এসইসি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দম্ভ বিনিয়োগকারীর রক্তক্ষরণ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:১৫ পিএম, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার
পুঁজিবাজার পরিচালনায় ব্যর্থতার অভিযোগ এনে দেশে বিদ্যমান দু’টি স্টক এক্সচেঞ্জের বাইরে আরেকটি স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনার প্রফেসর হেলালউদ্দিন নিজামী। সম্প্রতি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট এক সেমিনারে তিনি বলেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পর স্টক এক্সচেঞ্জে যে পরিবর্তন আসার কথা ছিলো তা আসেনি। স্টক এক্সচেঞ্জের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়েনি। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে স্টক এক্সচেঞ্জ কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
তিনি তার বক্তব্যে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)’র প্রতি ইঙ্গিত করে আরো বলেন, এই স্টক এক্সচেঞ্জ আগামী দিনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থায়ীত্বশীলতার চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়। তারা যদি তাদের অবস্থা পরিবর্তনে সক্ষম না হয়; তাহলে আমাদের নতুন স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার পথেই এগোতে হবে।
দেশের পুঁজিবাজারে গত কয়েক মাস যাবৎ বড় দরপতন ঘটেছে এবং কপারটেক নামের বিতর্কিত কোম্পানির তালিকাভুক্তিকরাসহ বেশ কিছু কারণে বিএসইসি ও ডিএসই’র সাথে যে টানাপেড়েন চলছে তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো কি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনারের বক্তব্যে? যদিও পুঁজিবাজারে বড় দরপতন বা বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে বিএসইসি কিছু দিন আগে চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে। কমিটির রিপোর্ট আসার আগেই বিদ্যমান সংকটের দায় ডিএসই’র ওপর চাপিয়ে নিজেদের ব্যর্থতার দায়ভার কিছুটা হলেও হালকা করতে চেয়েছেন কি বিএসইসি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনার? নাকি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্যে ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ পেয়েছে তা বিচক্ষণ বিনিয়োগকারী ও বিজ্ঞ বাজার বিশ্লেষকরা ভালো বলতে পারবেন।
যদিও বিএসইসি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনারের বক্তব্যের ব্যাপারে ডিএসই’র স্টেকহোল্ডার বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কারো প্রতিক্রিয়া এখনো জানা যায়নি।
মন্দাক্রান্ত ও বিপর্যস্ত পুঁজিবাজার নিয়ে কিছুদিন আগ পর্যন্ত অত্যন্ত সরব অর্থমন্ত্রী যখন চুপসে গেছেন বা বাজার নিয়ে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন; তখন বিএসইসি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনারের বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তাঁর এ সাহসী বক্তব্যের জন্য সাধুবাদ জানাতে হয়। দেশে সৎ সাহস নিয়ে কথা বলার মতো লোকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনার স্টক এক্সচেঞ্জের কোটারি স্বার্থের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তুলে ধরেছেন তাদের নানা অনিয়মের কথা। এমনকি প্রয়োজনে আরেকটি নতুন স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করার মতো অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী সাহসী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।
কিন্ত কবে হবে সে বহুল প্রত্যাশিত নতুন স্টক এক্সচেঞ্জ? কী হবে এর নাম? কারা হবেন তার স্টেকহোল্ডার? কোন ধরনের কোম্পানি তালিকাভুক্ত হবে সে স্টক এক্সচেঞ্জে? বাহবা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান! পুঁজিবাজারের প্রতি আপনার অভিভাবক সুলভ ও অত্যন্ত দায়িত্বশীল বক্তব্যের জন্য। অনেকের মতো আমিও উচ্ছসিতবোধ করছি; যারা ২০১০ বা ১৯৯৬ সাল থেকে ডিএসই’র দীর্ঘ দিনের কোটারি স্বার্থ ভেঙ্গে জাতীয় পর্যায়ে একটি সার্বজনীন স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে নাওয়া-খাওয়া ভুলে এতোকাল যাবৎ পাগল পারা হয়ে আছেন। কিন্তু সেটি আবার চট্রগাম স্টক এক্সচেঞ্জের মতো আঞ্চলিকতার দোষে দুষ্ট হবে নাতো? তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কেউ আবার অদূর ভবিষ্যতে আপনার মতো অভিযোগ তোলার অবকাশ পাবে কি? তা পেলেই বা সমস্যা কোথায়? তখন হয়তো আপনার মতো দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলবেন-উন্নয়নের মহাসড়কে ভালো ভাবে চলার জন্য দেশে যে কটা স্টক এক্সচেঞ্জ আছে তা দিয়ে জাতির লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না,কেননা আমাদের সামনে রয়েছে ২০৩০, ২০৫০ ও ২০৭০ সাল মেয়াদি উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা; দেশে বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের বাজেট প্রণোনয়নের সম্ভাবনা। সুতরাং দেশ ও জাতীর স্বার্থে আমাদের প্রয়োজন প্রতিটি বিভাগীয় শহর বা জেলা পর্যায়ে একটি করে স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করা। ভাবতে ভালোই লাগে- বিশে^ শীর্ষ জনবহুল দেশের মতো আমরা তখন সর্বাধিক সংখ্যক স্টক এক্সচেঞ্জের অধিকারী হবো!
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, যে দেশে একটি স্টক এক্সচেঞ্জ সঠিকভাবে চলে না বা চালানো যাচ্ছে না; একটি কোনোভাবে চললেও অপরটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। লেনদেন ও মূল্যসূচক তলানিতে খাবি খাচ্ছে; সেখানে আরেকটি নতুন স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা কতোটা যুক্তিযুক্ত? নতুন স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার বিপুল ব্যয়ভার কারা বহন করবে? সরকার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা থেকে দেশী-বিদেশী সব কোস্পানিকে অব্যাহতি দেয়ার পর কোন্ ভালো মৌলের কোম্পানি তাতে তালিকাভুক্ত হবে? আর সে স্টক এক্সচেঞ্জের পারফরমেন্স কতোটাই বা ইতিবাচক হবে? ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনার এসব প্রশ্নের জবাব দিলে কথিত নয় বরং প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা খুশি হবে। তিনি এসব প্রশ্নের সহজ জবাব দিতে পারেবন কি?
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনার বড় দরপতনে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির শিকার বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের তিনি অবজ্ঞা করেছেন কথিত বিনিয়োগকারী বলে। বিনিয়োগকারীদের অসহায়ত্ব ও হৃদয়ে রক্তক্ষরণের বিষয়টি একেবারেই অনুধাবণ করতে চাননি বলেই তার মুখে এহেন মন্তব্য শোভা পেয়েছে। যে কোনো ধরনের অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং যৌক্তিক বা ন্যায় সঙ্গত দাবী আদায়ে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কর্মসূচী পালন দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। বিপর্যস্ত বিনিয়োগকারীরা ডিএসই’র সামনে বিক্ষোভ করায় ডিএসই কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছে।
অসহায় বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে বিএসইসি এবং ডিএসই কর্তৃপক্ষের কতো মিল! আসলে ‘সব শোষকের একই রা’প্রবাদ কি এখানে মিলে যাচ্ছে? বিসইসি কর্তৃপক্ষ আন্দেলনরত বিক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের তথাকথিত বিনিয়োগকারী বলে অভিযোগ করছে। আর ডিএসই এক ধাপ এগিয়ে থানায় জিডি করেছে অসহায় ও ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা যাতে আন্দোলন করতে না পারে।
ক্ষমতায় থাকলে অনেক কিছুই বলা যায়, সব ধরনের দোষ অধীনস্তদের ঘাড়ে চাপিয়ে দায় এড়ানো সহজ হয়। কিন্তু কর্তৃত্ব ফলানোর মানসিকতার দ্বারা বিদ্যমান সমস্যার সমাধান সম্ভব হয় না। এর জন্য প্রয়োজন আত্ম-সমালোচনা, আন্তরিকতা, সবার কাজে সচ্ছতা ও দক্ষতা। বিশে^ এ গ্রেড-এ যোগ্যতা অর্জনকারী স্টক একচেঞ্জ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিএসইসি তার কর্মকাÐে কতোটা দক্ষতার ছাপ রাখেছে? এ প্রশ্ন কথিত বিনিয়োগকারীদের নয়, দেশের সচেতন মহলেরও। দেশের পুঁজিবাজারে প্রথম ও প্রধান দাবী সুশাসন প্রতিষ্ঠা, তা কতোটা বাস্তবায়িত হয়েছে? তার দায় কী শুধু স্টক একচেঞ্জের না বিএসইসি’র?
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বক্তব্যে তাঁর জ্ঞানের ব্যাপক ব্যাপ্তি প্রকাশ করতে গিয়ে দেশের সুশীল সমাজের শিক্ষিত ব্যক্তি এবং গণমাধ্যম কর্মীদের ছাড় দেননি; সূচক হ্রাস বা বাজার মূলধন কমে যাওয়া নিয়ে তাদের ধারনা সঠিক নয় বা হিসাবের ভুল বলে মন্তব্য করেছেন। সেটা হতেই পারে, কেননা সবাই তাঁর মতো পরিসংখ্যাান বা হিসাব বিজ্ঞানের অধ্যাপক নয়। পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন থাকবে তা ঠিক; কিন্তু অদৃশ্য কারণ বা কারসাজির ফলে পুঁজিবাজার হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন হারালে এসইসি’র কর্তা ব্যক্তিদের মনে বিন্দুমাত্র আছর না পড়লেও বিপুল মূলধন ক্ষয়ে বিনিয়োগকরীদের হৃদয়ে যে রক্ত ক্ষরণ ঘটে তা সুশীল সমাজসহ সচেতন সবাইকে ভাবিত করে। দায়সারা প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিদের তা অনুধাবন করার কথা নয়।
তবে প্রফেসর হেলালউদ্দিন নিজামী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তা হলো- স্টক এক্সচেঞ্জ ব্যাবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাজার পরিচালনায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের চেয়ে কতিপয় ব্রোকার-ডিলারের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে। তাই বিকল্প স্টক এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে হচ্ছে।
একথাও সত্যি যে পুঁজিবারের উত্থান-পতনে স্টক এক্সচেঞ্জের স্টেকহোল্ডার স্টক ব্রোকারদের বড় যোগসূত্র রয়েছে। বাজারের অস্বাভাবিক উত্থান বা ব্যাপক ধসের ক্ষেত্রে স্টক ব্রোকারদের ভূমিকা উপেক্ষা করার বিষয় নয়। ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে শেয়ার বাজার বিপর্যয় বা কেলেংকারীর পর স্টক ব্রোকারদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তারা তখন একাধারে শেয়ার ব্যবসা এবং সরাসরি বাজার পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর সে কারণেই স্টক এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইজেশনের দাবী ওঠে। যার পরিনতিতে দেশের দু’টি স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছে- আলাদা করা হয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিষদকে মালিকদের হাত থেকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডিমিউচুয়ালাইজেশনের ইতিবাচক প্রভাব যদি বাজারে না পড়ে এবং ডিমিউচুয়ালাইজেশন পূর্ব দোষে স্টক এক্সচেঞ্জ দুষ্ট হয়; বিষয়টি কোনো ভাইে উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল মহলকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া উচিত।
মাহবুব হাসান সিদ্দিকী : বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক