ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:৪১ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ০৪:০২ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার
ইসলামের ইতিহাসে তথা বিশ্বের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসে এ সন্ধি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এ সন্ধিতে সাক্ষর করে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এক অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। তাই ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ মহানবী (সাঃ) এর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
মহানবী (সা.)কে অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে কুরাইশরা এক পর্যায়ে তাঁকে মদিনায় হিজরতে বাধ্য করেছিল। হিজরতের পরেও মহানবী (সা.) ও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। বদর, ওহুদ, খন্দকের মতো যুদ্ধ মহানবী (সা.) ও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়েই কুরাইশরা সংঘটিত করেছিল। আর এ উদ্দেশ্যে ইহুদি-খ্রিস্টানদের সহযোগিতা পেয়েও মুসলমানদের অগ্রযাত্রাকে রুখতে পরেনি। এক সময় তাদের সাথেই হুদায়বিয়ার সন্ধিতে বসতে হয়েছে। আর সন্ধির সুযোগে মহানবী (সা.) দেশে-বিদেশে ইসলামের আহ্বান পৌঁছিয়ে ইসলামের দ্রুত বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন।
হুদায়বিয়ার সন্ধির পটভূমি :
দীর্ঘদিন মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে এসে মহানবী (সা.)-এর প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। কাবা শরীফ জিয়ারত করবার মহান আল্লাহ তায়ালার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেয়ে মহানবী (সা.) ৬ষ্ঠ হিজরীতে জিলকদ মাসে পবিত্র উমরাহ পালনের সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) তাঁর চৌদ্দশত সাহাবীসহ শান্তিপূর্ণভাবে উমরাহ সম্পন্ন করার জন্য মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের শত্রুতা তখনো শেষ হয়নি। তারা মুসলমানদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইল। খুযায়া গোত্রের সর্দার বুদাইলের মাধ্যমে কুরাইশদের এই মনোভাবের কথা মহানবী (সা.) জানতে পারলেন। মহানবী (সা.) বুদাইলের মাধ্যমে কুরাইশদের এই মর্মে সংবাদ দিলেন যে, মুসলমানরা কোনো যুদ্ধের জন্য নয়, বরং শান্তিপূর্ণভাবে কাবা শরীফে উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলমানদের বাধা দেবার জন্য কুরাইশরা ছিল সংকল্পবদ্ধ। মহানবী (সা.) হুদায়বিয়া নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করে তাঁর পাঠানো সংবাদের উত্তর জানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কুরাইশদের মধ্যে কিছু বিজ্ঞ ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর শান্তিপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করতে চাইল। তারা জানতো যে, মুহম্মদ (সা.)কে যদি উমরাহ পালন করতে দেয়া না হয় তাহলে এর ফলে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তাছাড়া মহানবী (সা.) এর সাথে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে মক্কার কুরাইশরা সিরিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃচালু করতে পারবে। কারণ মদিনার উপর দিয়ে যাওয়া এই বাণিজ্য পথটি মুসলমানদের দখলে রয়েছে। অতএব, কুরাইশরা তাদের মুখপাত্র হিসেবে উরওয়া ইবনে মাসউদকে মহানবী (সা.) এর নিকট এই সন্ধিচুক্তির শর্ত নির্ধারণের জন্য প্রেরণ করলেন। উরওয়া মহানবী (সা.) এর নিকট আসলো। কিন্তু উভয় পক্ষের আলোচনাকালে মহানবী (সা.)