ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

যে কারণে বিদেশি ফুটবলাররা চীনের নাগরিক হচ্ছে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:১৮ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সোমবার

এশিয়ার ফুটবল বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইং রাউন্ড শুরু করেছে চীন। আর এই কোয়ালিফায়ারে চীনের নতুন দু’জন খেলোয়াড়ের ওপর বিশেষ নজর রাখবে সবাই। তারা হলেন- লন্ডনে জন্ম নেয়া ২৬ বছর বয়সী নিকো ইয়েনারিস এবং ৩০ বছর বয়সী এলকেসন, যিনি মাত্র দুই মাস আগেও ব্রাজিলিয়ান নাগরিক ছিলেন।

গত মঙ্গলবার মালদ্বীপের বিপক্ষে হওয়া ম্যাচে চীনের ২৪ জনের স্কোয়াডে ছিলেন দু’জনই। আর কোনও প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে চীনের হয়ে বিদেশি খেলোয়াড়ের মাঠে নামার ঘটনা ওই দিনই প্রথম ঘটল। ম্যাচে এলকেসন বদলি নেমে দুই গোল করেন, ইয়েনারিস বেঞ্চে থাকলেও তাকে খেলানো হয়নি।

১৪০ কোটি মানুষের একটি দেশ ‘বিদেশিদের’ জাতীয় দলে খেলার সুযোগ দিচ্ছে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার জন্য- এমন ঘটনা ২০০২ এর পর এই প্রথম, আর এটি ফুটবল অঙ্গনে আনতে পারে বড় পরিবর্তন।

জাতীয় দলে বিদেশি ফুটবলার খেলানোর এই চিন্তাটি অনেক বছর ধরেই আলোচনায় থাকলেও ২০১৯-এর আগ পর্যন্ত ‌এর বাস্তবায়ন হয়নি।

চীনের জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দ্বিতীয়বার দায়িত্ব পালন করার পেছনে মার্সেলো লিপ্পির অন্যতম প্রধান শর্তই ছিল এটি।

চীন এশিয়া কাপ থেকে হতাশাজনকভাবে বিদায় নেয়ার পর ইতালিকে বিশ্বকাপ জেতানো লিপ্পি জানুয়ারিতে চীনের কোচের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। তবে এর ১১৯ দিনের মাথায় আবারো চীনের প্রধান কোচের দায়িত্ব নেন তিনি। তার পর থেকেই চীনের মিডিয়ায় বিদেশি খেলোয়াড়ের বিষয়টি অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয়।

ইয়েনারিস ও এলেকসন স্কোয়াডে ডাক পেয়েছেন, তবে তারা বাদেও আরও অনেকে আছেন যারা গত আট মাসে চীনের নাগরিক হয়েছেন বা নিকট ভবিষ্যতে নাগরিক হতে যাচ্ছেন।

ফিফা’র নির্ধারিত কয়েকটি নিয়ম ছাড়াও চীনের হয়ে খেলার জন্য আলাদা বেশ কয়েকটি নিয়ম মানতে হচ্ছে এই খেলায়াড়দের।

পরিবারের অন্তত একজনকে চীনা বংশদ্ভূত হতে হবে

চীন তাদের ফুটবলের পারফরমেন্সে উন্নতি করতে চাইলেও তাদের চীনা জাতীয়তাবাদী মনোভাব বিসর্জন দিতে প্রস্তুত নয়। তাই বিদেশি খেলোয়াড় দলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এমন খেলোয়াড়দের খোঁজ করা শুরু করে তারা, যাদের পূর্বপুরুষদের কেউ একজন চীনা বংশদ্ভূত ছিল।

জানুয়ারিতে চীনা সুপার লিগের শীর্ষক ক্লাবগুলোর একটি বেইজিং সিনোবো গুয়াং এফসি নিকো ইয়েনারিস ও জন হউ সায়েতারকে চীনা নাগরিক হিসেবে দলে নিবন্ধন করানোর ঘোষনা দেয়। চীনের ফুটবল ইতিহাসে তারা দু’জনই ছিল প্রথম বিদেশি বংশদ্ভূত খেলোয়াড়।

কোনও একটি ইউরোপিয়ান ক্লাবে বা অ্যাকাডেমিতে খেলার অভিজ্ঞতা

বিদেশি খেলোয়াড়দের নাগরিকত্ব দেয়া এখন চীনের ফুটবলে আইনগতভাবে অনুমোদিত হলেও চীনের ক্লাব এবং ফুটবল কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট দক্ষ খেলোয়াড় বাদে কাউকে সেই সুযোগ দিতে নারাজ।

দেশের তরুণ খেলোয়াড়দের দ্রুত উন্নতির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিশাল পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন, যার একটি অংশ হলো বিদেশ থেকে আনা খেলোয়াড়দের দিয়ে দ্রুত সাফল্য অর্জনের চেষ্টা।

ইয়েনারিস ছিলেন আর্সেনাল অ্যাকাডেমির খেলোয়াড় এবং হউ সায়েতার ছিলেন নরওয়ের ক্লাব রোজেনবার্গের হয়ে খেলা কনিষ্ঠতম খেলোয়াড়।

ফেব্রুয়ারিতে তাইয়াস ব্রাউনিংকে ইংলিশ ক্লাব এভারটন থেকে দলে আনে চীনের সুপার লিগের সাতবারের চ্যাম্পিয়ন গুয়াংজু এভারগানডে। ব্রাইনিংয়ের দাদা ষাটের দশকে চীন থেকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান।

কোনও চীনা ক্লাবে ব্যতিক্রমী পারফরমেন্স

আগস্টে ব্রাজিলে জন্ম নেয়া এলেকসনকে নাগরিকত্ব দেয় চীন, যদিও এলেকসনের পরিবারের সঙ্গে চীনের কোনও সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এলকেসন টানা ছয় বছর চীনের লিগে খেলেছেন। অথ্যাৎ, জন্মসূত্রে চীনা না হলেও চীনের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার সুযোগ পুরোপুরি শেষ হয়ে যাচ্ছে না।

কিন্তু তীব্র জাতীয়তাবাদী চেতনাসম্পন্ন চীনের জাতীয় দলে কেন খেলার সুযোগ পেলেন এলকেসন?

কারণ ১০৩ গোল করে এখনই চাইনিজ সুপার লিগের সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। চীনের সমর্থক এবং মার্সেলো লিপ্পির তাই এই ব্রাজিলিয়ানের ওপর আশার শেষ নেই।

গুয়াংজু এভারগ্রান্ডের আরেক খেলোয়াড় রিকার্ডো গওলার্টও তার ব্রাজিলিয়ান নাগরিকত্ব ত্যাগ করে চীনের পাসপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন বলে জানা যাচ্ছে।

মূল নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে হবে

লিওনেল মেসি স্প্যানিশ পাসপোর্ট থাকা স্বত্ত্বেও আর্জেন্টিনা দলে খেলতে পারেন, কিন্তু চীনের জাতীয় দলের ক্ষেত্রে সেটি সম্ভব নয়।

চীনের নাগরিকত্ব আইন দ্বৈত নাগরিকত্বকে বৈধতা দেয় না, অর্থাৎ চীনা নাগরিকত্ব পেতে হলে অন্য কোনও দেশের পাসপোর্ট রাখা যাবে না।

গত কয়েকবছর ধরে চীনে বিদেশিদের বসবাস বেড়েছে, তবে কেউ তার নরওয়েজিয়ান বা ব্রিটিশ পাসপোর্ট ত্যাগ করে চীনের নাগরিকত্ব গ্রহণ করছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে সে দেশের ফুটবলের সার্বিক চিত্রটা কতটা আশাব্যঞ্জক হতে পারে।

বছর দুয়েক আগে বিদেশি খেলোয়াড়দের এত বড় অঙ্কের পারিশ্রমিক দিত চীন যে সে দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বিদেশি খেলোয়াড়ের ট্রান্সফারের ওপর ১০০% কর আরোপ করে।

একটি চীনা নাম থাকা

একজন চীনা খেলোয়াড় চাইনিজ ভাষায় কথা বলতে না পারলেও তার একটি চীনা নাম থাকতেই হবে যেন সমর্থকরা সেই নাম ধরে তাকে উৎসাহ দিতে পারেন।

৯০’এর দশকের শেষ দিকে এশিয়ান ফুটবলের খবর রাখতেন যারা তারা মনে করতে পারবেন যে জাপানের জাতীয় দলে খেলা বিদেশি খেলোয়াড়দের আলাদা নাম দেয়া হয়েছিল।

রুই রামোসকে ডাকা হতো ‘রামসো রুই’,ওয়্যাগনার লোপেজকে বলা হতো ‘রোপেসু ওয়াগুনা’ আর অ্যালেক্স ডস স্যান্তোস হয়ে গিয়েছিলেন ‘সান্তোসু আরেসান্তেোরো।’ চীনেও বিষয়টি অনেকটা একইরকম।

নিকো ইয়েনারিস লি কে নামে পরিচিত, ইংরেজিতে তার প্রথম নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে এই নাম। এলকেসনের নাম আই কেসেন আর হউ সায়েতারের চীনা নাম হউ ইয়ংইয়ং।

তবে এসব নামের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম আলোচনায় থাকা একজন খেলোয়াড়ের নামটিই কিন্তু সবচেয়ে ব্যতিক্রমী।

আলইসিও ডস স্যান্তোস গনসালভেস গত জুলাইয়ে চীনের নাগরিক হয়েছেন, চীনা নাগরিক হিসেবে তার নিবন্ধনটি হয়েছে লুয়ো গুয়ো ফু হিসেবে।

বাধ্যতামূলকভাবে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া শিখতে হবে

বর্তমানে দু’জনের একজনও ম্যান্ডারিন ভাষা তেমন একটা না জানলেও ম্যাচের দিন জাতীয় দলের জন্য নিয়মিতভাবে খেলার আগে লি কে এবং এলকেসন দু’জনই জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া শিখে যাবেন নিশ্চিতভাবে।

চীনের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ভাষ্য, চীনের নাগরিকত্ব পাওয়ার পর একজন বিদেশি খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এটুকুই তাদের চাওয়া।

সুতরাং চীন আশা করতেই পারে যে তাদের দেশি ফুটবলারদের সঙ্গে ‘বিদেশি খেলোয়াড়দের’ অবদানের সমন্বয়ে কাতারের ২০২২ বিশ্বকাপে বেশ কয়েকবার চীনের জাতীয় সঙ্গীত শোনা যাবে।

সূত্র: বিবিসি