আবু সায়ীদের ‘শাড়ি’ নিয়ে ফেসবুকে ঝড়
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:৪৫ পিএম, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০৪:৩৩ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সোমবার
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শাড়ি বিষয়ক একটি লেখা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই লেখায় বাঙালি মেয়েদের পোশাক হিসেবে শাড়িকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
শাড়ি পরার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে নারীর শরীর নিয়ে নানাবিধ উপমা ব্যবহার করেছন, যা নারীকে হেয় করেছে বলেই মনে করছেন অনেকে। লেখাটিতে তিনি বাঙালি নারীদের চেহারার কথা বলতে গিয়ে তাদের উচ্চতা, চেহারা ও শারীরিক আকৃতি নিয়েও কটাক্ষ করেছেন।
অনেকেই তার ফেইসবুকে লিখেছেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবু সায়ীদ একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। যুগের পর যুগ ধরে দেশের আনাচে-কানাচে বই পড়া আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি আলোকিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ও সম্মানিত। এমন একজন মানুষের লেখায় নারী শরীরের আকৃতি, মানুষের চেহারা ও পোশাকের রুচি নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য অনেকেই আশা করেননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সাদেকা হালিম তার ফেসবুকে লিখেছেন, `শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক। শুধু শালীন নয়, রুচিসম্পন্ন, সুস্মিত ও কারুকার্যময় পোশাক। নারী শরীরকে যতটুকু অনাবৃত রাখলে তা সবচেয়ে রহস্যচকিত হয়ে ওঠে, পোশাক হিসেবে শাড়ি তারই উপমা। শরীর আর পোশাকের ওই রমণীয় এলাকা বিভাজনের অনুপাতে শারীর রচয়িতারা কি জেনে না–জেনে খুঁজে পেয়েছিলেন, সে কথা বলা না গেলেও এর পেছনে যে গভীর সচেতন ও মুগ্ধ শিল্পবোধ কাজ করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা নারীকে করে তোলে একই সঙ্গে রমণীয় ও অপরূপ। শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল।' এই লেখা প্রকাশের পর বিভিন্ন পত্রিকা ও ফেসবুকে নানা আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে।
নারীবাদী লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট সাদিয়া নাসরিন তার ফেইসবুকে লিখেছেন, নিয়মিত শাড়ি পরেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি শাড়ি পরে করি না এমন কোনো কাজ নেই।’ গাড়ি চালানো, অফিস করা, ব্যাকপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে বাইরের কাজ করা, ঘরের কাজ সবই করেন বলে জানান তিনি। সাদিয়া বলেন, ‘এটাই আমার পোশাক। এতেই আমি আরাম পাই।’
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো আলোকিত একজন মানুষের কাছ থেকে শাড়ি বিষয়ক এমন মন্তব্য আশা করেননি বলে জানান তিনি। সাদিয়া নাসরিন বলেন, ‘বই পড়ার সুযোগ করে দিয়ে কয়েক প্রজন্মের মনস্তত্ত্ব গড়েছেন যিনি শাড়ি নিয়ে তার লেখাটিও আমি বুঝিনি। সেটা কি আসলে সাহিত্য নাকি মুক্ত গদ্য তা আমার কাছে পরিষ্কার নয়।’
সাদিয়া বলেন, ‘আবু সায়ীদ আমাদের কাছে একজন আইকনিক ব্যক্তিত্ব। অথচ শাড়ি বিষয়ে তিনি যেভাবে নারীর চেহারা, উচ্চতা, শারীরিক আকৃতি এবং যৌনতার উল্লেখ করেছেন তাতে এই লেখাটিকে সেক্সিস্ট (যৌন বৈষম্যমূলক) ও রেসিস্ট (বর্ণবাদী) বলে মনে হয়েছে।’
সাদিয়া নাসরিন আরও বলেন, ‘তিনি শাড়িকে উত্তেজক পোশাক হিসেবে লিখে মূলত নারীকেই পণ্যায়ন করেছেন। যেখানে আমরা সবাই মিলে ধর্ষণমুক্ত সমাজ গড়ার আন্দোলন করছি, সেখানে ওনার এই ধরনের অবিবেচক মন্তব্য সমাজের ধর্ষকামী আচরণকে আরও উসকে দিতে পারে বলে মনে করি আমি।
সাদিয়া বলেন, ‘একই লেখায় তিনি বলেছেন বাঙালি নারী-পুরুষ তার নিজস্ব সৌন্দর্যের মাপকাঠি অনুযায়ী যথেষ্ট সুন্দর না। গড়পরতা বাঙালি চেহারা নিয়ে এমন অনভিপ্রেত মন্তব্য মোটেই তার কাছ থেকে কাম্য না।’‘তিনি শুধু নারীর পণ্যায়ন করেই থেমে থাকেননি, মেয়েদের ঘরের বাইরে কাজ করা নিয়েও আপত্তি জানিয়েছেন বলেই মনে হল’—বলেন সাদিয়া নাসরিন।
এমনকি নারী কী পরবে না পরবে, সেটারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তার এমন মন্তব্য ধর্ষকামীদের পাশাপাশি মৌলবাদীদেরও উসকে দিতে পারে সেই আশঙ্কাও জানান এই লেখিকা।
সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি তার ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘শাড়ি নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখাটা ভালো হলেও বিষয়বস্তু ভালো লাগেনি তার। লেখাটির মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন বাঙালি নারীরা খুঁত ঢাকার জন্য শাড়ি পরে।’ শাড়ি তার কাছে একটি আরামদায়ক পোশাক। এই পোশাক নিয়ে তিনি বলেন, ‘শাড়ি একটা পোশাক যা মেয়েরা ভালোবেসেই পরে। আমি নিজেও শাড়ি পরি। অনেকেই আছে কাজের সুবিধার জন্য শাড়ি পরেন কম। অন্যান্য পোশাক পরেন। কে কী পরবেন সেটা নির্ধারণ করে দেওয়ার চেষ্টা খুবই কুৎসিত চিন্তার প্রকাশ।’
‘শাড়ি’ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাশেদা রওনক খানের স্ট্যাটাস দেখুন:
‘চিত্রনায়িকা মৌসুমির শাড়ির বিজ্ঞাপন দেখে সেসময় মৌসুমির প্রেমে পড়েনি, কেউ আছে? সাদিয়া ইসলাম মৌ, চম্পা, এরপর বিজুরী, পূর্ণিমা তারপর আরও অনেকেরই শাড়ির বিজ্ঞাপন সেসময় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল খুব! সেসব জনপ্রিয়তার ভিড়ে এসব শাড়ির বিজ্ঞাপন বানানোর প্রক্রিয়া দেখে বরাবরই হতাশ হতাম! 'উত্তরাধুনিকতাবাদ ও গণমাধ্যমঃ বাংলাদেশের টেলিভিশন বিজ্ঞাপন' নামক একটি প্রবন্ধে এই নিয়ে লিখেছিলাম প্রথম| পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সেসব বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের যাদের সাথেই আলাপের সুযোগ হয়েছে তাদের বলতে দ্বিধা করিনি, এতো জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন বানানোর পরও কোথায় শাড়িতে নারীকে পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারেনি তাঁরা| অনেকেই একমত হয়েছেন, কেউ হয়তো নীরবে শুনেছেন আমার মতামত| খুব একটা দ্বিমত করেছেন, এমনটি পাইনি|
এবার আসি, কেন মনে হতো সেসব বিজ্ঞাপনে নারীর শাড়িকে সঠিকভাবে তুলে ধরা হতো না? শাড়ির বিজ্ঞাপনে বরাবরই আমরা দেখতাম, মডেলরা কয়েক সেকেন্ডের মাঝে গোটা দশেক শাড়ি পরে আকাশে বাতাসে পাহাড়-পর্বত-সাগর-সমতল সব জায়গায় নেচে বেড়াচ্ছেন মিউজিকের তালে তালে| আমার প্রশ্ন ছিল সেইসব বিজ্ঞাপন নির্মাতাদের কাছে, নারী কি কেবল শাড়ি পরে আকাশে বাতাসে পাহাড়-পর্বত-সাগর-সমতল সব জায়গায় নেচে বেড়ায়? নারী কি শাড়ি পড়ে রান্না করে না? ঘর ঝাড়ু দেয় না? অফিসে যায় না? ডাক্তারি করে না? শিক্ষকতা করে না? তাহলে নারীর শাড়ির বিজ্ঞাপন কেন কেবল এই আকাশে বাতাসে নাচানাচি করাই হয়ে থাকে? সেইসময়ের খুব বিখ্যাত একজন নির্মাতা বলেছিলেন আমার প্রবন্ধটা পড়ে, আসলে এভাবে কখনো চিন্তাই করা হয়ে উঠেনি তাঁর!
