ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৩ ১৪৩১

জাপায় দেবর-ভাবির লড়াই

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:১৪ পিএম, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার

এই মুহূর্তে দেশের রাজনীতিতে গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) ও রওশন এরশাদ আলোচিত দুইটি নাম। একজন জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মনোনীত দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও অন্যজন সিনিয়র-কো চেয়ারম্যান। এরশাদের অনুপস্থিতিতে দলের চেয়ারম্যান পদ নিয়ে এ দুই জনের মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি অবস্থান। এর মধ্যে দুইজনই নিজেকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে বিরোধী দলের নেতা ঘোষণার জন্য জাতীয় সংসদের স্পিকারের নিকট চিঠি দিয়েছেন। 

জাতীয় পার্টির ‘নেতৃত্ব’ নিয়ে জি এম কাদের (দেবর) ও বেগম রওশন এরশাদের (ভাবি) মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। দলের এ সংকট পারিবারিক দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে বলে মনে করেন খোদ দলটির নেতাকর্মীরা। তারা মনে করেন, দেবর ও ভাবির এ দ্বন্দ্বের খেসারত দিতে হবে এরশাদের গড়া দলটির নেতাকর্মীদের। স্বার্থের দ্বন্দ্বে দেবর-ভাবির সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার ঘটনাও সমাজে বিরল নয়। অবশ্য আগে থেকেই জিএম কাদের সঙ্গে রওশন এরশাদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। 

গত ৫ সেপ্টেম্বর এরশাদ পত্নি ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ নিজ সমর্থকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদেরও নিজেকে জাতীয় পার্টির বৈধ চেয়ারম্যান হিসেবে উল্লেখ করে রওশনপন্থিদের প্রতি সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিয়েছেন। যদিও তিনি বলেছেন যে, বেগম রওশন এরশাদকে মায়ের মতো শ্রদ্ধা করেন। এ শ্রদ্ধা যেন শ্রদ্ধাই থাকে অন্য কিছুতে যেন পরিণত না হয় বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন কাদের। ভারত ও পাকিস্তানের মতো অবস্থান নেওয়া এ সম্পর্ক আর কখনও মধুর হবে কিনা তা নিয়ে এখন সন্দেহ দেখা দিয়েছে। 

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পরও নাটকীয়তার বৃত্তেই আটকে আছে সংসদে প্রধান এ বিরোধী দল। 

গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে নিজেকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে ঘোষণা করার অনুরোধ জানিয়ে দলীয় প্যাডে চিঠি পাঠিয়েছেন জিএম কাদের। এরপর বুধবার স্পিকারের প্রতি পাল্টা এক চিঠিতে কাদেরের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দলের কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। এ নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও সংসদ সদস্যরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। বিরোধী দলীয় নেতার আসনে জিএম কাদেরকে চায় এক পক্ষ অন্য পক্ষ চায় রওশন এরশাদকে। 

গত ১৮ জুলাই বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাপার মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা জি এম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। এতে অসন্তুষ্ট হন রওশনপন্থিরা। চেয়ারম্যান হওয়ার পর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক করেন জি এম কাদের। অতঃপর ২০ জুলাই ভাবি রওশন এরশাদের মান ভাঙাতে তার গুলশানের বাসভবনে যান। এ সময় দেবর কাদেরকে দোয়াও করে দেন ভাবি রওশন এরশাদ। তার ৪৮ ঘন্টা পরই ২২ জুলাই সোমবার গভীর রাতে জি এম কাদের জাপার চেয়ারম্যান নন বলে একটি বিবৃতি পাঠান।

রওশন এরশাদের প্যাডে হাতে লেখা ‘জি এম কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ শীর্ষক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রওশন এরশাদ লিখেছেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের মারফত আমরা জানতে পেরেছি জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে; যা আদৌ কোনো যথাযথ ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালনকালে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্র ধারা ২০(২)এর খ-এ দেওয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।

প্রেসিডিয়ামের সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করবেন। চেয়ারম্যানের অবর্তমানে ধারা ২০(২)এর ‘ক’-কে উপেক্ষা করা যাবে না। আশা করি, বর্তমানে যিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরবর্তী চেয়ারম্যান না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।’ বিবৃতিতে এ ঘোষণার প্রতি একমত পোষণকারী সাত জন সংসদ সদস্য ও প্রেসিডিয়াম সদস্যের নাম উল্লেখ করা হয়।

জানা যায়, স্ত্রী রওশনের সঙ্গে জীবদ্দশায়ই এরশাদের বিরোধ ছিল যা বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমেও উঠে এসেছে। ২০০৭ সালে এরশাদ ও রওশনের বিরোধের সূত্রপাত হয়। বিএনপির প্রতি কিছুটা অনুগত থাকা রওশন। এরশাদ আন্দোলনরত আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মহাজোটের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। আর রওশন এরশাদ বিএনপির ইচ্ছানুযায়ী প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে লাঙ্গলের প্রার্থী দেন। 

দেশের টলটলায়মান রাজনীতির মধ্যে সে সময় জাতীয় পার্টি থেকে স্বামী এরশাদকে বহিষ্কার করে রওশন এরশাদ নিজে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও গোলাম মসিহ (বর্তমানে সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত) মহাসচিব করেন। এরশাদও অনেকটা বাধ্য হয়ে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেন। পরবর্তী সময়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ময়মনসিংহ ও গাইবান্ধা থেকে তিনটি আসনে প্রার্থী হয়ে রওশন পরাজিত হন। 

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রওশন এরশাদ নির্বাচনে অংশ নেন এবং জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন। স্বামী-স্ত্রীর সবশেষ বিরোধ নতুন রূপ নেয় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান করায়। এই সিদ্ধান্তে স্বামী এরশাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রওশন। ভাঙনের মুখে পড়ে দল। শেষ পর্যন্ত রওশন এরশাদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান পদে বসিয়ে ভাঙন ঠেকানা হয়। এ বিরোধের জেরেই মূলত দেবর জিএম কাদের ও ভাবি রওশানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। 

রংপুর স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রংপুর-৩ আসনে উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে একক প্রার্থী নির্বাচনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দলের চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন নিয়ে জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের বিবদমান সংকট নিরসন না হলে এ উপনির্বাচনেও দলের একক প্রার্থী মনোনয়নে অনিশ্চয়তা কাটার সম্ভাবনা নেই। এরই মধ্যে কেউ রওশনপন্থী আবার কেউ জিএম কাদেরপন্থী বলে সামনে এসেছেন।

দীর্ঘ দিনের জাতীয় পার্টির ঘাটি এ রংপুরের নিয়ন্ত্রণ এখন মূলত কার হাতে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাওয়া যাচ্ছে পাল্টপাল্টি বক্তব্য। রংপুর নিয়ে দুই পক্ষ এক না হতে পারলে একক প্রার্থীতা পাচ্ছেন না কেউ। যারা রওশনপন্থী নেতাকর্মীরা চান এরশাদ পুত্র রাহগির আল মাহির (সাদ এরশাদ) হবেন জাতীয় পার্টি থেকে এ উপনির্বাচনের প্রার্থী। অন্যদিকে রংপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম ইয়াসিরকে প্রার্থী করতে চান জিএম কাদেরপন্থীরা। 

বৃহস্পতিবার জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদ বৃহস্পতিবারই নির্বাচন কমিশিনকে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন তার স্বাক্ষর ব্যতিত অন্যকারও স্বাক্ষরকে যেন চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর হিসেবে গন্য না করা হয়। 

অন্যদিকে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে জিএম কাদেরের সভাপতিত্বে দলটির পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় রংপুর-৩ আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহীদের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। সাদ এরশাদ সাক্ষাৎকার দিতে না আসায় এ আসনে জাপার প্রার্থী হিসেবে জিএম কাদেরপন্থীদের পছন্দের এস এম ইয়াসিরকে চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান। 

এদিকে আজ শনিবার রংপুরের উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে বিবাদমান দুই পক্ষ। 

এমএস/