবে এটাই সকলের প্রত্যাশা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ই ধরনের বিচারকার্য সম্পন্ন হলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারত। তবে এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর ঘটনার বিচার কার্য সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন সকল পক্ষের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা। আমরা আরও লক্ষ করলাম বিএনপি সরকার পরবর্তী (মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই বিচারকার্যে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই এই বোমা হামলার বিচারের কাজটি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। এক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে স্বচ্ছতার প্রশ্ন করবার অবকাশ থাকলেও সেদিকে না গিয়ে যদি বলি এই বিচারকার্য সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারেরও প্রায় একযুগ সময় লেগেছে।
এতে বোঝা যায় বিএনপি সরকারের আমলে এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিচারকার্য সম্পন্ন না হবার পেছনে ঘটনাটির স্পর্শকাতরতা এবং জটিলতাকে অন্যতম প্রধান দুটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যাই হোক বিষয়টি যেহেতু বিচারাধীন এ বিষয়ে এর বেশি মন্তব্য করা যথাযথ হবে বলে আমি মনে করি না।
একুশে টিভি অনলাইন : বিএনপি শপথ গ্রহণ নিয়ে দ্বিমুখী সিদ্ধান্তের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : রাজনীতি একটি কৌশলের খেলা। ঐক্যফ্রন্টের অন্যান্য অংশীজনদের মধ্যে শপথ নেওয়ার বিষয়ে যখন মত ভিন্নতা এবং দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছিল, সেই সময়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে দ্বিমুখী বলে মনে হলেও ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য বজায় রেখে চলমান গণতন্ত্র উদ্ধারের সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য শপথ গ্রহণের এই সিদ্ধান্ত কৌশলগত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবে সঠিক বলেই প্রতীয়মান হয়।
একুশে টিভি অনলাইন : খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে বিএনপি কতটুকু ভূমিকা পালন করছে?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য যে আন্দোলন হচ্ছে তা যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা সঠিক নয়। ফলে আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হবার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা নেই। বাধাটি মূলত রাজনৈতিক। সংগত কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তি নির্ভর করছে কার্যকর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ওপর। এই অবস্থায় বিএনপিকে দেশের সর্ববৃহৎ জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণের সমর্থন এবং সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, সকল চড়াই-উৎরাই মধ্যেই খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করতে হবে এবং দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। অন্যথায় বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে যে আস্থা অর্জন করেছে দেশবাসীর কাছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ফলে উপযুক্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করার মধ্যে দল হিসাবে বিএনপি'র জনপ্রিয়তা রক্ষা করা এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে সফল হওয়া অনেকাংশে নির্ভর করছে।
একুশে টিভি অনলাইন : প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে নেতাকর্মীদের কি বার্তা দিতে চান?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য। এ থেকে কোনো বিরতি নেই। এই ব্রত পালনে ব্যর্থ হলে বিএনপির জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামই কেবলমাত্র বাধা গ্রস্থ হবে না বরং দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত,এমনকি বিলুপ্তও হতে পারে। তাই এই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কেবল দলীয় কর্মীদের স্বার্থের সঙ্গেই জড়িত নয় বরং তা দলমত নির্বিশেষে গোটা দেশবাসীর জন্য জরুরী। এই দায়িত্ব পালন করার মধ্যেই দল হিসাবে বিএনপি'র সামগ্রিক সফলতা নির্ভর করছে বলে আমি মনে করি।
একুশে টিভি অনলাইন : দুর্নীতি মামলায় জেলে খালেদা জিয়া পলাতক তারেক রহমান তাদের অবর্তমানে বিএনপি'র হাল কে ধরবেন?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের পরামর্শে দলের নেতৃবৃন্দ বর্তমানে যেভাবে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাতে কোন সমস্যা নেই, যদি তাদের পরামর্শ অনুযায়ী দলের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নেতৃবৃন্দ সকলের কাঙ্খিত লক্ষ্য গণতন্ত্র উদ্ধারে সংগ্রাম সফলকাম হন। তবে রাজনীতির মাঠে তাদের অনুপস্থিতি যে শূন্যতা সৃষ্টি করবে তা কাটিয়ে উঠবার জন্য তাদেরই দিকনির্দেশনা ব্যাপারে বিএনপির প্রবীণ ও তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে একটি সন্তোষজনক বোঝাপড়া অতি জরুরী।
একুশে টিভি অনলাইন : বিএনপির সংরক্ষিত আসনের এমপি ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। প্লটের জন্য আবেদনের বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : সংসদের শপথ গ্রহণ করার বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের বিষয়টিকে যদি এক পাশে রাখা যায় তাহলে একজন সাংসদ হিসেবে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহান কর্তৃক প্লটের জন্য আবেদনের বিষয়টি আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য। কারণ এটি অধিকারের প্রশ্ন, সরকারপক্ষের দেয়ার বিষয় নয়।
একুশে টিভি অনলাইন : ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করেন কি?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : আমি মনে করি হবে। কারণ ছাত্র নেতৃত্ব গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়াই হচ্ছে সঠিক ছাত্র নেতৃত্ব তৈরি করবার সঠিক প্রক্রিয়া। গণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব তৈরি করবার গৃহীত সিদ্ধান্তটি ছাত্রদলের সমস্যাকে দূর করবে। যদিও গণতন্ত্র চর্চার দীর্ঘ অনভ্যস্ততা সাময়িকভাবে একটি সংকট তৈরি করেছিল।
একুশে টিভি অনলাইন : বিএনপি আন্দোলন করতে পারবে বলে কি আপনার মনে হয়?
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : আপনার এই প্রশ্নের জবাব পূর্ববর্তী দু-একটি প্রশ্নের জবাবেই পাওয়া যাবে। সংক্ষেপে বললে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক দুরবস্থা অর্থাৎ গণতন্ত্রহীনতার যেই পরিস্থিতি চলছে বিএনপি'র জন্য রাজনীতি চর্চার একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র। প্রয়োজন সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া। সাময়িকভাবে দমন-নিপীড়নের কারণে অংশগ্রহণে ক্ষেত্রে কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক চিত্র দেখা গেলেও ন্যায্য দাবির পক্ষে সকল অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে যদি বিএনপি দাঁড়িয়ে থাকে তবে কেবলমাত্র নিষ্ক্রিয় নেতা-কর্মীই নয় গণতন্ত্রকামী দেশবাসী গণতন্ত্র উদ্ধারের এই সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে সমর্থন যোগাবে।
একুশে টেভি অনলাইন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল : আপনাকে এবং একুশে টিভিকেও ধন্যবাদ।