ছোটবেলা হতেই শিক্ষক নানুকে দেখেছি কি নিপাট ভাঁজভাঙা শাড়ি পরতেন, আমার ছোট্ট দুটি চোখ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখত এর মাঝে একজন বিধবা কিন্তু মহীয়সী নারীর ব্যক্তিত্ব! প্রফেসর মাকেও দেখতাম কিভাবে কলেজ যাবার আগে পরতেন সদ্য ইস্ত্রি করা মাড় ভাঙ্গা শাড়ি! সেই সদ্য ইস্ত্রির ভাঁজ ভাঙ্গা শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে থাকতো নারীর ঘর ও বাহির সামলানোর লড়াই, আমাদের তিন ভাই বোনকে স্কুলে দিয়ে দৌড়ে কলেজে গিয়ে ক্লাস করা , আবার ফিরে এসে তিন সন্তানের পড়ালেখা, স্বামী-সংসারের খোঁজ খবর নেয়া, ঘরের কাজ করা, মিটিং মিছিল সভা সমিতিতে যাওয়া- এসবেই তাঁর শাড়ির সৌন্দর্যের মাঝে লুকিয়ে থাকা লড়াই এর গল্প এবং একই সাথে অসম সাহস ও শক্তির রহস্য! বাদই দিলাম না হয় এমন লড়াকু, আত্ম বিশ্বাসী, উপার্জনক্ষম নারীর শাড়ির সৌন্দর্য! কিন্তু নারীর শাড়ির গল্পে কোথায় পাই একজন ঘরে থাকা নারী যার স্বামীর সীমিত আয়ের সংসারে মাসের শেষ দিনটি পর্যন্ত কোনমতে টেনে নিয়ে যাওয়ার গল্প? কোথায় পাই প্রতিদিন রান্নাঘরের উষ্ণ বাষ্পে হারিয়ে যাওয়া উদাসী মায়ের গল্প? কোথায় পাই সংসার চালানোর জন্য দেয়া বাবার দেয়া বেতনের টাকা হতে ১০০ টাকা দিয়ে কোন এক সন্তানের মনের আশা পূর্ণ করা মায়ের গল্প? কোথায় থাকে একজন নারীর জীবনের চলার পথে নানা চড়াই উতরাই এর গল্প? নারীর জয়ী হবার কিংবা হেরে যাবার গল্প?
টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনগুলোতে পাওয়া যায় না সেইসব নারীর প্রতিদিনকার জীবনের প্রতিচ্ছবি, সেসবে না থাকে তাদের জীবনের লড়াই এর গল্প, আছে কেবল কামুক দৃষ্টিভঙ্গি- যেন পুরুষের চোখে নারী কতটা কমনীয় ও নমনীয় হয়ে উঠতে পারে, সেই প্রতিযোগিতা করাই নারীর একমাত্র 'এইম ইন লাইফ'! নারী কেবল জন্মিয়েছে পুরুষের মনোরঞ্জন করতে| পুরুষের সমাজে নারীর আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারাই কি নারীর শাড়ি পরার একমাত্র কারণ? কিভাবে এতোটা নিজেদের কর্তার আসনে বসিয়ে ফেলে পুরুষেরা? পুরুষের চোখে নারীর প্রেমময়, নমনীয়, কামময় হয়ে উঠাই যেন বিজ্ঞাপন, শিল্প সাহিত্যের একমাত্র বিষয়, একমাত্র সূত্র গল্প-কবিতা- উপন্যাসের? এই কমনীয়তার গল্প টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনগুলোতে যেমন স্থান পেতো, তেমনি স্থান পেয়েছে প্রফেসর আব্দুল্লাহ আবু সাইদের সদ্য প্রকাশিত 'শাড়ি' নিয়ে লেখাটিতে| খুবই হতাশ হলাম এমন গতানুগতিক একটি চিন্তাধারা হতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনেক নারী/পুরুষের মতো তিনিও বের হতে পারেননি বলে!’
টিআর/