ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

যেভাবে ভোটার ও নানা অপকর্মে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:৪৫ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০২:০৯ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার

প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে বেশ সংকটময় সময় পার করছে বাংলাদেশ। আশ্রয় নেয়া এসব রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসা, মানবপাচার, খুন, চোরাচালান ও ডাকাতিসহ নানা অপকর্মে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। আর এসব কাজকে তরান্বিত করতে বিভিন্ন কৌশল বেছে নিয়েছে তারা।

এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়া। একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং প্রভাবশালীদের যোগসাজশে তারা বাংলাদেশের ভোটার হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে করে হুমকির মুখে পড়ছে দেশের নিরাপত্তা।

সম্প্রতি রোহিঙ্গা নারী লাকি আটকের পর রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার তথ্য বেরিয়ে আসে। চট্টগ্রামের একটি থানা নির্বাচন অফিসের তদন্তে এক এলাকার ফরমে অন্তত ১৪টি থানায় রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। ঐ ঘটনায় ইসির একজন উপসচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। নিয়ম বহির্ভূতভাবে একই এলাকার একটি ভোটার বইয়ের ৭৪টি নিবন্ধন ফরমের মাধ্যমে অন্তত ৬ জেলার ১৪টি থানা নির্বাচন অফিস থেকে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা হয়েছে।

একই নম্বরে একাধিক ব্যক্তি ভোটার হয়েছে। যেসব থানায় এসব ফরম ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি, ডবলমুরিং, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও, পাহাড়তলী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও রাঙ্গুনিয়া। নোয়াখালীর সেনবাগ, কক্সবাজার সদর ও টেকনাফ, রাঙ্গামাটির লংগদু, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি ও লক্ষ্মীপুরের কমলনগর।

রোহিঙ্গাদের ভোটার করার সঙ্গে চট্টগ্রামে একটি সিন্ডিকেট জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওই সিন্ডিকেটটি নিজের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তাদের নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট দিয়ে আসছে। 

তাদের প্রকৃত নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট দেওয়ায়, রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করতে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটার কার্যক্রম সংশ্লিষ্টদের। এমতাবস্থায় চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে ভোটারদের তথ্যসংবলিত কয়েকটি ল্যাপটপ খোয়া যাওয়ার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে এ ধরনের ৪৬ জন রোহিঙ্গা ভোটারকে শনাক্ত করেছে ইসি। 

এমতাবস্থায় ছড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমে কোনোভাবেই অন্তর্ভূক্ত না হতে পারে, সে জন্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, বিশেষ কমিটিসহ সারা দেশের আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা বা থানা নির্বাচন অফিসে সতর্কতা জারি করে চিঠি পাঠিয়েছে ইসি। 

তবে, রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তিতে নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত নেই বলে দাবি করেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। তিনি বলেন, যদি কেউ এমন কাজে জড়িত থাকেন, প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আগামী ২০ নভেম্বর শেষ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ। এ সময়ে যাতে দেশের কোথাও কোনো রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে না পারে সে জন্য সতর্কতা জারি করে চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। হালনাগাদ কার্যক্রম সফল করতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলার ৩২টি উপজেলাকে বিশেষ এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে।

এসব এলাকায় ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার তালিকায় আসতে না পারে, সে জন্য সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব উপজেলায় ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরপরও ভোটার হতে রোহিঙ্গাদের তৎপরতা থেমে নেই। 

জানতে চাইলে কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবি এম মাসুদ হোসেন একুশে টিভিকে বলেন, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সবসময় আমরা সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। তারা চট্টগ্রাসহ অন্যান্য স্থানে ভোটার হতে পারে কিংবা নতুন করে তৎপরতা চালালেও, কক্সবাজারে এমন কিছু ঘটেনি। 

তিনি বলেন, আমরা তৎপর রয়েছি। কোনোভাবেই যাতে রোহিঙ্গারা ভোটার হতে না পারে। 

মানবিক কারণে আশ্রয় পাওয়া এসব রোহিঙ্গা শুরুর দিকে ছোট খাট অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও, সময় বাড়ার সাথে সাথে তাদের অপরাধের সীমা দিনকে দিন বড় হয়েছে। ফলে, আশ্রিত এলাকার আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বেশ হুমকির মধ্যে রয়েছে। 

তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অনেক সময় হামলার শিকার হতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিতদের। প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে চোরাচালান, ইয়াবা পাচার, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও মানবপাচারের মত কাজে জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। ফলে, আতঙ্কে স্থানীয়রা।

এসব অপকর্মকে আরও এগিয়ে নিতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নাগরিক হতে মরিয়া। ইতোমধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে বিদেশ যাওয়াকালে বিমানবন্দরে আটক হয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। তারপরও, থেমে নেই দৌড়ঝাঁপ।  

সম্প্রতি নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নিজ দেশে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে রোহিঙ্গারা। আর এ কাজে উস্কে দেয়ার অভিযোগে গত ৩১ আগস্ট ৪১টির এনজিওকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ফলে দিন যত যাচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে রোহিঙ্গারা বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গাদের উৎপাতে এলাকাবাসী উদ্বিগ্ন, প্রশাসনও রয়েছে বেশ উৎকণ্ঠায়।

শুরু থেকে খাবার পেতে রোহিঙ্গাদের যত কষ্ট পেতে হতো, এখন সে চিত্র পাল্টে গেছে। এনজিও সংস্থাগুলো তাদের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে খাবার। এতে করে তাদের মাথায় চাপছে নতুন ভূত। কোনো কাজ ও সংকট না থাকায় বেপরোয়া আচরণ করছে, জড়িয়ে পড়ছে স্পর্শকাতর সব কর্মকাণ্ডে।

এমনকি, দিনের বেলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দৃশ্য থাকে একরকম, আর রাতের দৃ্শ্য অন্যরকম। ফলে, পুরো চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। 

এদিকে, দিন যত যাচ্ছে ততই অবনতির দিকে যাচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। 

কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, গত দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন রোহিঙ্গা। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে আরো প্রায় ৪০ জন। 

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার পর থেকে নানা অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া ৪৭১ মামলায় আসামি ১০৮৮ জন। এছাড়াও ইতিমধ্যে পুলিশ প্রায় আরও এক হাজার রোহিঙ্গাকে সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

এমতাবস্থায়, তাদের নিজ দেশে পাঠাতে যত সময় ক্ষেপণ হবে, এ অবস্থার অবনতি ততটাই ঘটবে। এক্ষেত্রে, তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোই একমাত্র সমাধান হতে পারে।
 
আই/