-এর অনুসারীদের সম্পর্কে তার অপ্রীতিকর ও শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে চুক্তি সম্পন্ন সফল হননি। তবে উরওয়া মহানবী (সা.) এর উপর সাহাবীদের প্রগাঢ় ভক্তি, ভালোবাসা ও আস্থা লক্ষ্য করে এবং মক্কায় ফিরে গিয়ে কুরাইশদের তা অবহিত করে। মহানবী (সা.) দ্বিতীয়বার কুরাইশদের নিকট খিরাস ইবনে উমাইয়া নামক একজন দূতকে প্রেরণ করলেন, কিন্তু কুরাইশরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং তার উটের পায়ের রগ কেটে দেয়। কুরাইশরা মহানবী (সা.) ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে খুবই শত্রুতামূলক আচরণ করে। তারা মুসলমানদের হত্যা করার জন্য একটি ক্ষুদ্র দলকেও পাঠায়। কুরাইশদের এ সমস্ত লোক আক্রমণ করতে এসে নিজেরাই মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। কিন্তু মহানবী (সা.) তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দেন এবং মক্কার পবিত্র কাবা ঘরের আওতার মধ্যে রক্তপাত করতে নিষেধ করেন। অতপর মহানবী (সা.) হজরত ওসমান (রা.)কে শান্তির জন্য কুরাইশদের নিকট প্রেরণ করেন। হজরত ওসমান (রা.) মক্কায় পৌঁছলে কুরাইশরা তাঁকে বন্দী করে। মুসলিম শিবিরে এরূপ গুজব রটে যে, কুরাইশরা হজরত ওসমান (রা.)কে হত্যা করেছে। মহানবী (সা.) এই খবরে খুবই মর্মাহত হলেন। পবিত্র কাবা শরীফের এলাকার মধ্যে পবিত্র মাসে কোনো আরব গোত্র প্রধানকে হত্যা করা ইসলামপূর্ব আমলেও আরবদের জন্য জঘন্য অপরাধ বলে বিবেচিত হতো।
মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের ডেকে নতুন করে শপথ নেয়ার জন্য বললেন যে, তাদের ধর্ম ও ঈমানের জন্য শেষ পর্যন্ত তাঁরা যুদ্ধ করবে। একটি গাছের নিচে এই শপথ নেয় হয়। ইতিহাসে এই শপথকে ‘বাইয়াতুর রিদওয়ান’ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘মু’মিনরা যখন বৃক্ষতলে তোমার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করলো তখন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন। তাদের অন্তরে যা ছিল, তা তিনি অবগত ছিলেন। তাদেরকে তিনি দান করলেন প্রশান্তি এবং তাদেরকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়।’
সকল সাহাবীর শপথ গ্রহণ শেষ হলে রাসূল (সা.) তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর দিয়ে হজরত ওসমানের প্রতিশোধ গ্রহণ কল্পে নিজে শপথ নিলেন। পরে অবশ্য হজরত ওসমান (রা.) নিরাপদে মুসলিম শিবিরে ফিরে আসেন।
কুরাইশরা বুঝতে পারলো যে, এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বিস্ময়করভাবে একান্ত অনুগত ভক্ত সমন্বয়ে গঠিত এই দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা সফলকাম হতে পারবে না। তাদের অবিস্মরণীয় অতীত ও শোচনীয় পরাজয়ের স্মৃতি তখনো তাদের মনে স্পষ্ট হয়ে আছে। তাই তারা সুহাইল ইবনে আমরকে মুসলমানদের নিকট সন্ধি করার জন্য দূত করে পাঠালো। তার সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উভয় পক্ষে একটি যুদ্ধ বিরতিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়। ইতিহাসে এটিই ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে খ্যাত।
কি আছে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’তে :
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপ :
* এ বছর পবিত্র কাবায় ওমরা পালন না করেই মুসলমানগণ মদিনায় ফিরে যাবে।
* মুসলমানরা পরের বছর উমরা করতে পারবে। কিন্তু তিনদিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না।
* অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই তারা পরবর্তী বছর পবিত্র নগরীতে আসবে। এ সময় কেবলমাত্র কোষবদ্ধ তরবারী সঙ্গে আনা যাবে।
* মক্কায় বসবাসরত কোনো মুসলমানদের তারা সাথে করে মদিনায় নিয়ে যেতে পারবে না, আবার কোনো মুসলমান যদি মক্কায় যেতে চায় তাকেও তারা বাধা দিতে পারবে না।
* যদি কোনো মক্কাবাসী মদিনায় চলে যায় তবে তাদেরকে হস্তান্তর করতে হবে, আর যদি কোনো মুসলমান মক্কায় আসে তবে মক্কাবাসীরা তাকে হস্তান্তর করবে না।
* আরবের অন্যান্য গোত্র স্বাধীনভাবে যে কোনো পক্ষের মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে।
* এই চুক্তির মেয়াদ হবে দশ বছর।
যদিও সাধারণভাবে মুসলমানগণ শর্তাবলীতে খুশি হতে পারেনি। চুক্তির শর্তগুলো ছিল বড় বেশি একতরফা। সন্ধিচুক্তির শর্তাবলী নিয়ে আলাপ-আলোচনাকালে কুরাইশদের একগুঁয়ে আচরণ মুসলমানদেরকে ভেতরে ভেতরে ক্রোধান্বিত করে তোলে, কিন্তু মহানবী (সা.) এর মনঃতুষ্টির জন্য তারা শান্ত থাকে।
ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ :
ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ষষ্ঠ হিজরিতে মুসলমানরা হজ করতে গেলে মক্কার কোরাইশরা তাতে বাধা দেয়। এ অবস্থায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় মুসলমানরা। এ পরিস্থিতিতে কোরাইশরা সন্ধি করতে প্রস্তুত হলো এবং এ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য সুহাইল বিন আমরকে দূত বানিয়ে পাঠাল। তার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা হলো এবং শেষ পর্যন্ত সন্ধির শর্তাবলি স্থিরিকৃত হলো। সন্ধিপত্র লেখার জন্য হজরত আলী (রা)-কে ডাকা হলো। সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর তরফ থেকে তখন কোরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বলল : ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’ এ কথায় সাহাবিদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হজরত আলী (রা.) কিছুতেই এটা মানতে রাজি হলেন না। কিন্তু হজরত (সা.) নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কি? কিন্তু খোদার কসম, আমি তাঁর রসুল।’
রাসূল (সা.) এর রিসালাত ও বিশাল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটা ছিল মক্কার নেতৃস্থানীয় কাফিরগণ কর্তৃক মদিনায় প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং মহানবী (সা.) এর নেতৃত্বের স্বীকৃতির দৃষ্টান্ত। এতকাল যারা ছিল প্রাণের শত্রু, আজ তারই সন্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে দশ বছর যুদ্ধ বিগ্রহ না করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমেই মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর ঘর কাবা ঘর জিয়ারত করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চুক্তির ফলেই মহানবী (সা.) ইসলামের আহ্বান দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পান। এই সন্ধির পরেই খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস ও উসমান বিন তালহাসহ বড় বড় যোদ্ধা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই মহান চুক্তির ধারাগুলো আপাত দৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অসম্মাজনক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। অল্প সময়ের মধ্যে মদিনার বাইরের বিভিন্ন গোত্রর বহুসংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এই সন্ধির একটি শর্ত অনুযায়ী মক্কা হতে প্রত্যাগত নবদীক্ষিত মুসলমানদের মহানবী (সা.) মক্কায় পাঠিয়ে দিতেন, আবু জান্দাল যার জ্বলন্ত প্রমাণ। পরবর্তীতে এই রকম নবদীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাঁরা সন্ধিশর্ত বজায় রেখে মদিনা না গিয়ে সমুদ্র তীরবর্তী ‘ইস’ নামক এক জঙ্গলে বসবাস করতে শুরু করেন। সিরিয়া হতে প্রত্যাগত মক্কার ব্যবসায়ীদের সেই পথ দিয়ে আসতে হতো, ফলে তারা এই সমস্ত নবদীক্ষিত মুসলমানদের হুমকিস্বরূপ মনে করে নিজেরাই শর্তটি সংশোধনের অনুরোধ জানায়। ফলে এই সমস্ত মক্কার নবদীক্ষিত মুসলমানরা মদিনায় মহানবী (সা.) এর সাথে মিলিত হবার সুযোগ পান। এইভাবে দেখা গেল, শর্ত যেমনই হোক না কেন, এর সুফলগুলো ছিল মুসলমানদের পক্ষে।
মুসলমানদের বিজয় :
হুদায়বিয়ার সন্ধি ইসলামের জন্য একটি সুমহান বিজয়। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচালক মহানবী (সা.) এর এ হুদায়বিয়া সন্ধি স্বাক্ষরের মাধ্যমেই মূলত মক্কা বিজয়ের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়।
‘হুদায়বিয়ার চুক্তি’র ফলেই মুসলিম মিল্লাত আরব বিশ্বে একটি শক্তিধর জাতির সম্মান লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল করীমে হুদায়বিয়ার সন্ধিকে তাই ‘ফাতহুম মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই মহান সন্ধির ধারাবাহিকতায় ইসলামের উত্তরোত্তর প্রসার এবং সর্বোপরি ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। যা বিশ্বজয়েরও সূচনা করে।
হুদায়বিয়ার সন্ধি দুই বছর স্থায়ী হয়। এই দুই বছরে ইসলাম অনেকটাই শক্তিশালী হয়। সন্ধি কার্যকর হওয়ার পর খুযায়া গোত্র মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের শত্রু বনু বকর কুরাইশদের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মুসলমানদের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় কুরাইশদের অন্তর্জ্বালা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি তাদের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে এক প্রচণ্ড ক্রোধের। খুযায়া গোত্র মহানবীর (সা.) সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় কুরাইশরা তাদের মিত্র বনু বকরকে খুযায়া গোত্র আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকে। এই গুপ্ত চক্রান্তের ফলে বনু খুযায়াবাসী যখন ‘ওয়াতির’ নামক জলাশয়ের নিকট এক রাত্রে নিদ্রামগ্ন ছিল, তখন অতর্কিতভাবে বনু বকর তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে বনু খুযায়ার অনেক লোককে হত্যা ও তাদের ধন-সম্পদ লুট কর নিয়ে যায়। কুরাইশরা এই আক্রমণে তাদের প্রকাশ্যে সাহায্য করে। বনু খুযায়া গোত্র এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে কুরাইশদের নিকট অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে তারা মহানবী (সা.) এর নিকট তাদেরকে রক্ষা করার জন্য একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। মহানবী (সা.) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে কুরাইশদের তিনটি শর্ত দিয়ে এর যে কোনো একটি বেছে নেয়ার জন্য বার্তা প্রেরণ করেন :
১. খুযায়া গোত্রের যেসব লোককে হত্যা করা হয়েছে, কুরাইশদের তার রক্তপণ প্রদান করতে হবে, অথবা
২. বনু বকরের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, অথবা
৩. কুরাইশদেরকে হুদাইবিয়া সন্ধি বাতিল বলে ঘোষণা করতে হবে।
কুরাইশ পক্ষ প্রথম দু’টি শর্ত মেনে নিতে অস্বীকার করে কুরত ইবন উমারের মাধ্যমে মহানবীর (সা.) নিকট সংবাদ পাঠায় এবং এই সংবাদে তারা জানিয়ে দেয় যে, তারা তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করেছে। কুরাইশদের পক্ষে এটা ছিল একটি অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ। হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি বিলুপ্তির অনিবার্য ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করতে পেরে পরবর্তীতে আবু সুফিয়ান চুক্তিটি নবায়নের উদ্দেশ্যে নিজেই মদিনায় মহানবী (সা.) এর সাথে সাক্ষাতের জন্য গমন করেন। কিন্তু তার প্রস্তাবের পাশাপাশি মুসলমানদের দাবির প্রতি তিনি কর্ণপাত করেননি। এটি ছিল নিতান্তই অযৌক্তিক। ফলে মহানবী (সা.) তার চুক্তি নবায়নের প্রস্তাবে সম্মত হননি।
এসএ/