ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

এরশাদের আসনে উপনির্বাচন

ত্রিমুখী দ্বন্দ্বে জাতীয় পার্টি

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:০৯ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০১:৪৬ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার

একাদশ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ আসনে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দ্বিধা-বিভক্ত দলটির সিনিয়র নেতারা। 

এই উপ-নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে জাপা। দলীয় মনোনয়ন ফরম ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে দলটি।

এরশাদের আসন নিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করা নিয়ে অস্বত্বিতে রয়েছে জাতীয় পার্টি। জানা গেছে, পরিবারের পক্ষ থেকে প্রার্থী হচ্ছেন অন্তত চারজন। এরমধ্যে ছেলে রাহগির আল মাহিরকে (সাদ এরশাদ) প্রার্থী করতে অনঢ় অবস্থানে রয়েছেন এরশাদপত্নী ও জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।

এছাড়াও ভাতিজা- সাবেক এমপি আসিফ শাহরিয়ার, ভাতিজা (মামাত ভাইয়ের ছেলে) মেজর (অব) খালেদ আখতার, ভাগনি (মেরিনা রহমানের মেয়ে) মেহেজেবুন্নেছা রহমান টুম্পাও মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী চূড়ান্তর বিষয়ে একমত হতে পারেনি কেউ। ফলে আগামী ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় এই উপনির্বাচনকে ঘিরে জাপায় ত্রিমাত্রিক দ্বন্দ্ব এখন প্রায় প্রকাশ্য।

জানা যায়, দলীয় মনোনয়ন পেতে ছেলে সাদকে নিয়ে শনিবার রংপুরে যান রওশন। মা-ছেলে একসঙ্গে এরশাদের কবর জিয়ারত করেন। এ সময় সাদ স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি দলের প্রার্থী হতে চান, এ লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নিয়েছেন।

রওশন ও সাদের সঙ্গে রংপুরে যান জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা। রাঙ্গার রংপুরে যাওয়ার ঘটনায়ও জাপায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জি এম কাদেরকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গত দেড় মাস ধরে তত্পর থাকলেও হঠাত্ রওশনের সঙ্গী হওয়ায় রাঙ্গাকে নিয়ে জি এম কাদেরের অনুসারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। 

যদিও রাঙ্গা এ বিষয়ে বলেছেন, প্রার্থী মনোনয়নে দল একটি বোর্ড গঠন করেছে। বোর্ডই দলীয় প্রার্থী ঠিক করবে।

তবে জাতীয় পার্টির অনেক সিনিয়র নেতা ও স্থানীয় জাপার নেতাকর্মীরা রাহগির আল মাহিরকে নমিনেশন দিতে নারাজ। অনেক নেতারাই চান রংপুরের তৃণমূলকে প্রাধান্য দিয়ে প্রার্থী নির্বাচিত হোক। এতে দল আরও বেশি শক্তিশালী হবে। জাপার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরে দলে নিজেদের অবস্থান আরও বেগবান হবে।

এই আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব ও রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসির ইয়াছিরের সমর্থকদের মতে, সাদ কখনো দলের রাজনীতিতে ছিলেন না। এরশাদ নিজেও জীবিত থাকতে কখনো রংপুরে কিংবা ঢাকায় দলীয় কোনো অনুষ্ঠানে সাদকে সঙ্গে নেননি। 

জানা গেছে, সাদ আজ মঙ্গলবার রাজধানীর বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয় থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করবেন। তবে সাদকে দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার দাবিতে রংপুরে ঝাড়ু মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এস এম ইয়াসিরের সমর্থকরা। 

তবে এরশাদের পরিবার-স্বজনরা চান, এরশাদের আসনে পরিবারের পক্ষ থেকেই কাউকে যেন প্রার্থী করা হয়। পরিবারের বাইরে কাউকে প্রার্থী করা হলে সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে জাপার সামগ্রিক রাজনীতিতে।

পরিবারের বাইরে রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসিরকে মনোনয়ন দেয়ার দাবি জানিয়ে ইতোমধ্যে আল্টিমেটাম দিয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা। দলের দুর্গখ্যাত এ আসনে মনোনয়ন পেলেই বিজয়ী হবেন এমনটা চিন্তা থেকেই লবিং-তদবির বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রার্থীরা। অনেকেই পার্টির চেয়ারম্যান মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছেন।

