বেক্সিমকো নিয়ে টিআইবি’র আপত্তিকর মন্তব্য
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:২১ পিএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০৪:৩৩ পিএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার
খেলাপিঋণ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে (টিআইবি) চিঠি দিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ। বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান এএসএফ রহমান স্বাক্ষরিত টিআইবি’র বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারপার্সনের কাছে পাঠানো এই চিঠিতে বলা হয়েছে ১৩ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর দেওয়া বিবৃতি ও ১৪ সেপ্টেম্বর দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালকের একটি বক্তব্য আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
বেশ কিছু আপত্তিকর অভিযোগের পাশাপাশি, দ্য ডেইলি স্টারে টিআইবি নির্বাহী পরিচালকের একটি উদ্ধৃতি প্রকাশ করা হয়েছে ‘ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে একদল লুটেরা আইনপ্রণেতা হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেছে।’ টিআইবি’র বিবৃতিতে যেহেতু বেক্সিমকো গ্রুপের অনুকূলে ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের একটি ঘটনা প্রাধান্য পেয়েছে, তাই এটি মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, নির্বাহী পরিচালক ওই মন্তব্য করেছেন আমাদের গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান ফজলুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে, যিনি গত নির্বাচনে ঢাকা-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
টিআইবি’র বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে বেক্সিমকো গ্রুপের দীর্ঘ সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালকের এ ধরণের আপত্তিকর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য অনভিপ্রেত এবং টিআইবি ও সংস্থাটির বর্ণিত মূল্যবোধের জন্য অমর্যাদাকর।
১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বেক্সিমকো গ্রুপ ফার্মাসিউটিক্যাল থেকে শুরু করে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাত সহ বাংলাদেশে যেসব বৃহৎ শিল্প বিকশিত হয়েছে, প্রায় সবগুলোতেই অবদান রেখেছে।
পণ্যের মান ও ব্যবসা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা বৈশ্বিক মানদণ্ড বজায় রেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএফডিএ অনুমোদিত প্রথম বাংলাদেশি কোম্পানি হলো বেক্সিমকো ফার্মা। যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ রপ্তানিকারী একমাত্র বাংলাদেশী কোম্পানিও বেক্সিমকো। আমাদের পোশাক কারখানা নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স-এর মানদণ্ড অনুসরণ করে। আমাদের কর্মীরা এই শিল্পের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত কর্মীদের মধ্যে অন্যতম। আমাদের সিরামিক শাখা, শাইনপুকুর সিরামিকস বিশ্বের ৭টি প্রতিষ্ঠানের একটি যেটি ‘বোন চায়না’ সিরামিকস উৎপাদন ও রপ্তানি করে।
চিঠিতে বলা হয়, আমাদের ভাইস চেয়ারম্যান যেহেতু দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন, তাই বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার ও সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের সময় বেক্সিমকো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চরম বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়। ওই সময় আমাদের গ্রুপে ঋণ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমাদের ভাইস চেয়ারম্যানকে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করা হয়, যেটি আইনের আদালতে পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকারের উদ্দেশ্য ছিল দেশে অরাজনীতিকরণ কায়েম করা। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই সফল ব্যবসায়ীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয় এবং জীবন ও ব্যবসা রক্ষার বিনিময়ে বিপুল অঙ্কের চাঁদার অর্থ পরিশোধে বাধ্য করা হয়। টিআইবি কি কখনই তত্বাবধায়ক সরকারের সময় কতিপয় ক্ষমতাসীন ব্যক্তির এ ধরণের অবৈধ চাঁদাবাজির সমালোচনা করেছে?
বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব নেতিবাচক পদক্ষেপ (যেমন, যথেষ্ট নগদ অর্থের প্রবাহ থাকা সত্তে¡ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে না দেওয়া) এই কোম্পানিকে নিদারূনভাবে আক্রান্ত করেছে ও কোম্পানির অপূরণীয় ক্ষতি সাধণ করেছে। এ কারণে তখন একটি সফল কোম্পানি হয়েও বেক্সিমকো মারাত্মক আর্থিক বিপর্যয় ও ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে যায়।
বেক্সিমকো গ্রুপে আর্থিক প্রবাহ বন্ধ করা ছাড়াও, কোম্পানির ফার্মাসিউটিক্যাল শাখাকে কোনো কারণ প্রদর্শন ব্যতিত প্রায় দুই বছর ধরে এলসি পর্যন্ত খুলতে দেওয়া হয়নি। এ থেকেই বোঝা যায় কীভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবিশেষ আমাদের একেবারে সাধারণ ও নৈমিত্তিক কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত করেছিল।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিএনপি ও তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে টানা ৭ বছর ধরে বেক্সিমকোর বিরুদ্ধে এই ধারাবাহিক বৈষম্যমূলক আচরণের ফলে কোম্পানির মধ্যে তারল্য সংকট দেখা দেয়। যার ফলে আমরা সময় মতো ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করতে সমর্থ ছিলাম না।
আমাদের মতো একটি বড় কোম্পানির জন্য এই পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক ছিলো যে আমরা এখনও সেখান থেকে পুরোপুরি সেরে উঠতে পারিনি। এত ভয়ানকভাবে আক্রান্ত হওয়ার পরও, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই ১১ বছরে আমরা বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ পরিশোধ করেছি। এ কারণেই বিভিন্ন ব্যাংকে আমাদের অ্যাকাউন্ট এখন নিয়মিত ও অশ্রেণিভুক্ত অবস্থায় আছে। সুতরাং, টিআইবি’র বিবৃতিতে বেক্সিমকোকে ‘শীর্ষ ঋণখেলাপি’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ায় আমরা ভীষণ বিস্মিত হয়েছি।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে টিআইবির বিবৃতিতে বেক্সিমকো গ্রুপের অনুকূলে একটি ঋণ পুনঃতফশিলিকরণের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। প্রথম যখন এই পুনঃতফশিলিকরণ অনুমোদন করা হয়, তার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে আমাদের সম্ভাব্য অর্থ প্রবাহ কেমন হতে পারে তা যাচাই করতে আমরা একটি স্বাধীন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনকৃত অডিট প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিই। পুরো ঋণ পরিশোধ করতে আমাদের ১২ বছর সময় প্রয়োজন হবে মর্মে সুপারিশ করে ওই অডিট প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যংক আমাদের ঋণকে দুইভাগে ভাগ করে: মেয়াদী ঋণ ও কার্যকরী মূলধন ঋণ। কার্যকরী মূলধন ঋণ পরিশোধের জন্য আমাদের ৬ বছরের সময় দেওয়া হয়। তবে ওই সময়ই আমরা ব্যাংককে জানিয়েছিলাম যে, ছয় বছরের মধ্যে ওই ঋণ পরিশোধ করা আমাদের আর্থিক প্রবাহ অনুযায়ী সম্ভব না-ও হতে পারে।
এখন আমরা অনুমান করছি যে, বিদ্যমান আর্থিক প্রবাহ অনুযায়ী নিয়মমাফিক কিস্তি পরিশোধে বিঘ্ন ঘটতে পারে। এ কারণেই আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রথম পুনঃতফশিলিকরণের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে স্বাধীন অডিট প্রতিষ্ঠানের মূল সুপারিশ পালন করার জন্য অনুরোধ জানাই।
এ ব্যাপারে ব্যাংকের নির্বাহী বিভাগ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বরং, আমাদের আবেদন ব্যাংকের বোর্ড সভায় উত্থাপন করা হয়। আমরা যদিও শুধুমাত্র আমাদের ঋণের জন্য পর্যালোচনার আবেদন করেছিলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড নিয়মিত অ্যাকাউন্টধারী অন্যান্য ঋণগ্রহীতার ক্ষেত্রেও একই পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আমরা মনে করি, আমরা যদি কোনো সমস্যায় পড়ি তাহলে বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করা একটি বৃহৎ কোম্পানি হিসেবে আমাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। বিশ্বজুড়েই এটি সাধারণ যে, যদি কোনো বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আর্থিক জটিলতার সম্মুখীন হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে ও সহায়তা করে।
আমরা এ বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করছি যে, আমাদের কোম্পানি চলমান ও কার্যকরভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এ দেশের বেসরকারী খাতে কর্পোরেট সংস্কৃতি চালু করা প্রথম প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আমরা অন্যতম। বিভিন্ন খাতে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা সংক্রান্ত কর্মকান্ডের জন্য আমাদের গ্রুপ বহুলপরিচিত। আমরা এ বিষয়টিও উল্লেখ করতে পারি যে, আমাদের গ্রুপে প্রায় ৬০ হাজারের মতো দক্ষ কর্মী সরাসরি নিয়োজিত এবং প্রায় ২ লাখের মতো মানুষ পরোক্ষভাবে জড়িত।
গত ১১ বছরে, দেশের ঘরোয়া বাজারের বিভিন্ন খাতে ব্যপক অবদান রাখা ছাড়াও, আমরা ৩০০ কোটি ডলারেরও বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছি। আমি নিশ্চিত আপনি একমত হবেন যে, এ দেশের জিডিপিতে আমাদের অবদান অসামান্য।
সুতরাং, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক যখন আমাদেরকে ‘লুটেরা’ বলে সম্বোধন করেন, তখন আমরা অত্যন্ত অপমান বোধ করি। এই মন্তব্য শুধু আমাদের ভাইস চেয়ারম্যানের জন্যই মর্যাদাহানিকর নয়, বরং সংসদ সদস্যদের মধ্যে যারা ঋণ পুনঃতফশিল করেছেন ও আমাদের গ্রুপের ৬০ হাজার কঠোর পরিশ্রমী কর্মীর জন্যও অবমাননাকর।
টিআইবি দাবি করে তারা দেশে স্বচ্ছতা আনয়ন ও আইনের শাসনের পক্ষে কাজ করে। কিন্তু মতামত-নির্ভর প্রতিবেদনের বরাতে যেই বিবৃতি টিআইবি দিয়েছে ও নির্বাহী পরিচালক আমাদের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান ফজলুর রহমান এমপি সহ সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে যেই অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন, তা শুধু হতাশাজনকই নয়, তা আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রতিও অমর্যাদাজনক।