কিডনি রোগ শনাক্তকরণের উপায় ও প্রতিকার
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:১১ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ০৯:১৯ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ শনিবার
কিডনি মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই কিডনি রোগ খুব নীরবে শরীরের ক্ষতি করে। খুব বেশি জটিল আকার ধারণ না করলে এটি সনাক্তকরণ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় তা অনেকটা সহজ হয়েছে।
এ পর্যায়ে একুশে টিভির পাঠকদের জন্য ‘কিডনি রোগ সনাক্তকরণের উপায় ও প্রতিকার নিয়ে কথা বলেছেন” জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রাক্তন পরিচালক অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ। একুশে টিভির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন তিনি।
একুশে টিভিঃ কারো কিডনি রোগ হয়েছে কিনা তা কিভাবে বুঝতে পারা যায়। কিংবা কিভাবে সনাক্ত করা যেতে পারে?
ডা. শামীম আহমেদঃ আমাদের শরীরে যে কিডনি রয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের হার্ড একটা কিন্তু কিডনি দুইটা। এর একটি না থাকলেও একজন মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবে। প্রথম কথা হলো, কিডনি কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ?
এর কারণ হলো, আমরা প্রতিদিন যা খাই যেমন প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেডস, মিনারেল অথবা যে ঔষধ খাই, তার প্রত্যেকটি প্রথমে লিভারে মেটাবলিজম হবে, কিডনি দিয়ে বের হয়ে যাবে।
এখন যদি কিডনি কাজ না করে, তাহলে এই জিনিসগুলো আমাদের শরীরে থেকে যাবে। আর এটাতো প্রতিদিনের কাজ, ২৪ ঘণ্টায় এটা কাজ করে। কাজটা যদি ব্যহত হয়, তাহলে সেগুলো দেহে জমা হয়ে থাকবে। ফলে কিডনি কাজ করবে না।
আর কিডনি কাজ না করার কারণ হলো, যেটা ধীরে ধীরে কিডনি ড্যামেজ বা ধ্বংস করে যেমন, আপনার ব্লাড প্রেসার, ডায়বেটিকস আছে কিনা, আপনার দুটো কিডনিতে ন্যাফ্রাইটিস (প্রদাহ) এ প্রোটিন লিক করছে, ব্লাড অ্যালবুম কমে যাচ্ছে, কোলেস্টরেল বেড়ে যাচ্ছে এবং আপনার শরীরে পানি আসছে।
এগুলোর হয়তো আপনার ছোটবেলা অথবা যেকোনো বয়সে হয়েছে। এমনকি আপনি সুস্থ হয়েছেন। তারপরও, পুনরায় হতে পারে। আবার কখনো কখনো জন্মগতভাবেও হয়ে থাকে। যেমন-পলিস স্টিক কিডনি। যেটাতে ছোট ছোট কতকগুলো সিস থাকে। এর মধে একটা থেকে চারটা পর্যন্ত থাকলে কোনো অসুবিধা হয়না। অনেক সময় আল্ট্রাস্নোগ্রাম করলেও সিস ধরা পড়ে। এতে, কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু মাল্টিপল সিস থাকলে কিডনি তার কাজটা করতে পারেনা। আবার রাস্তাটাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে, জন্মগতভাবে, যেমন- কিডনির পরে যে মূত্রনালীতে পেলেভিস ধরা পড়ে। এর সংখ্যাই বেশি, এবং তা আনডিটেক্ট থাকে। এতে দুদিক থেকেই যদি ব্লক হয়ে যায় তাহলে দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।
এছাড়া, কিডনি রোগ সনাক্তের আরেকটা উপায় হলো, অনেক সময় কিডনিতে, মূত্রনালীতে পাথর জমা হয়ে থাকে। এটি ধরা পড়ে। কেননা, কিডনি কিংবা মূত্রনালীতে পাথর হলে ব্যাথা অনুভূত হয়।
পাথরে যদি রাস্তা ব্লক থাকে, বিশেষ করে ছেলেদের পেসাবের রাস্তায়। অথবা মহিলাদের ক্যান্সারে ইনভিউটেশন কিডনির রোগের অন্যতম কারণ।
এটি হচ্ছে ধীর গতীর কারণ। কিন্তু কিডনি তাৎক্ষণিকভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এর কারণ হলো, ডায়বেটিকস, প্রেসার ও অন্যান্য রোগ থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত বেদনানাষক ঔষধ খাওয়া। আরেকটি ডায়েরিয়া হলে শরীরে যে ডিহাইড্রেশন হয়, শরীরে লবণ ও পানির সংকট পড়ে, সেটার জন্য অ্যাকুট্রনার ফেলো হতে পারে। এছাড়া অনেক সময় বাহিরের খোলা খাবার, পানি জাতীয় শরবত কিডনি রোগের অন্যতম কারণ হতে পারে।
একুশে টিভিঃ রোগীরা কিভাবে বুঝবে তার কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে বা যাচ্ছে?
