ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

এরশাদের আসনে কে ধরছেন লাঙ্গলের হাল?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:৫৫ পিএম, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ০১:০১ পিএম, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ বুধবার

সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া রংপুর-৩ (সদর) আসনে অর্ধডজন প্রার্থী দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। এর মধ্যে এরশাদপুত্র সাদ এরশাদসহ পরিবারের ৪ সদস্য রয়েছেন। 

এরশাদের আসন নিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করা নিয়ে অস্বত্বিতে রয়েছে জাতীয় পার্টি। পরিবার থেকে মনোনয়ন দৌড়ে থাকা ব্যক্তিরা হলেন- এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ, ভাতিজা (ছোটভাই সাবেক সংসদ সদস্য মোজাম্মেল হোসেন লালুর ছেলে) সাবেক এমপি আসিফ শাহরিয়ার, ভাতিজা (ফুপাতো ভাই সাফায়েত হোসেনের ছেলে) মেজর (অব.) খালেদ আখতার, ভাগনি (মেরিনা রহমানের মেয়ে) মেহেজেবুন্নেছা রহমান টুম্পা। 

পরিবারের বাইরে থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য শিল্পপতি এসএম ফখর- উজ-জামান ও রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সেক্রেটারি এস এম ইয়াসির। জাতীয় পার্টির দুর্গখ্যাত এ আসনে মনোনয়ন পেলেই বিজয়ী হবেন ধরে নিয়ে লবিং-তদবির করছেন তারা।

তবে এখন পর্যন্ত রংপুর-৩ আসনে প্রার্থী চূড়ান্তর বিষয়ে একমত হতে পারেনি কেউ। ফলে আগামী ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় এই উপনির্বাচনকে ঘিরে জাপায় ত্রিমাত্রিক দ্বন্দ্ব এখন প্রায় প্রকাশ্য।

এই উপ-নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে জাপা। দলীয় মনোনয়ন ফরম ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে দলটি।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পার্টির চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ। 

এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এসএম ফয়সল চিশতী, লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, মেজর (অব.) খালেদ আখতার, সফিকুল ইসলাম, যুগ্ম মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা এমপিসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। 

ফরম নেয়ার পর গণমাধ্যমকর্মীদের সাদ এরশাদ বলেন, ‘বাবার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাই। দল মনোনয়ন দিলে রংপুর তথা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই।’ 

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতির বাইরে কখনই ছিলাম না। ছোটবেলা থেকে রাজনীতি দেখে এসেছি। আমি রাজনীতির ‘সাফারারও’ ছোটবেলাতে হয়েছি। পাঁচ বছর বয়সে হাজত খেটেছি। সম্ভবত এত কম বয়সে আর কাউকে (রাজনৈতিক কারণে) কারাগারে যেতে হয়নি।’

এ আসনে প্রার্থী মনোনয়নের জন্য ৮ সদস্যের পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করেছে জাতীয় পার্টি। পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের আহ্বায়ক ও মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা এর সদস্য সচিব। বোর্ডের সদস্যরা হলেন- পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, গোলাম কিবরিয়া টিপু এমপি, শেখ সিরাজুল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি ও লে. জে. (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এমপি। 

এরমধ্যে ছেলে রাহগির আল মাহিরকে (সাদ এরশাদ) প্রার্থী করতে অনঢ় অবস্থানে রয়েছেন এরশাদপত্নী ও জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।

জানা যায়, দলীয় মনোনয়ন পেতে ছেলে সাদকে নিয়ে শনিবার রংপুরে যান রওশন। মা-ছেলে একসঙ্গে এরশাদের কবর জিয়ারত করেন। এ সময় সাদ স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি দলের প্রার্থী হতে চান, এ লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নিয়েছেন।

তবে এরশাদের পরিবার-স্বজনরা চান, এরশাদের আসনে পরিবারের পক্ষ থেকেই কাউকে যেন প্রার্থী করা হয়। পরিবারের বাইরে কাউকে প্রার্থী করা হলে সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে জাপার সামগ্রিক রাজনীতিতে।

