ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

বাংলাদেশে যেভাবে আসলো ক্যাসিনো

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:১৯ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:২৯ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শুক্রবার

ক্যাসিনো মূলত ইটালিয়ান শব্দ। ক্যাসিনো বলতে এমন এক শব্দ বোঝায় যেখানে জুয়া, নাচ,গান এবং বিভিন্ন খেলাধুলার সংমিশ্রণ থাকে। ১৬৩৮ সালে ইটালির ভেনিসে সর্বপ্রথম জুয়ার মাধ্যমে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু হয়।

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। আর ইসলামে জুয়া সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ। তবে জুয়া বাংলাদেশের একটি অতিপরিচিত শব্দ। অলিতে গলিতে চোখ মেলে তাকালেই এর দেখা মিলে। তবে বেশ কয়েক বছর আগে এটা এতটা খোলামেলা ছিল না। 

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গুঞ্জন আসে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক ক্যাসিনো-এর খোঁজ পাওয়া যায়। বিষয়টি জানতে পেরে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং প্রশাসনিক তৎপরতা চালানোর নির্দেশ দেন।

সম্প্রতি র‍্যাব-১ এর অভিযানে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেফতার এবং রাজধানীর বিভিন্ন অবৈধ ক্যাসিনোয় (জুয়া খেলার আসর) অভিযানের পর বৃহস্পতিবার (১৯সেপ্টেম্বর) দেশের টক অব দ্যা কান্ট্রি ছিল এই ক্যাসিনোকে ঘিরে।

খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার গ্রেফতারের পর অবৈধ ক্যাসিনোর সাথে জড়িতদের টনক নড়েছে। বের হতে শুরু করে নানা অপরাধের কাহিনী। সরকারের শুদ্ধি অভিযানের এই জালে আটকা পড়বেন নটের গুরুসহ অনেকেই। তাদের সকলকেই নজরদারী করছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যরা।

র‍্যাবের মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫০টিরও বেশি ক্যাসিনো রয়েছে। যেখানে জুয়ার পাশাপাশি নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। প্রশাসন এদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন।

বাংলাদেশে যেভাবে ক্যাসিনোর উদ্ভব

বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্লাবে দীর্ঘকাল ধরেই জুয়ার চর্চা ছিল, কিন্তু অনুমোদনহীন ক্যাসিনো কিভাবে চালু হলো তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না তেমন একটা।

তবে ক্লাবগুলোর সাথে জড়িত কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করে জানা গেছে আবাহনী মোহামেডানসহ অন্য প্রায় সব ক্লাবেই জুয়ার প্রচলন ছিল আশির দশক থেকেই এবং সেটি করা হতো মূলত ক্লাবের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্য।

তখন ক্লাবের সংগঠকরা রাজনীতিতে খুব একটা সক্রিয় ছিলেন না বরং ক্লাবগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল, ফলে খেলাধুলাতেও ক্লাবগুলো বেশ ভালো করেছিল।

এ বিষয়ে একটি ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘তখন মূলত ওয়ান-টেন নামে একটি জুয়া হতো। যেটি হাউজি নামেও পরিচিত ছিল। সপ্তাহে কয়েকদিন হতো। ক্লাবের বার্ষিক দাতাদের বাইরের বড় আয় আসতো এই হাউজি থেকেই।’

জানা যায়, জুয়া হিসেবে তখন ক্লাবগুলোতে হাউজি, ওয়ান-টেন ও রামিসহ কিছু খেলা চালু ছিল আর বোর্ড বা জায়গা ভাড়া দিয়ে অর্থ আয় হতো ক্লাবের।

ঢাকার ক্যাসিনোগুলো ঘুরে দেখা একজন ব্যবসায়ী জানান, ঢাকায় ক্লাবে ক্যাসিনো সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে কলাবাগান ক্লাবের হাত ধরে প্রায় ৭/৮ বছর আগে।

তিনি জানান, ‘এরপরই স্লট মেশিন, জুয়ার আন্তর্জাতিক মানের বিশেষ বোর্ড এগুলো আসতে শুরু করে ক্লাবগুলোতে। প্রথমে সব ক্লাবই বাকারা নামে একটি খেলা দিয়ে শুরু করে। পরে যোগ হয় রুলেট নামে আরেকটি খেলা।’

আরেকটি সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিবাজ কিছু সদস্যের মদদে মূলত এ নেপালিরাই নিয়ন্ত্রণ করত ক্যাসিনো সাম্রাজ্য। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত জুয়াড়ি এনে এই নেপালিরাই রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাব ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আড়ালে সাজিয়েছে পশ্চিমা ধাঁচের ক্যাসিনো ব্যবসা।

জুয়া ছাড়াও ইয়াবা-মদসহ বিভিন্ন মাদক সেবনের আখড়ায় পরিণত হয় এসব ক্যাসিনো।

১১ নেপালির হাত ধরে বাংলাদেশে ক্যাসিনোর বিস্তার লাভ করে। তারা হলেন- দিনেশ শর্মা, রাজকুমার, বিনোদ, দিনেশ কুমার, ছোট রাজকুমার, বল্লভ, বিজয়, সুরেশ বাটেল, কৃষ্ণা, জিতেন্দ্র ও নেপালি বাবা। রাজধানীতে যে কটি আধুনিক বৈদ্যুতিন ক্যাসিনো জুয়ার বোর্ড পরিচালিত হতো সেগুলোর বেশিরভাগই অপারেটিং সিস্টেম দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তারাই। চীন ও নেপাল থেকে মোটা বেতনে অভিজ্ঞ নারী-পুরুষ এনে এরাই সচল রাখেন ক্যাসিনোর চাকা। এ ১১ নেপালির কেউ কেউ ইতোমধ্যে ক্যাসিনোর মালিকও হয়েছেন।

প্রসঙ্গত, গত ৭ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভায় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। একই সভায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের দুই নেতাকে ইঙ্গিত করে সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই দুই যুবলীগ নেতার একজন মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে বুধবার র‌্যাব আটক করে।

অবৈধ ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া বুধবার রাতে গ্রেফতার হওয়ার পর হাজারখানেক নেতাকর্মী নিয়ে সংগঠনের কার্যালয়ে অবস্থান নেন মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট। তিনিও ঢাকার অন্তত একটি ক্যাসিনোর মালিক, সেই সঙ্গে একাধিক ক্যাসিনোর টাকা ভাগাভাগির সঙ্গে তার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তাকে যুবলীগ থেকে শোকজও করা হয়েছে।

দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়ার পর যুবলীগের কাকরাইল কার্যালয়ে উপস্থিত হন বিভিন্ন ইউনিটের সহস্রাধিক নেতাকর্মী। তাদের ধারণা, চলমান অভিযানে গ্রেফতার হতে পারেন সম্রাট। সে জন্য তারা কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছেন।

রাত ৩টার পরও কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের ভিড়ের কারণ জানতে চাইলে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার কাছে নেতাকর্মীরা প্রতিদিনই আসে। রাত ১টা-২টা পর্যন্ত থাকে। এটা নতুন কিছু নয়।’