ডা. শামীম আহমেদঃ প্রায় ৮০/৯০ ভাগ ক্ষেত্রে উপসর্গ থাকতে পারে, বাকি ১০ ভাগের উপসর্গ নাও থাকতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো উপসর্গ দেখা দিলে কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য ব্লাড প্রেসার, ডায়বেটিকস নিয়মিত পরীক্ষা করা দরকার।
আর ক্লাসিক্যাল উপসর্গগুলো হলো, খাওয়ার রুচি থাকবেনা, বমিবমি লাগবে, অনেক সময় দুর্বলতা লাগবে, রক্তের শূন্যতা দেখা দিবে, গিরায় গিরায় ব্যাথা, চুলকানি, শরীরে পানি আসে, শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। অনেক সময় গ্যাসের কারণে কিংবা অ্যাপেন্ডি সাইডের ব্যাথা প্রভূতি কারণে বমি হয়ে থাকে। কিন্তু ভোমিটিং, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তের শূন্যতা। এই তিনটি প্রধান বাহন হিসেবে কাজ করে।
এখন যেভাবে কিডনি রোগ আছে কিনা বুঝতে পারবেন, প্রথম হলো আপনার ডায়বেটিকস আছে কিনা। আর সেটা সনাক্ত করতে আপনার রক্ত পরীক্ষা কিংবা ইউরিন টেস্ট করলেই খুব সহজে বোঝা যাবে। এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যাকে বলা হয়ে থাকে, ‘ইউরিন ইজ দ্য মিরর অব কিডনি’।
কেননা, ইউরিন পরীক্ষা থেকেই সর্বপ্রথম আপনি বুঝতে পারবেন কিডনি রোগে ভুগছেন কিনা। ইউরিনে যদি প্রোটিন লিক করে সেটা ওয়ান প্লাস কিংবা টু প্লাস যাই হোক সেটা ব্যাপার না। কেননা, সেটা কিডনি থেকে এমনি শেডিং হয়।
কিন্তু যদি প্রোটিন থ্রি প্লাস কিংবা ফোর প্লাস হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে কিডনির ছাকনি থেকে আসতেছে। এটাই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। এর ফলে প্রোটিন ৩ গ্রাম থেকে ৪০ গ্রাম পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বের হয়। এর ফলে রক্তে অ্যালবোমিন কমে যায়। এর ফলে রক্তে যে পানি থাকে, সেটি বেরিয়ে আসে। এতে আপনার শরীরে পানি আসে। মানুষের শরীরে তিনটি কারণে পানি আসতে পারে, কিডনি, লিভার এবং হার্ট।
মহিলাদের ক্ষেত্রে পেসাবে অনেক সময় ইনফেকশন দেখা দেয়। যা অনেক মহিলাদের কিডনি, মূত্রনালীতে হয়ে থাকে। তা পর্যালোচনা করে আমরা প্রাথমিকভাবে একটা এন্টিবায়টিক দেই। আর যদি, ডায়বেটিকস থাকে এবং বারেবারে আসে এবং ব্যাথাটা ছাড়ছেনা, তখন আমাদের কালচার করে নিতে হবে।
একুশে টিভিঃ কোমর ব্যাথা কিংবা ব্যাক পেইন হলেই কি আমরা ধরে নিবো কিডনি খারাপ হয়ে গেছে?
ডা. শামীম আহমেদঃ লো ব্যাক পেইন কখনো কিডনি থেকে হয়না। তবে মূত্রনালীতে যখন পাথরের কারণে পেসাব আটকে যায়, তখন তীব্র ব্যাথা হয়। যাকে রেনাল কলিক বলা হয়ে থাকে। এটা হলে, কয়েক ঘণ্টা জ্বালাপোড়া করবে আবার থেমে যাবে। দু’তিন দিন পর আবারও ব্যাথা হতে পারে। এছাড়া, ব্যাক পেইনের সঙ্গে কিডনি রোগের কোনো সম্পর্ক নেই।
একুশে টিভিঃ উচ্চরক্ত চাপের সঙ্গে কিডনির সম্পর্ক কতটুকু?
ডা. শামীম আহমেদঃ কিডনি রোগের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ। হাইপার টেনশনের কারণে কিডনি রোগ হয়ে থাকে। আর কিডনি নষ্ট হতে থাকলে, ব্লাড প্রেসার হয়ে থাকে। কিডনির প্রথম ফাংশন হলো, এক্সক্রেটেরি ওয়াস্ট প্রোডাক্ট দ্বিতীয়ত, ব্লাড প্রেসার কন্ট্রোল তৃতীয়ত, শরীরের লবণ ও পানির ব্যালেন্স চতুর্থত, হরমোনার ফাংশন। হরমোনের কারণে কিডনি রোগীদের রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। যার ফলে, আয়রণ দিলেও ভাল হয়না।
একুশে টিভিঃ ব্লাড প্রেসারের রোগীদের যে ঔষুধ দেয়া হয়, সেখানে কিডনিকে প্রোটেকশন দিবে এমন কোনো ঔষধ রাখা যায় কিনা?
ডা. শামীম আহমেদঃ প্রকৃত ব্যাপার হলো কিডনির রোগ হলে একটা ঔষধে কাজ হয়না। রোগীর অবস্থা দেখে হাইয়েস ডোজ দিয়ে দিতে হবে। প্রথমে তা দিয়ে না হলে, আবার দিতে হবে। এটার মূল লক্ষ্য হলো ব্লাড প্রেসারকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।
একুশে টিভিঃ কিডনি রোগে ক্রিয়েটেনিন নিয়ে কনফিউশন থাকে। অনেক সময় রোগী একের উপরে উঠে গেলে মনে করে তার কিডনি বিকল হয়ে গেছে। আসলে ক্রিয়েটেনিনের রেঞ্চ কত?
ডা. শামীম আহমেদঃ আমাদের মাঝে ক্রিয়েটেনিন ইউনিট নিয়ে অনেক সময় গন্ডগোল হয়ে যায়। নরমালি ধরা হয় ১ দশমিক ২ কিন্তু ল্যাবরেটরি রেফান্সে হয়তো দেখা যায় ১ দশমিক ৩ অথবা ৫ ধরা হয়। আরেকটা হলো মাইক্রোমুন। এতে একটু বেশি থাকবে।
ক্রিয়েটিন যদি নরমাল থাকেন তাহলে ভাল কিন্তু নরমাল থেকে যদি বেশি হয় তাহলে কিডনি ৫০ ভাগ কাজ করেনা। একটা টেস্ট দেখে কখনো শতভাগ মনে করা যাবেনা যে, কিডনি নষ্ট হয়েছে। এ জন্য কমপক্ষে দুটি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা উচিত।
আরেকটা হলো আপনার ডিহাইড্রেশন ছিলেন, প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি খেয়েছেন, ব্যাথার ঔষধ খেয়েছেন কিংবা হয়তো ডায়েরিয়া হয়েছিল যার ফলে ক্রিয়েটিন একটু বেশি থাকে। তাই একটু অপেক্ষা করতে হবে। একটা পরীক্ষা করেই কিডনি রোগ বলা উচিত নয়।
অনেক সময় ক্রিয়েটিন নরমাল থেকেও জিএফআর কম থেকে থাকে। কেননা, ৩০ বছরের পর থেকে ক্রিয়েটিন কমতে থাকে।
একুশে টিভিঃ কিডনি রোগীদের জন্য কি ধরণের খাবার গ্রহণ করতে হবে?
ডা. শামীম আহমেদঃ কিডনি রোগীদের জন্য ডায়েট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডায়েটের মধ্যে প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, মিনারেল ও ওয়াটার। এর মধ্যে প্রোটিনের ব্যাপারে আমরা জোর দেই।
কেননা, প্রোটিন বেশি খেলে ক্রিয়েটিন বেড়ে যাবে। আরেকটা, পানি। মনে রাখতে হবে শরীরে পানি আসে তখনি, যখন কিডনি কাজ করছেনা। লিভার কিংবা হার্টের রোগ হোক, যদি পেসাব কিডনি বের করে দেয়, শরীরে পানি আসবে না। কাজেই শরীরে যখনি পানি আসবে, ধরে নিতে হবে কিডনি খারাপ হয়ে গেছে।
আই/আরকে