এরশাদের আসনে প্রার্থী হতে সাবেক এমপি আসিফ শাহরিয়ার নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় প্রচার শুরু করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, দলের মনোনয়ন চাইবেন, দল যদি মনোনয়ন না দেয়, তাহলে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে লড়বেন। আসিফ শাহরিয়ার বলেন, ‘মাঠে ডিমান্ড রয়েছে, রংপুরের লোক চাইছেন তাই প্রার্থী হচ্ছি। রংপুরের লোকজন কোনো বহিরাগত প্রার্থীকে মেনে নেবে না। চাচা বেঁচে থাকলে ভিন্ন কথা ছিল, কিন্তু এখন মানুষ আবোলতাবোল প্রার্থীকে নেবে না। বহিরাগত প্রার্থী দেয়া হলে জাতীয় পার্টির জন্য আত্মঘাতী হবে।’ নির্বাচিত হতে পারলে জনগণের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে চান তিনি।

খালেদ আক্তার পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি দীর্ঘদিন এরশাদের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। এরশাদের সান্নিধ্যে থাকার কারণে অনেকে তাকে সমীহ করে চলতেন। পার্টির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব রয়েছে। তিনি বিগত সংসদ নির্বাচনে লালমনিরহাট-২ আসন থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন। প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে খালেদ আক্তার বলেন, এটা দলের সিদ্ধান্ত। দল সিদ্ধান্ত দিলে আমি নির্বাচন করব।

ভাগনি মেহেজেবুন্নেছা রহমান টুম্পার পৈতৃক ভিটা নীলফামারীর সৈয়দপুরে। বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন জাতীয় পার্টির সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর সঙ্গে। দলীয় সূত্র জানায়, একাদশ সংসদ নির্বাচনে নীলফামারী-৪ আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি।

এসএম ইয়াসির আশির দশকে ছাত্রসমাজের মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরপর ধাপে ধাপে এগিয়ে রংপুর মহানগরে প্রভাবশালী অবস্থান তৈরি করেন। বর্তমানে রংপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সেক্রেটারি। কেন্দ্রীয় জাতীয় পার্টিতে দীর্ঘদিন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মৃত্যুর অল্প কয়েকদিন আগে এরশাদ তাকে যুগ্ম মহাসচিব করেন। এসএম ইয়াসির বলেন, আমার মনোনয়নের বিষয়ে ওয়ার্ড, থানা ও মহানগর কমিটির নেতারা কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছেন। পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের আশীর্বাদ নিয়ে মাঠে কাজ করছি। নির্বাচিত হতে পারলে রংপুরকে ঢেলে সাজাতে চাই।

রংপুর ডেইরির প্রতিষ্ঠাতা শিল্পপতি এসএম ফখর উজ-জামান পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। এরশাদের বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত মকবুল হোসেন ট্রাস্টের অন্যতম ট্রাস্টি তিনি। পার্টির ফান্ডের বড় ডোনার হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। একাধিক নির্বাচনে পাশের আসন রংপুর-৫ (মিঠাপুকুর) থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবে প্রত্যেক দফায় ধরাশায়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থীর কাছে। ফখর উজ-জামান বলেন, পরিবারের বাইরে থেকে যদি মনোনয়ন দেয়া হয়, তাহলে আমার পাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন, জাতীয় পার্টি বড় দল, অনেকে মনোনয়ন চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে ৪ জনের নাম চাওয়া হবে, তা থেকে প্রার্থী চূড়ান্ত করবে পার্লামেন্টারি বোর্ড।

প্রসঙ্গত, গত ১৪ জুলাই একাদশ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৬ জুলাই আসনটি শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়।

গত রোববার ওই আসনে উপ-নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করা হবে।

এই নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া যাবে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, তা বাছাই হবে ১১ সেপ্টেম্বর, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর। ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৫ অক্টোবর। ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।

রংপুর-৩ আসনটি সদর উপজেলা এবং রংপুর সিটি করপোরেশনের ৯ থেকে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। এ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লাখ ৪২ হাজার ৭২ জন। এঁদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২১ হাজার ৩১০ জন ও নারী ভোটার ২ লাখ ২০ হাজার ৭৬২ জন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এ আসনটিতে ইভিএমে ভোট নিয়েছিল ইসি। রংপুর-৩ আসনে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯২৬ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থী রিটা রহমান পেয়েছিলেন ৫৩ হাজার ৮৯ ভোট। ভোট পড়েছিল ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ।