ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

ইকোনমিক জোন,উপকূলীয় বনবেষ্টনি,স্থানীয়দের স্বপ্ন-শঙ্কা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:১১ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ১১:২০ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সোমবার

আমরা যারা উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দা আমাদের অনেকেই মজা করে হোক কিংবা হেয় করেই হোক 'চউররা' বলে ডাকতো। আমরা মজা করে বলতাম একদিন এই চরেই তোমরা জমি খুঁজবে, বাড়িঘর বানাতে আসবে আর এই চউররাদের ঈর্ষা করবে। ছোটবেলা থেকেই প্রবীণদের কাছ শুনতাম, এই যে বেড়িবাঁধ এটা দিয়ে এক সময় আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করব, এখানে বন্দর হবে,অনেক কিছুই হবে।আমরা বিশ্বাসই করতাম না, বরং হেসে উড়িয়ে দিতাম।তখন তাঁরা বলতেন, আমরা হয়তো দেখবো না, তোরা দেখবি এসব।

আসলে উনাদের কথা যে এত তাড়াতাড়ি সত্যি হবে আর সবকিছু এত তাড়াতাড়ি বদলে যাবে দুবছর আগেও স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি!এখন মনে হচ্ছে যে, মুরুব্বিদের কথা এক সময় বুজরুকি গল্প মনে হতো, এই মুরুব্বিদের অনেকেই হয়তো মাত্র ৩০ মিনিটেই জীবন সায়াহ্নে চট্টগ্রামে ডাক্তার দেখাতে যেতে পারবে কিংবা বাড়ি থেকে কয়েক পা ফেলে বড় বড় জাহাজ কিংবা রাতের বেলায় পশ্চিমাকাশে জাহাজের আলো দেখে ঘুমাতে যেতে পারবে।

এক সময়ের অনুন্নত, বিদ্যুৎবিহীন, রাস্তাবিহীন ডোমখালী, গজারিয়া, সাহেরখালী কিংবা মঘাদিয়ার উপকূলীয় জনপদ আমূল বদলে গেছে; যাকে একেবারে রাতারাতি বদলে যাওয়া বলে!এক সময় যে রাস্তাজুড়ে ছিলো হাঁটু পরিমাণ কাঁদা সেখানে এখন প্রতিনিয়ত বড় বড় ট্রাক চলে, যেখানে মানুষ আসতে নাক সিটকাতো সেখানে অসংখ্য মানুষ ঘুরতে আসে কিংবা দেখতে আসে।যেখানে মাত্র চার পাঁচবছর আগেও দোকানে এনে কিংবা সোলারে মোবাইলে চার্জ দিতো সেখানে একেবারে জনপদের শেষ প্রান্তে বাঁধের উপরে বানানো ছোট্ট কুটিরেও ইলেক্ট্রিক লাইট জ্বলে। দিনের বেলা যেখানে যেতে গা চমচম করতো সেখানে দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা মানুষের ক্রমাগত যাতায়াত।

ছোটবেলা থেকে যে বাগান ছিলো আমাদের কাছে রহস্য আর বাগান হয়ে ছোট্ট আইল ধরে সাগরের তীরে যাওয়া দুর্বোধ্য ব্যাপার কিংবা নানারকম মিথের উপর ভর করে যে জঙ্গলকে মনে হতো আমাজনের চেয়েও রহস্যময় সে বাগান পার হওয়া যায় গাড়িতে চড়েই। বাগানের শেষ প্রান্তে গেলে যেখানে কয়েকজন কাঠুরে কিংবা উরি খেতে আসা মহিষের দল দেখা যেতো সেখানে এখন দেখা যায় ভিনদেশী চাইনিজ আর দেশি শ্রমিকদের, দেখা যায় বিশাল বিশাল সব যন্ত্রাপাতি। সাগরের গর্জনের সাথে নির্মানযজ্ঞের যন্ত্র লোহার আওয়াজে প্রকৃতি আর যন্ত্রের সুরের অদ্ভুত এক দ্যোতনা।

আমি এই বদলে যাওয়াকে অসংখ্য মানুষের মতো স্বাগত জানাই, গর্বিত হই, গর্ব করি, স্বপ্ন দেখি অসংখ্য উপকূলবাসীর মতো। কিন্তু বেড়িবাঁধের উপর থেকে যে সূর্যাস্ত আমি অসংখ্যবার দেখেছি অসম্ভব মুগ্ধতা নিয়ে, সে সুর্যাস্ত দেখা যেন বড় কোন দালানের কারণে বন্ধ যেন না হয় সে স্বপ্নও দেখি। যে বাগানে অসংখ্যবার শুধু একটিবার হরিণ দেখতে গেছি, সেই হরিণ যেন হারিয়ে না যায় সেটিই চাই। যে স্লুইসগেটে অসংখ্যবার রুপালি ইলিশ কিনেছি কিংবা কিনে দিয়েছি সস্তায়, আজ থেকে কবছর পরেও যেন সেই রুপালি ইলিশ কিনতে যেন যেতে পারি সাহেরখালী কিংবা ডোমখালী স্লুইসগেটে।

আইলা, নার্গিস, কোমেন কিংবা শত দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করা এই ম্যানগ্রোভ বন, এই ঘন সবুজ উপকূলীয় বন বেষ্টনী যাতে নষ্ট না হয়। এটিকে রক্ষা করেও ইকোনমিক জোন করা যাবে এবং বাস্তবিক অর্থেই সম্ভব। শিল্পের সাথে প্রকৃতির দ্বন্দ্ব চিরন্তন।তবে প্রকৃতিকে বাঁচিয়েও শিল্পায়ন সম্ভব,সেটির উদাহরণ যেন হয় মীরসরাই ইকোনমিক জোন।পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে প্রকৃতিকে রক্ষা করে শিল্পায়ন হয়েছে, কৃষিকে বাদ দেয়া হয়নি।

আমাদের ইকোনমিক জোন যেন আমাদের পরিবেশ আমাদের জীবন-জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ উপকূলীয় বনবেষ্টনি, ডোমখালী- সাহেরখালী খাল কিংবা পুরো ইকোসিস্টেম রক্ষা করেই হয়। ইলিশের জন্য বিখ্যাত ডোমখালী-সাহেরখালী চ্যানেলে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ কিংবা সামুদ্রিক মাছ যেন সামনের দিনগুলিতেও পাওয়া যায় যার উপর নির্ভর করে টিকে আছে বেশ কয়েকটি জেলেপাড়ার হাজারো মানুষ।

যে ২৫ কিলোমিটার ম্যানগ্রোভ বন মীরসরাইয়ের উপকূলে আছে সেটি খুব দ্রুত উজাড় করলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য দারুণভাবে নষ্ট হবে। কারণ লক্ষ লক্ষ গাছ লাগিয়েও একটা প্রাকৃতিক বন করা যাবেনা, শত চেষ্টা করেও একটি ম্যানগ্রোভ বন বানানো যাবে না।

ইছাখালীর যে চরে বর্তমানে ইকোনমিক জোন তৈরি করা হয়েছে এটি মাত্র কয়েকবছর জেগে উঠা চর। কল কারখানা করার জন্য ওখানেই যে শত শত একর জায়গা আছে সেটিই যথেষ্ট বলে মনে করি।

আমি মেরিন ড্রাইভে করে তিরিশ মিনিটে সাহেরখালী থেকে সাগরিকা আসতে চাই। পশ্চিমে সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি আর গর্জন শুনতে শুনতে কিংবা সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে পাড়ি দিতে চাই পথ।আর এর পূর্বে থাকা বনবেষ্টনির কেওড়া বন আর বনের ভেতরে চড়ে বেড়ানো ভয়ার্ত হরিনের দল দেখতে চাই। এত তাড়াতাড়ি যেন বিশাল বনের মাঝে ইট পাথরের টুপরি না গড়ে উঠে!
কেআই/