কয়েকদিন আগে এরশাদের ছোট ছেলে এরিক এরশাদকে নিয়ে দলের মনোনয়ন সংগ্রহ করতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন এস এম ইয়াসির। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল এখন সার্কাসে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। 

তিনি বলেন, দলীয় চেয়ারম্যানের একমাত্র উত্তরসূরি প্রতিবন্ধী সন্তানকেও এখন রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। জাতির কাছে আমার প্রশ্ন, যারা এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের বিবেক বুদ্ধি কি সব লোপ পেয়ে গেছে?

এদিকে রংপুর-৩ আসনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে গত শনিবার গঠিত পার্টির পার্লামেন্টারি বোর্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তারা বলছেন, দলের গঠনতন্ত্রে বিভাগ অনুযায়ী সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বোর্ড গঠন করার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। 

বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ আসন থেকে নির্বাচন করার আগ্রহ রয়েছে প্রয়াত এরশাদের সহোদর ও পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের। সেক্ষেত্রে এ আসনে অনেক হিসেব-নিকেশ করে মনোনয়ন দিতে চান তিনি।

এ বিষয়ে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জাপা মনোনয়ন ফরম বিতরণ করবে। পরদিন শুক্রবার বিকালে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাত্কার নেবে গঠিত আট সদস্যের মনোনয়ন বোর্ড। যাচাই-বাছাই করে বোর্ড প্রার্থী ঠিক করবে। 

তিনি বলেন, এই উপনির্বাচনকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। যেহেতু এটা এরশাদ সাহেবের আসন, সেই কারণে বিজয়ের লক্ষ্য নিয়েই আমরা উপযুক্ত প্রার্থী ঠিক করব। এদিকে, এরশাদের অবর্তমানে জাপার নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে সৃষ্ট মতপার্থক্যও দূর হয়নি। বরং সেটিও আরো ঘণীভূত হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে সফলতা আসেনি।

এদিকে, রংপুর-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম বিতরণ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রথম দিনে ৩টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে দলটি। এদিন তিনজন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বলে জানা গেছে। কতারা হলেন- আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য চৌধুরী খালেকুজ্জামান, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম ও রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তুষার কান্তি মণ্ডল।

একটি সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ওই আসনে মনোনয়ন ফরম বিতরণ করায় জাতীয় পার্টিতে চলছে অস্থিরতা। জাপার অনেক নেতারাই মনে করছেন, জাতীয় পার্টিতে অস্থিরতা তৈরি করতে রংপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন ফরম বিতরণ করছেন। তবে তারা যতই মনোনয়ন ফরম বিতরণ করুক না কেন রংপুর-৩ আসন জাতীয় পার্টির ঘাটি। সেখানে অন্য কোনো দলের সুযোগ নাই। তাছাড়া এটা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আসন এখানে অন্য কেউ জয়ী হতে পারবে না।

রংপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিতরণের বিষয়ে দলটির দফতর সম্পাদক ড. আবদুল সোবহান গোলাপ সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় রংপুর-৩ আসন আমাদের জোট শরিক জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন, এ কারণে ফলে গত নির্বাচনে ১৪-১৫ টি মনোনয়ন বিক্রি কম হয়েছিল। কিন্তু এবার উপ-নির্বাচনে অনেক বেশি মনোনয়ন বিক্রি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, গত ১৪ জুলাই একাদশ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৬ জুলাই আসনটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

গত রোববার ওই আসনে উপ-নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করা হবে।

এই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া যাবে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, তা বাছাই হবে ১১ সেপ্টেম্বর, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর। ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৫ অক্টোবর। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।

রংপুর-৩ আসনটি সদর উপজেলা এবং রংপুর সিটি করপোরেশনের ৯ থেকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। এ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৪২ হাজার ৭২ জন। এঁদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২১ হাজার ৩১০ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ২০ হাজার ৭৬২ জন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এ আসনটিতে ইভিএমে ভোট নিয়েছিল ইসি। রংপুর-৩ আসনে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯২৬ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী রিটা রহমান পেয়েছিলেন ৫৩ হাজার ৮৯ ভোট। ভোট পড়েছিল ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ।